X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য ও চ্যালেঞ্জ

শুভ কিবরিয়া
১৯ জানুয়ারি ২০১৭, ১৭:২৯আপডেট : ১৯ জানুয়ারি ২০১৭, ১৭:৩১

শুভ কিবরিয়া এখনও প্রায়ই জঙ্গিবাদের অভিযোগে অভিযুক্তরা ধরা পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময়  জঙ্গিদের ধরছে। গুলশানে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপারেশনে, কথিত বন্দুকযুদ্ধেও মারা গেছে অনেক জঙ্গি। যেসব জঙ্গিকে আমরা ‘স্টার’ খ্যাতি দিয়েছি, তাদের অনেকেই এই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। এই হিসেবে ধরলে জঙ্গিদমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাফল্য বহু। আবার, উল্টোভাবে ভাবলে, বা জনভাবনায় ওঠা প্রশ্নগুলোকে আমলে নিলে এ বিষয়ে নানা সন্দেহ, আশঙ্কাও মনে জাগে। যেসব জঙ্গি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে, তাদের অনেকের পরিবারের অভিযোগ নিহত ব্যক্তিকে বহু আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে।
জঙ্গি দমনের এই প্রক্রিয়ায় দু’টি ঘাটতি আছে। এক. পরিবারের এসব অভিযোগের কোনও সুরাহা দেয়নি রাষ্ট্র। দুই. স্টার জঙ্গিদের শেষ পর্যন্ত বেসামরিক আদালতে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তাদের মুখ থেকে আদালতেও জানা সম্ভব হয়নি কেন তারা জঙ্গি হলো। কে তাদের এই আত্মঘাতী প্রবণতায় ঠেলে দিলো। তাদের অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ ও আশ্রয় কাদের প্রশ্রয়ে?—এসব প্রশ্নের উত্তর জানা সম্ভব হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত, প্রেস কনফারেন্স যেসব তথ্য দিয়েছে, তা নিয়ে আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। সংকটের গভীরে যাওয়ার মতো তথ্য এখনও সমাজের সামনে উন্মোচিত হয়নি। এসব প্রশ্ন বাদ দিলে বলা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গি দমনে সাফল্য নিশ্চয় প্রশংসার দাবিদার।
জঙ্গি দমনে কিংবা সন্ত্রাস দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও প্রসারও বেড়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোটের সময় সন্ত্রাস দমনে র‌্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে ব্যয় বেড়েছে। সরকারও এ বিষয়ে মনোযোগ দিয়েছে। জঙ্গি দমনে এই সামরিকীকরণ প্রক্রিয়া যত বেড়েছে, জঙ্গিবাদের বিস্তারও ততই বেড়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোটের সময় বাংলাভাইরা জেলায় জেলায় বোমাবাজি করেছে। এখন হলি আর্টিজানের মতো হামলার সক্ষমতা দেখিয়েছে মারজান-নিবরাস।
দুই.
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তরুণদের একটি অংশ জঙ্গিপনায় যাচ্ছে কেন? আগে ভাবা হতো অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরাই এই প্রবণতায় ঝুঁকছে। হালে দেখা যাচ্ছে, এই তথ্য পুরোপুরি ঠিক নয়। যারা ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ছে, যাদের আর্থিক সচ্ছলতা আছে, এ রকম তরুণদের অংশগ্রহণও আছে জঙ্গিবাদী প্রবণতায়। জঙ্গিবাদে অংশ নেওয়া তরুণদের মুখ থেকে আমরা খুব বিস্তারিতভাবে জানতে পারিনি, তাদের এই কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে কোন বিষয়টি উদ্দীপনা প্রণোদনা যুগিয়েছে। তবে, বাংলাভাই আমলের দুই-চারজন যারা জঙ্গিবাদের অভিযোগে আদালতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল, তারা বলেছে, তারা এই প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে মানে না। এই  সরকার ব্যবস্থাকে তারা অস্বীকার করে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তারা এই প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা চায় না? কেন প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা তাদের ক্ষুব্ধ করছে। কেন তারা এই প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে। এই প্রশ্নের উত্তর আন্তর্জাতিক পর্যায়েও খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। কেননা, জঙ্গিবাদ এখন আর কোনও স্থানীয় সমস্যা নয়। এর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলও সুবিস্তৃত। পৃথিবীর দেশে দেশে অনেক তরুণ সুখ-সাচ্ছন্দ্য আর নিশ্চিত জীবন ছেড়ে এই ভয়াবহ প্রবণতায় জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, এই তরুণরা ক্ষুব্ধ। কারণ, তারা বৈষম্যের শিকার। তারা অবিচার বা ইনজাসটিসের শিকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, কর্মসংস্থানের বৈষম্য তো আছেই বর্ণবাদ, সুশাসনের অভাব, গণতন্ত্রের নামে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাও তাদের ক্ষুব্ধ করছে। তারা ভাবছে প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই অবিচারের কোনও সুরাহা নেই। তখন তারা অস্ত্র হাতে নিয়ে জীবনকে তুচ্ছ করে এই ভয়ঙ্কর প্রবণতায় জড়িয়ে পড়ছে। কাজেই জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় শুধু সামরিক প্রচেষ্টাই একমাত্র দাওয়াই নয়, এর বহুমান্ত্রিক দাওয়াই খুঁজতে হবে।

তিন.

বাংলাদেশে তরুণরা জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে কেন? এই প্রশ্নের বহুমাত্রিক সামাজিক বিশ্লেষণ হয়নি। তবে একথা ঠিক রাজনীতি, রাষ্ট্রশাসন আমাদের জীবনে কোনও সুস্থিত সমাধান দিতে পারেনি। প্রবৃদ্ধির অঙ্কের উন্নতি আছে বটে কিন্তু মানুষে মানুষে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য দিনকে দিন বাড়ছেই কেবল। কোথাও সামাজিক সুশাসন ও সুবিচারের নিশ্চয়তা নেই। এটা একটা দিক। অন্যদিকে বাংলাদেশের জনসমাজের ভেতর নৃতাত্ত্বিকভাবে কিছু সংকট অন্তর্নিহিত আছে। অনেক স্ববিরোধিতা আছে আমাদের জাতিরাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার ভেতর।

জাতীয়তাবাদী ভাবনায় আমরা যতটা আবেগাপ্লুত হই, রাষ্ট্র হয়ে ওঠার লড়াইয়ে আমরা ততটা সজীব নই। রাষ্ট্র ঠিক আমরা বুঝতে চাই না। ব্যক্তিকে যতটা বুঝি রাষ্ট্রকে ততটা বুঝতেও চাই না। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমাদের বাঙালিদের মধ্যে দুটি দিক আছে। একটা হলো আমরা মুসলমান আর একটা হলো আমরা বাঙালি। পরশ্রীকাতরতা ও বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে।’ বাংলাদেশ নিয়ে নানা রকম বই লিখেছেন বিদেশিরা। বিদেশিদের পর্যবেক্ষণেও ধরা পড়েছে বাঙালিদের নানান স্ববিরোধী প্রবণতা। লরেন্স জিরিং নামের এক বিদেশি বাংলাদেশ বিষয়ক তার বই শুরুই করেছেন, Bangladesh is a country challenged by contradictions বাক্য দিয়ে। কাজেই আমাদের নৃতাত্ত্বিক দুষ্টক্ষতগুলোও আমাদের নানারকম দুর্ভাবনার কারণ।

চার.

বাংলাদেশের রাষ্ট্রিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উপাদানের প্রবণতার দিকে তাকালে আমরা পরস্পরবিরোধী নানান প্রবণতা দেখতে পাব। আমাদের বড় দুই রাজনৈতিক দল একদম বিপরীতমুখী প্রবণতায় আস্থাশীল। এখানে গণজাগরণ মঞ্চের যেমন বিকাশ ঘটেছে, ঠিক তেমনি হেফাজতের উত্থানও আমরা দেখেছি। আমাদের রাজনীতির মধ্যেও নানা মাত্রায় উগ্রবাদের ছোঁয়া আছে। বাম-ডান দুই পাশেই এই উগ্রবাদকে আমাদের রাজনীতির মধ্যে আমরা পেয়েছি। এই পরস্পরবিরোধী বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে আমরা ইস্যুভিত্তিক জাতীয় ঐকমত্যের ক্ষেত্রে এক টেবিলে বসতে পারিনি। আমাদের সব ধরনের জঙ্গি আচরণের পেছনে এসব সংঘাতময় পরস্পরবিরোধী প্রবণতাও ইন্ধন যুগিয়েছে।

বাংলাদেশের জঙ্গিবাদী ফেনোমেনা এখন ধর্মের রঙে জায়গা নিয়েছে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রবণতাও একে আলো-বাতাস-হাওয়া দিয়েছে। এই প্রবণতা রুখতে তাই সামাজিক উদ্যোগ এবং জনজাগরণ খুব জরুরি।

জনজাগরণ চাইলে গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ ছাড়া বিকল্প নেই। যারা ভাবেন কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন সমাজের এই দুষ্টরোগ সারাবে তারা ভুল বিবেচনায় আচ্ছন্ন। গণতান্ত্রিক সমাজ বিকশিত না হলে, রুদ্ধ পরিবেশে জঙ্গিবাদ আরও বীভৎস হয়ে দেখা দিতে পারে। জঙ্গিবাদ দমনের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, সেই মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা। সামরিক উপায়ে জঙ্গিবাদ মোকাবিলার পথ রাষ্ট্রকে খোলা রাখতে হবে কিন্তু সেটাকেই একমাত্র পথ ভাবলে চলবে না। গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনকে উপেক্ষা করে সশস্ত্র পথেই এই সংকটের মোকাবিলা করতে চাইলে সেটা সঠিকপথ হবে না। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ফ্রন্টেও এই ভয়ঙ্কর বিপদের বিরুদ্ধে সংগ্রামটা জারি রাখতে হবে।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ