X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রবাদ: নারী ও পুরুষ

বিথী হক
২০ জানুয়ারি ২০১৭, ১৪:২৪আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০১৭, ১২:৫০

বিথী হক (১) যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে
(২) নাও, ঘোড়া, নারী, যে চড়ে তারি
(৩) লজ্জা নারীর ভূষণ
(৪) সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে, রমণী সুন্দর হয় সতীত্ব রক্ষণে
(৫) ভাই বড়ধন রক্তের বাধন, যদিও বা পৃথক হয় নারীর কারণ
(৬) রান্ধি বাড়ি যেবা নারী, পুরুষের আগে খায়, ভরা কলসীর জল তার তরাসে শুকায়
খুব কম মানুষই আছেন, যারা এসব বাংলা প্রবাদের সঙ্গে পরিচিত নন বা জীবনে কখনও এসব শোনেননি। ছোটবেলায় প্রায় প্রতিটি বাড়িতে রঙিন কাপড়ে বিভিন্ন ফুল-পাতার নকশায় সুঁই-সুতোয় পরিপাটি করে সেলাই দিয়ে এসব লেখাকে ঘিরে, বাড়তি মর্যাদা দিয়ে ঘরের দেয়ালে টানিয়ে রাখা হতো। হতো বলা ভুল, এখনও গ্রামের অনেক বাড়িতে আভিজাত্যের সঙ্গে-সঙ্গে এসব ওয়ালম্যাট পথ প্রদর্শকের মতো দিক নির্দেশনার কাজে নিয়োজিত। পরিবারের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই এসব লেখাকে শ্রদ্ধার এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে, কেয়ামত হয়ে গেলেও কেউ এর বিচ্যুতি ঘটাবেন না।

আসেন জানি এসব প্রবাদ কাকে কোন চোখে দেখছে বা দেখাচ্ছে। আপনি দেবী দুর্গা, দশ কাজ একা সামলানোর যোগ্যতা আপনার আছে এবং থাকতেই হবে। আপাতৎদৃষ্টিতে চুল বাঁধার কথা না থাকলেও চুল বাঁধার কাজ এবং রান্না দুটোই যেহেতু নারীর কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সুতরাং এই প্রবাদটি যে নারীর উদ্দেশ্যেই লিখিত, তাতে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়। পরের লাইনের প্রবাদে আপনাকে বস্তুগত সুলভপণ্য বা ব্যবহারযোগ্য উপকারী পদার্থ হিসেবে ইঙ্গিত করা হচ্ছে। নারীর জায়গায় পুরুষ দিলে প্রবাদটির ছন্দপতন ঘটে এবং নাও, ঘোড়া এবং পুরুষ কোনোটাই সম্ভবত নারীর চড়ার জন্য তৈরি হয়নি। তামাম দুনিয়া ১ম লিঙ্গের (পুরুষের) জয়জয়কার করে, নারীর মতো ২য় লিঙ্গের প্রাণীর এখানে কোনও কাজ নেই। সুতরাং, নীরবতাই প্রশান্তি! আহা! 

এবার লাইনে আসি, এতক্ষণ বিশাল সময় নষ্ট হয়ে গেছে, এসব ছোটখাটো বিষয়ে নাক গলানোর মতো সময় কারও আছে নাকি! সংসার হচ্ছে নারীর সমার্থক শব্দ প্রায়। প্রাপ্তবয়স্ক দু’জন নারী-পুরুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে কোমর বেঁধে জীবন-যুদ্ধে লেগে পড়াকে আপাতদৃষ্টিতে সংসার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করলেও সংসার সুখের হয় এক এবং একমাত্র উপাদান রমণীর গুণে। অন্য প্রসঙ্গে যেতে চাই না, তবু রমণী শব্দে আমার ঘোরতর আপত্তি আছে, সেটা এই লেখায় আর না বলি। যাই হোক, তো সে স্বামী বেচারার আসলে সংসারে কোনও দরকার নেই, ঘরের বাইরে তার একটা বিশাল জগৎ আছে। অন্যদিকে ‘রমণী’ হচ্ছে রমণীয়, তাকে রমণীয়ই হয়ে থাকতে হবে। স্বামী-সন্তান-শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য রান্নাবান্না থেকে কাপড় কাচা সব করতে হবে, কাজ শেষে চোখ টানা টানা করে কাজল দিতে হবে, পরিষ্কার তথা স্বামীদেবের চোখ জুড়ায়, এমন পোশাক পরতে হবে। তারপর যতই রাত হোক না কেন তার জন্য না খেয়ে তার খাবার পাহারা দিতে হবে। তো এই না করলে সংসার আসলে সুখের হয় না। এই সুখ নিশ্চিতকরণের জন্য তাই নারী কোনোভাবেই দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। এই দায় অবশ্য এখানেই শেষ হতে পারতো কিন্তু রমণী কিসে সুন্দর হয়, সেটাও তো জানতে হবে। ‘রমণী সুন্দর হয় সতীত্ব রক্ষণে’, কী বুঝলেন? আপনি সতী তো?

এ রকম প্রচুর বাংলা প্রবাদ আছে, যা নারীকে শুধু অসম্মানিতই করে না বরং তাদের সরাসরি ভোগ্যপণ্যের কাতারে ফেলে মৌলবাদী পুরুষতন্ত্র গোকূলে বেড়ে চলে। প্রবাদকে শুধু প্রবাদ বলে হাসি-তামাশা করে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর মাধ্যমে যে কোনও জাতির  ইতিহাস, বিবর্তন ও মানসিকতার প্রকাশ ঘটে। আদিকাল থেকে নারীর প্রতি সমাজের যেমন ধারণা, তাদের নিয়ন্ত্রণ করার যে কৌশল, তা যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়েছে, যুগোপযোগী বানানো হয়েছে। শিক্ষিত ও অশিক্ষিত দু’শ্রেণির মানুষই এখানে এসে এক কাতারে দাঁড়িয়েছেন। নিজের অজান্তে কিংবা সচেতনভাবেই এসব ধ্যাণ-ধারণার প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করছেন। তাদের নিজেদের স্বার্থে কেউ বের করে আনছেন না এবং তারা নিজেরাও হাজার বছরের ঐতিহ্য বিনষ্ট করে নিজেকে বেহায়া জাহির করতে এখান থেকে বের হয়ে আসতে চান না।

উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তসহ সমাজে বিদ্যমান সব বিত্তের লোকজন এই এক জায়াগায় এসে এক হয়ে যান।  টাকাপয়সার ভিত্তিতে বা শিক্ষার ভিত্তিতে; যে ভিত্তিতেই মাপা হোক না কেন, তাদের মানসিকতা এক ও অভিন্ন।  প্রত্যেকের বাড়িতে পুরুষ সদস্যদের খেতে বসিয়ে নারীরা হাতে পাখা, তরকারির বাটি, ভাতের গামলা ইত্যাদি নিয়ে ছুটোছুটি করতে হয়। নারী সদস্যদের ক্ষুধা লাগলে বা না লাগলেও নিতান্ত ইচ্ছে হলেও পুরুষদের আগে বা তাদের সঙ্গে একই টেবিলে যে খেতে বসা যায়, এ কথা ঘূর্ণাক্ষরেও চিন্তা করতে পারেন না (শহরের একক পরিবারের কথা আলাদা)।পুরুষ মানেই পৃথিবী উল্টে যাক, সে সবকিছুতেই সবার আগে। এই চিন্তাকে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, এমন পর্যায়ের চিরন্তন বানিয়ে ফেলা হয়েছে। সুবিধা-অসুবিধার কথা চিন্তা করলে সুবিধাবাদী পুরুষতন্ত্র এবং অন্ধ মৌলবাদী পুরুষরা ফেঁসে যাবেন।

ওপরের প্রত্যেকটি প্রবাদ-প্রবচন নারীকে খাটো করে দেখে, যা সর্বজন গৃহীত। কিন্তু আশার কথা হলো শফী হুজুর যখন নারীদের তেঁতুল বলেন, তখন কে কোন লিঙ্গের, তা ভুলে গিয়ে নারী পুরুষ সবাই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। মজার মজার ট্রল বানিয়ে শফী হুজুরের নাম পাল্টে তেঁতুল হুজুরে পরিণত করেছিল। ইতিহাস বলে তেঁতুল হুজুর নারীদের তেঁতুল বলেছিলেন ঠিকই, তবে এই সারিতে তিনি একলা নন। অনেক মহাপুরুষ, মনীষীও নারীকে লুতুপুতু প্রেমিকার ভূমিকায় খেলতে নামিয়ে, তাকে কিঞ্চিত দয়া-মায়া-স্নেহ দেখিয়ে  যাচ্ছেতাই লিখে গেছেন লাইনের পর লাইন। অবশ্য প্রশংসাও কম করেননি, কিছু পেতে হলে তো কিছু দিতেই হবে। সে রকম কিছু লাইন তাহলে দেখা যাক:

নারী জাতি যুক্তি বোঝে না ওরা সর্বক্ষেত্রে কেঁদে জিততে চায়: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

দুনিয়ার সবচেয়ে মস্ত হেঁয়ালি হচ্ছে মেয়েদের মন:  কাজী নজরুল ইসলাম

নারীরা সৌন্দর্যের প্রতীক যেমন, তেমনি নির্বুদ্ধিতারও প্রতীক: কনরাডে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু আমার নন, অনেক নারীরই যৌবনে ভেসে যাওয়া বইয়ের প্রেম। সেই ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, এমনকি কনরাডের মতো ব্যক্তিরা যদি নারীকে এমন খাটো আর হীন করে আরেকজনের কাছে তুলে ধরেন, তো বাঙালি কেন বরং তামাম দুনিয়ার মানুষেরই চোখ বন্ধ করে সে কথা মেনে নেওয়ার যুক্তি আছে। ‘আমি আর কী বললাম, রবীন্দ্রনাথই  নারীকে মানে তোমাকে নিয়ে এসব বলেছেন’—এমন অদ্ভুত কথা শোনার জন্য আমিসহ প্রত্যেক মেয়েরই প্রস্তুত থাকা উচিত। অনেকেই বলবেন, একটি নির্দিষ্ট অংশের, নির্দিষ্ট চরিত্রের বা নির্দিষ্ট সময়ের বর্ণনার উদ্দেশ্যেই হয়ত তারা এমন সব কথা বলেছেন। দুঃখিত,  বর্তমান কাল ব্যবহার করা এসব বাক্য নির্দিষ্ট কোনোকিছু বর্ণনার জন্য হতে পারে না। আপনার যা খুশি ভাবার অধিকার আছে, তাই ভাবেন, আমি অন্তত এমন কিছু ভাবতে পারব না।

অতীতে প্রবাদ-প্রবচন দ্বারা মানুষ যতটা প্রভাবিত হতো এখন নিশ্চয়ই অনেকে এসব প্রবাদের ব্যবহার তো দূরের কথা, অর্থই জানে না। কিন্তু নারীকে নরম ভাবার মতো বিষয় থেকে বেরিয়ে আসতে হলে যে আরও কয়েক শ বছর নিঃশ্বাস বন্ধ করে বাঁচতে হবে, সে বিষয়ে নারীদের সংশয় নেই। আজকের পুরুষ সম্প্রদায় এখন অনেক আধুনিক, অনেক আধুনিক পুরুষতন্ত্রেরই শিকার বাবা, ভাই, মাসহ সবাই। তাদের আধুনিকতার সঙ্গে-সঙ্গে প্রবাদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে আরও নতুন নতুন মাধ্যম। আগে প্রবাদ দিয়ে জাতির ইতিহাস, বিবর্তন, সংস্কৃতি জানা যেত, এখন জাতির ইতিহাস, বিবর্তন, সংস্কৃতি দিয়ে প্রবাদ চেনা ও জানা যায়।

এসব প্রবাদ পাল্টানোর সময় এসেছে। এই কাজটা অন্তত আমাদের বাবা, ভাই আর প্রেমিকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করা উচিত। মানে এই নারীর ক্ষমতায়ন বা নারীর অধিকার আদায়ের এই আন্দোলন শুধু নারীদের একার নয়। নারীবাদ শব্দটিও লৈঙ্গিক বিভেদ তৈরির জন্য নয়। পুরুষতন্ত্রের শিকার যেমন নারী-পুরুষ উভয়ই হন সুতরাং এসব প্রবাদেও তারা দু’শ্রেণিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ইতিহাস থেকে এসব প্রবাদ হয়ত মোছা যাবে না। কিন্তু জীবনই যদি বদলে যায়, প্রবাদও বদলে যাবে; সঙ্গে বদলাবে প্রবাদের ইতিহাস। পাশাপাশি থাকবে ইতিহাসের নতুন আর পুরনো প্রবাদগুলো।

লেখক: সাংবাদিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ