X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সুন্দর হাতের লেখা নিরাময়যোগ্য সুস্থ জীবন

শান্তনু চৌধুরী
১৮ জানুয়ারি ২০১৭, ১৮:২৯আপডেট : ১৮ জানুয়ারি ২০১৭, ১৮:৩০

শান্তনু চৌধুরী গোপাল ভাঁড়ের কাছে এসে একদিন এক প্রতিবেশী বললেন, ‘আমাকে একটা চিঠি লিখে দিন।’ জবাবে গোপাল জানালেন, ‘আমি চিঠি লিখতে পারবো না, পায়ে ব্যথা।’ প্রতিবেশী আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘চিঠি  তো লিখবেন হাত দিয়ে, পায়ে ব্যথা তাতে কী?’ গোপাল জবাব দিলেন, ‘কারণ আমি অতদূর হেঁটে যেতে পারব না।’ প্রতিবেশী আরও অবাক। ‘অতদূর হাঁটতে পারবেন না মানে?’ এবারও গোপালের সরল জবাব, ‘আমার লেখা চিঠি আমি ছাড়া আর কেউ পড়তে পারবে না। আমার হাতের লেখা খুব খারাপ তো। যাকে চিঠি পাঠাবেন, তাকেতো  আমি গিয়েই পড়ে দিয়ে আসতে হবে, তাই না? পায়ে ব্যথা নিয়ে যাব কিভাবে?’
প্রচলিত কৌতুক দিয়ে লেখাটি শুরু করলাম। যেহেতু এখন সব ছাপিয়ে বাজারে চলতি আলোচনার বিষয় ‘ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন বা ওষুধের ব্যবস্থাপত্র’। বিষয়টি নিয়ে আন্দমুখর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও।
এমনিতে যতই আমরা মুখে ডাক্তারকে ‘দ্বিতীয় ভগবান’ বলে থাকি না কেন, বাংলাদেশি কিছু কিছু ডাক্তারের সীমাহীন অসচেতনতা, অবজ্ঞা আর লোলুপতা সাধারণ মানুষের মনে এতটাই ভীতি ও ঘৃণা তৈরি করেছে যে, আদালতের নির্দেশনাকে তাদের একটি জয় বলেই ধরে নিয়েছেন। উচ্চ আদালত এক নির্দেশনায় চিকিৎসকদের স্পষ্টাক্ষরে পাঠোপযোগী প্রেসক্রিপশন লিখতে বলেছেন। একইসঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন, ত্রিশ দিনের মধ্যে এ ব্যাপারে নির্দেশনা জারি করতে। আদালতে রিটকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেছেন, ‘ডাক্তারদের  লেখা প্রেসক্রিপশন যে অস্পষ্ট থাকে, এটা সবারই জানা। কখনও কখনও ফার্মেসিওয়ালারা পর্যন্ত ঠিকঠাক এসব প্রেসক্রিপশন পড়তে পারেন না। তখন তারা ভুল ওষুধ দিয়ে দেন। যেন ক্ষতিগ্রস্ত হন রোগী।’ বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই নির্দেশনা কতটুকু বাস্তবায়ন হবে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তবে একথা ঠিক যে ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন বুঝতে না পেরে ভুল ওষুধ খেয়ে মারা যাওয়ার উদাহরণ বিরল নয়। কথিত আছে, যে ডাক্তার যত দুর্বোধ্য প্রেসক্রিপশন লেখেন, তিনি তত বড় ডাক্তার। সিনিয়র ডাক্তারদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, তাদের অতিরিক্ত সংখ্যক রোগী দেখতে হচ্ছে, অতিরিক্ত সংখ্যক ব্যবস্থাপত্র লিখতে হচ্ছে, ফলে দ্রুত লিখতে গিয়ে হাতের লেখা খারাপ হচ্ছে। অনেকে আবার সার্জনদের হাতের লেখা খারাপ হওয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন, তাদের মতে, সার্জনরা যে ধরনের কাঁটা-ছেড়ার মধ্যে থাকেন, যে ধরনের জটিল সব অস্ত্রোপচার করেন, তেমন কয়েকটি অস্ত্রোপচার করার পর চেম্বারে ফিরে যখন প্রেসক্রিপশন লিখতে বসেন, তখন ভালো হাতের লেখার জন্য পেশীতে যে ফাইন টিউন থাকা দরকার, তা আর থাকে না। বিষয় যাই হোক, এখন প্রেসক্রিপশনের যুগ। বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করে, ‘সরকার বিদেশের প্রেসক্রিপশনে চলছে।’ আবার সরকার বলে, ‘বিদেশি প্রেসক্রিপশনে কেউ ক্ষমতায় আসতে পারবে না।’ রাজনৈতিক জীবন থেকে শুরু করে ব্যক্তিজীবন সবখানেই এই প্রেসক্রিপশনের জয় জয়কার। বেশ সহজপ্রাপ্য। যেখানেই যান না কেন কোনও না কোনও বিষয়ে প্রেসক্রিপশন পাবেনই।

সংবাদপত্র, টিভি, বক্তৃতা, বিল  বোর্ড, লিফলেট, পরিবারের মুরব্বি, পাড়ার দাদা থেকে শুরু করে প্রেমিক বা প্রেমিকা দিয়ে যাচ্ছে নানা রকমের প্রেসক্রিপশন। মাছ, মাংস, সবজি, চালের  দোকান থেকে কাঁচাবাজার সবাই নিজের জিনিসকে ‘এক নম্বর’ ‘খাঁটি’ বলে তাদের নিজ নিজ সামগ্রী কিনতে প্রেসক্রিপশন দেবেন। তবে মজার বিষয় এসব প্রেসক্রিপশনে ভুল-ভ্রান্তি থাকলে বড় ধরনের সমস্যা হয় না। কিন্তু ডাক্তারের বিষয়টা একেবারে আলাদা। একজন মানুষ নিজের রোগযন্ত্রণার কথা অবলীলায় অনেক সময় আপনজনকে বলতে পারেন না, কিন্তু বলেন ডাক্তারকে। আশা করেন, ডাক্তার মুক্তির পথ দেখাবেন। কিন্তু সেই আশা যদি বিপদ ডেকে আনে, তবে? সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি ঘটনা এমন, হৃদরোগের জটিলতা নিয়ে রাজধানীর একজন নামকরা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন পঞ্চাশোর্ধ এক লোক। ওষুধ লেখার পাশাপাশি চিকিৎসক প্রেসক্রিপশনের নিচে  লেখেন ‘নো স্মোকিং’। কিন্তু ইংরেজিতে অগোছালো ও বিশৃঙ্খলভাবে লেখা এই  ছোট বাক্যটি এমনই জটিল হয়ে উঠেছে যে, লোকটি তা বুঝতেই পারেননি। বেশকিছু ফার্মেসির বিক্রেতারাও এটিকে ওষুধ ভেবে ভুল করেন। বিভিন্ন এলাকার ওষুধ বিক্রেতা তাকে জানান, এ ধরনের ওষুধ তাদের কাছে নেই। শেষে রাজধানীর কলাবাগানের একটি ফার্মেসির একজন ব্যবস্থাপক লোকটিকে ভুলটি ধরিয়ে দেন। তিনি জানান, লেখাটি কোনও ওষুধ নয়, ওষুধ সেবনের পাশাপাশি ধূমপান না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’ তেমনি আরেকটি গল্প বলি। (এমন গল্প অবশ্য হাজার হাজার) এক ব্যক্তি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে গেলেন চিকিৎসার জন্য। ডাক্তার প্রেসক্রিপশন দিলেন। সেখানে লেখা কয়েকটি ওষুধের নাম অতিকষ্টে বের করা গেলেও একটির নাম কেউই বুঝতে পারছিল না। কয়েকটি ফার্মেসি ঘোরার পর শেষে একজন বললেন, ‘দেখেন আঙ্কেল, তিনি যে কী লিখেছেন, তিনিই জানেন। আপনি বরং তার কাছ থেকে জেনে আসেন।’ ব্যক্তিটি আবার চেম্বারে ডাক্তারের কাছে গেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘স্যার এই ওষুধের নামটা কী লিখছেন, কেউ বুঝতে পারছে না!’ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কয়েক মিনিট ভেবেও বের করতে পারলেন না তিনি কী লিখেছেন। এরপর তিনি ওই ব্যক্তিকে বললেন, ‘আসলে এই ওষুধটা দরকার নেই, আপনি বরং এই ওষুধটা খান’ বলে আগেরটা কেটে নতুন আরেকটা নাম লিখে দিলেন। এই হচ্ছে নমুনা। সে কারণে আদালতের নির্দেশনায় সবাই বেশ পুলকিত। কারণ কিছু কিছু পেশা আছে, যেখানে ভুল করা চলে না। একথা ঠিক, আমাদের জনসংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে ডাক্তারদের অনেক বেশি রোগী দেখতে হয়, অনেক বেশি প্রেসক্রিপশন লিখতে হয়। তাই বলে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলে না। কারণ একই ওষুধের একাধিক ব্যান্ড রয়েছে। যেমন প্যারাসিটামল ভিন্ন নামে রয়েছে এইস, এসেপ, এসেটা, এসেটো, এসেটোপেন, এক্ট, একটল, এনালপেন, আরচি, এসমল, এসটা, এটোপেন, এটিপি,  সেন্টামল, সেটাডল, সেটাল, সেটাম, সিপিমল, ডি-সিটামল, ডেপল,  ডেপাইরিন,  ডোলা, এনাইল, ফ্যাপ, ফাস্ট, ফিয়া, ফেভা, ফিবি,  ফেবাক,  হেপা, লংপারা, নাপা, নিপা। এক এক কোম্পানির এক এক নাম। ডাক্তারকেই নির্দিষ্ট করে দিতে হবে রোগী কোনটা খাবে। তবে সেক্ষেত্রে ফার্মাসিস্টদেরও দায়িত্ব রয়েছে। সে কারণে সরকার ‘আদর্শ ফার্মেসি’ ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে, যেখানে অনন্ত একজন পাস করা ফার্মাসিস্ট থাকবে। কারণ প্রেসক্রিপশন না বোঝার কারণে সারাবিশ্বে মরছে মানুষ।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি বছর শুধু আমেরিকাতেই প্রায় ১৫ লাখ রোগী অসুস্থ হন প্রেসক্রিপশন-ঘটিত বিভ্রান্তির কারণে। আর সারা বিশ্বে সাত হাজার মানুষ মারা যান প্রেসক্রিপশন বুঝতে না পারার পরিণামে। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছে আমেরিকার ইনস্টিটিউট অব মেডিসিন (আইওএম)। তাদের সমীক্ষা মতে, ডাক্তাররা রোগীদের প্রতি যে নির্দেশ দিয়ে থাকেন প্রেসক্রিপশনে, সেগুলো বুঝতে প্রায়শই ভুল করেন রোগীরা। এই ধরনের নির্দেশ দেওয়া হয় মূলত ওষুধ খাওয়ার নিয়ম ও পরিমাণ বোঝানোর জন্য। কিন্তু ডাক্তারদের খারাপ হাতের লেখার কারণে এই নির্দেশিকা বুঝতে ভুল করেন রোগীরা। যে ওষুধ দিনে দু’বার খাওয়ার কথা তা সপ্তাহে দু’বার খেয়ে বসেন, বা সকালের ওষুধ খান রাতে। এর ফলে রোগী সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সমস্যার সমাধানে আমেরিকায় ‘নেপসি’ নামের একটি প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে। এর সাহায্যে ডাক্তাররা হাতে লেখার পরিবর্তে ইলেকট্রনিক প্রেসক্রিপশন লেখার সুবিধা পান। আমাদের দেশে এই জাতীয় প্রোগ্রাম কবে চালু হয় সেটাই এখন দেখার। তবে কোথাও কোথাও প্রিন্টেড প্রেসক্রিপশনও দেওয়া হয়।

প্রেসক্রিপশনের কারণে কোনও মৃত্যু কারও কাম্য হতে পারে না। তাই আদালতের নির্দেশনা যেন মেনে চলে, সে ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে। তবে এটি বেশ কঠিন কাজ। কারণ আমাদের দেশের ডাক্তাররা তাদের স্বার্থে সামান্য আঘাত এলেই রোগীদের জিম্মি করে একযোগে আন্দোলনে নেমে পড়েন। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায় না! নিজের ও অনেকের অভিজ্ঞতা শুনে জেনেছি, বেশিরভাগ ডাক্তারের আচরণও কতটা খারাপ হয়। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেতু নামে এক নারী লিখেছেন, ‘এক নামকরা হাসপাতালে গেলাম গাইনি ডাক্তারের কাছে। জিজ্ঞেস করলেন সমস্যা কী? আমি বললাম, পিরিয়ড হচ্ছে না গত প্রায় দুই মাস। তিনি বললেন, বাচ্চাকাচ্চা কয়টা? আমি বললাম, একটি। তিনি বললেন, আর নেবেন? আমি বলি, ‘না’। তিনি খস খস করে প্রেসক্রিপশন লেখার সময় বললেন, তাহলে আর পিরিয়ড দিয়ে কী করবেন? এত বড় ডাক্তার আমাকে একথা বলে খালাস। সেদিন মনে হয়েছিল তিনি তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুব ঝালেমায় আছেন। সারাদিন রান্নাবাড়া, পোলাপান দেখা, জামাই দেখা, নিজের প্রাইভেট ক্লিনিক নিয়ে তার লেজেগোবরে অবস্থা। চরম সত্য আর এক অভিজ্ঞতা হলো আমি যত নারী ডাক্তার এর কাছে গেছি সবারই বিরক্তি ছিল চোখেমুখে।

আমরা ডাক্তারের কাছে বিরক্তি নয়, হাসিমুখে আন্তরিক সেবা পেতে চাই। কারণ এর জন্য অর্থ দেওয়া হচ্ছে। সরকারি হাসপাতাল হলে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। কারণ একজন ডাক্তারের হাসিমুখে আন্তরিক ব্যবহার, সেবায় কুশলতা আর নির্ভুল প্রেসক্রিপশন অর্ধেক আরোগ্য এনে দিতে পারে রোগীর। সে কারণেই হয়তো স্কুলজীবনে হাতের সুন্দর লেখার জন্য আলাদা নম্বর ছিল।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক 

[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ