X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মেনোপজ

তসলিমা নাসরিন
১৫ জানুয়ারি ২০১৭, ১৭:২৪আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০১৭, ১৭:৩৭

তসলিমা নাসরিন কিছু কিছু অতিথি শব্দ অন্য ভাষা থেকে এসে ঘরের বাংলা শব্দকে রীতিমত ফেয়ারওয়েল দিয়ে  দেয়। যেমন: মেনোপজ। রজঃনিবৃত্তি নামে একটি শব্দ আমাদের থাকা সত্ত্বেও আমরা বলি মেনোপজ। মেনোপজ নিয়ে ইদানীং আমার বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। মেনোপজ নামক প্রক্রিয়ার  মধ্যে যাচ্ছি যাবো করছি বলেই হয়তো।
প্রাণী জগতে যত প্রজাতি আছে, তাদের মধ্যে খুনি তিমি বা অরকা, পাইলট তিমি, আর মানুষ- এই তিন প্রজাতির মেয়েদের মেনোপজ হয়। মেনোপজ হওয়া মানে ঋতুশ্রাব জন্মের মতো বন্ধ হয়ে যাওয়া। অন্য প্রজাতির প্রজননকে এক মৃত্যু এসেই বন্ধ করে। মানুষ প্রজাতির কথাই ধরি, নারীরা মেনোপজ হওয়ার পর দীর্ঘকাল সুস্থ সমর্থ বেঁচে থাকে। বেঁচেই যদি থাকে, তবে প্রজননে অংশ গ্রহণ করবে না কেন? সব বিবর্তনই ভালো বা খারাপ বা কোনও নিরপেক্ষ কারণে ঘটে। নারীর বেলায় মেনোপজের কারণটি কী ছিল? বিবর্তন বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে দীর্ঘকাল গবেষণা করে বের করেছেন ‘দাদি-নানি যুক্তি বা গ্র্যানি হাইপোথেসিস’,  ‘মা যুক্তি’ও আছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় দাদি-নানি যুক্তি।  দাদি-নানি হওয়ার পর নারীরা নিজের জিন-বহনকারী নাতি নাতনিদের খাওয়া দাওয়া সুযোগ সুবিধে ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দিতে পারে। তাতে বংশটা ভালোভাবে বাঁচে। আর বংশের ছোটদের উপকার করায় ব্যস্ত থাকলে নিজের সন্তান জন্ম দেওয়াটা জরুরি হয়ে ওঠে না। আর ঠিক এ কারণেই ঋতুশ্রাব জরুরি হয়ে ওঠে না, এবং এ কারণেই মেনোপজ ঘটে। বিবর্তন প্রক্রিয়া, আমরা জানি, অজরুরি অপ্রয়োজনীয় জিনিস ছেঁটে ফেলে।
সব বিবর্তন-বিজ্ঞানী যে অকাতরে এই হাইপোথেসিস মেনে নেন, তা নয়। তাঁরা বলেন, নিজের বংশ টিকিয়ে রাখার বাসনা প্রত্যেক প্রজাতির জন্মগত। নিজের বংশ টিকিয়ে রাখার জন্য নাতি নাতনিদের দেখভাল করার চেয়ে নিজের সন্তান জন্ম দেওয়াটা প্রজাতিদের মধ্যে অনেক বেশি প্রাধান্য পাওয়া উচিত। তা ছাড়া সন্তানের সন্তানেরা বহন করছে এক চতুর্থাংশ জিন, সে ক্ষেত্রে নিজের সন্তান বহন করছে অর্ধেক। অর্ধেক জিন তৈরি করায় ব্যস্ত না থেকে, অথবা অর্ধেক জিন যার শরীরে, তার জন্য পরিশ্রম না করে, এক চতুর্থাংশের জন্য কেন পরিশ্রম করতে যাবে? এই প্রশ্নটি বড় এক প্রশ্ন। তা ছাড়া নাতি নাতনিদের সেবা যত্ন করেও নিজের সন্তান জন্ম দেওয়া যায়, হাতিই তো তা করে।

‘মা যুক্তি’টা সম্ভবত এরকম---  সন্তান জন্ম দেওয়ার পর সন্তান বড় করতে অনেক খাটা খাটনির প্রয়োজন, এই খাটা খাটনিটা তরুণীদের জন্য যতটা সম্ভব, বয়স বেড়ে গেলে ততটা সম্ভব নয়। সে কারণেই মেনোপজ। না, এই যুক্তির বিরুদ্ধেও তর্ক আছে। 
এখন পর্যন্ত মেনোপজ ঘটার যে যুক্তিগুলো দেওয়া হচ্ছে, কোনটিকেই এক বাক্যে মেনে নেওয়া যায় না। আজকাল মেনোপজ হওয়ার পর জীবনের অর্ধেকটাই প্রায় বাকি রয়ে যায় বাঁচার জন্য। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর প্রজনন ক্ষমতা ছাড়া বেঁচে থাকে বা থাকতে পারে নারী। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির জন্যই এটি সম্ভব হয়েছে। একটা সময় অবশ্য মেনোপজ হওয়ার পর বেশিদিন নারী বাঁচতো না।  কিন্তু তারপরও জীবদ্দশায় এবং সুস্থ অবস্থায় কেন মধ্য বয়সে মানুষের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হবে--- সেটিই আমার প্রশ্ন। এত কোটি কোটি প্রজাতি থাকতে কেন মানুষ আর দুটো তিমি প্রজাতির মেয়েরা মেনোপজে ভোগে?  খুনি তিমি বা অরকার ওপর গত চার দশক যাবত গবেষণা চালিয়ে মাত্র দুদিন আগে বিবর্তন বিজ্ঞানিরা বলেছেন----  খুনি তিমিরাও মানুষের মতো, ঋতুশ্রাব শুরু হয় ওদের ১৫ বছর বয়সে, ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের মধ্যে মেনোপজ হয়ে যায়, বাঁচে ৮০ বছরেরও বেশি।  বেশি বয়সে যে খুনি-তিমিদের বাচ্চা হয়, তাদের বাচ্চা অনেক সময় দেখা যায় মারা যাচ্ছে, অল্প বয়সে যে তিমিদের বাচ্চা হচ্ছে, তাদের বাচ্চা মারা যাচ্ছে না, বরং ভালোভাবে বেঁচে থাকছে। নিজের সন্তানের চেয়ে নিজের নাতিনাতনিদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দেখা যায় বেশি। এই প্রজনন প্রতিযোগিতায় সে কারণে মা-তিমি নিজের মেয়ে-তিমির কাছে হেরে যায়। এটিই মেনোপজ ঘটার বিবর্তনীয় ব্যাখ্যা। অনেক যুক্তিই আগে থিউরির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, এখন আমরা সেসবের প্রমাণ খুঁজে বের করতে পারি।   

বয়স বাড়লে জিন ছড়ানোর ব্যাপারটা  নির্ভুল ঘটা উচিত, কিন্তু মানুষ এবং দুটো তিমি প্রজাতির ক্ষেত্রে কেন এই ব্যাপারটা এমন বিপরীত হলো, তা এখনও জানি না। প্রসঙ্গক্রমে বলি, আমার মা আর আমার নানি একই সঙ্গে গর্ভবতী থাকতেন। দুজনই প্রায় একই সময়ে সন্তান প্রসব করতেন। আমার অল্প বয়সী মা’য়ের কোনও সন্তান মারা যায়নি, আমার নানিরও বেশি বয়সের কোনও সন্তান মারা যায়নি। অবশ্য আমার মা আর আমার নানির ঘটনা বিবর্তনে কোনও ভূমিকা রাখেনি। কিন্তু ভূমিকা রাখার মতো ঘটনা নিশ্চয়ই লক্ষ বছর আগে লক্ষ বছর ধরে ঘটেছিলো।  

মেনোপজের দিকে আমি যাচ্ছি -- আগেই বলেছি। এতকাল যা জানতাম-- শরীরে আচমকা গরম লাগা, অনিদ্রা, কোমরে ব্যথা, খিটখিটে মেজাজ, বুক ধড়ফড় -- এগুলো হয় মেয়েদের। এসবের কিছুই অবশ্য এখনও টের পাচ্ছি না। যৌন-ইচ্ছে নাকি কমে যায় বা উড়ে যায়, আমি অবশ্য এও আমার নিজের মধ্যে মোটেও লক্ষ করছি না। হয়তো এক সময় সবই টের পাবো। ঠিক কী রকম শারীরিক এবং মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে আমাকে যেতে হবে, এখনো বুঝতে পারছি না।

মেনোপজ স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, একে মেনে নাও –এ ধরনের উপদেশ দিতে আজ আমি আসিনি। আমি মনে করি, মেয়েদের মেনোপজ হওয়া উচিত নয়। মেনোপজকে আমি নিতান্তই ‘বিবর্তনীয় দুর্ঘটনা’ ছাড়া আর কিছু বলি না। এই দুর্ঘটনার শিকার আমিও। মেনোপজ হবে বলে আমার শরীরের ইস্ট্রোজেন হরমোন শেষ হয়ে যাবে, সে কারণে আমার হাড়ের ভেতর অসুখ শুরু হবে,  আমার হৃদপিন্ডের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া ছাড়াও, আমার স্তনে, জরায়তে, ডিম্বাশয়ে কর্কট রোগ বাসা বাঁধতে পারে। এক সময় মেনোপজ হয়ে যাওয়ার পর অসুখ বিসুখ থেকে রক্ষা পেতে মেয়েদের ইস্ট্রোজেন হরমোন দেওয়া হতো। এখন আর হয় না। কারণ, দেখা গেছে এই হরমোনটি শরীরে গিয়ে কর্কট রোগ তৈরি করে।

পুরুষকে ভুগতে হয় না এরকম। তাদের শরীরের কোনও হরমোন কোনও কারণে শেষ হয়ে যায় না। তাদের প্রজনন ক্ষমতাও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় না। হরমোন না থাকার কারণে যে অসুখ বিসুখে মেয়েরা আক্রান্ত হয়, সে অসুখ বিসুখে পুরুষেরা আক্রান্ত হয় না। বিবর্তনীয় দুর্ঘটনা পুরুষের বেলায় ঘটেনি। পুরুষের যৌন ক্ষমতা লোপ পাওয়াকে অনেকে ‘পুরুষের মেনোপজ’ বলে, ইরেক্টাইল ডিস্ফাংশান বা উত্থানরহিত অবস্থাকে কোনওভাবেই মেনোপজের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। পুরুষের এই যৌনসমস্যা সমাধান করার উপায় আছে। নারীর মেনোপজের কারণে যে সমস্যাগুলো হয়, সেগুলোর বেশির ভাগই নির্মুল করা বা নিরাময় করা সম্ভব নয়। মেনোপজ নামক দুর্ঘটনারও কোনও সংশোধন অসম্ভব।

যদি আমাদের মেনোপজ না হতো, তাহলে কী হতো? বেশি বয়সি কেউ যদি মা হতো, তবে কি  সন্তানেরা মারা যেতো? না, যেতো না। যেতো না, কিন্তু কোনও এক কালে যেতো বলে আমরা ‘মেনোপজ’ নামক এক অহেতুক উপদ্রব পেয়েছি, যেটি আমাদের হাড়মাংসে রোগশোক দিচ্ছে। বিবর্তন সবসময় ভালো কিছু উপহার দেয়, প্রয়োজনীয় কিছু নিয়ে আসে, তা কিন্তু ঠিক নয়,  অপ্রয়োজনীয় অনেক কিছুও আনে,অবাঞ্ছিত, অহিতকর অনেক কিছুও আনে, যেমন মেনোপজ। 

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ