X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা হকারমুক্ত হবে?

মোস্তফা হোসেইন
২৩ জানুয়ারি ২০১৭, ১২:১১আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০১৭, ১২:১৬

মোস্তফা হোসেইন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র কি পারবেন জয়ী হতে? কঠিন খেলায় নেমেছেন তিনি। সাম্প্রতিক ব্যবস্থায় গুলিস্তানের ফুটপাত এখন মানুষের পথচলায় নির্বিঘ্ন সুবিধা পাচ্ছে। এমনটা দেখে যারা তৃপ্তি পাচ্ছেন, তারাই আবার প্রশ্ন করছেন, এই পরিচ্ছন্নতা কতদিন স্থায়ী হবে।
বুলডোজারের পরিচ্ছন্নতা অভিযান দেখে মানুষের সংশয় কেটে যাওয়ার কথা। টিভি ক্যামেরার সামনে নগরপ্রধানের দৃঢ়তার ছবি দেখে অনেকেই ভাবতে পারেন, নিশ্চয়ই সফল হবেন তিনি। কিন্তু যে মুহূর্তে উচ্ছেদকৃত হকারদের মিছিল রাজপথ কাঁপিয়ে দেয়, যখন সেই মিছিলের লোকগুলোর সঙ্গে সুর মেলান সরকারের সহযোগী দলের এমপি শিরীন আক্তার কিংবা কিছু কথিত সচেতন মানুষ, তখন প্রশ্নটা অন্যদিকে মোড় নিতেই পারে? আবার বুলডোজারের পেছনেই যখন হকারদের রাস্তায় বসে পড়তে দেখা যায় তখনও মনে হয়, কী হবে এর পরের পরিস্থিতি? মনে রাখা প্রয়োজন যারা এখন অবৈধভাবে ফুটপাত দখলদারদের পক্ষে বলছেন তারাই আবার একটু পর বলবেন, সরকার কিংবা সিটি করপোরেশন রাজপথ হকারমুক্ত করতে ব্যর্থ।
অন্যদিকে হকারদের মুখ থেকে যখন শোনা যায়, একেকটি এলাকায় দোকান বসানোর জন্য সিটি করপোরেশনের কিছু অসাধু কর্মচারী-কর্মকর্তাকে লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়, তখন কিন্তু মেয়র মহোদয়ের দৃঢ়তা আমাদের আশ্বস্ত করতে পারে না। কারণ সিটি করপোরেশনে মেয়র একজন আর অসাধু কর্মচারী অনেক। এই মুহূর্তে মেয়র মহোদয়কে সফল হতে হলে ঘরে বাইরেই সংগ্রাম করতে হবে। যতক্ষণ ঘর ঠিক না করা যাবে ততক্ষণ কি তিনি সাফল্য চিন্তা করতে পারবেন?
এই মুহূর্তে বুলডোজার দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করার পর লাখ টাকার বিনিময়ে যখন এই হকাররাই আবার ফুটপাতগুলো দখল করবে তখন কী করবেন তিনি? প্রায় ৩০০ বর্গ কিলোমিটার রাজধানীর ২২০০ কিলোমিটার রাস্তার ফুটপাত পাহারা দিয়ে রাখাও কি সম্ভব একা সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে। একদিকে ধাওয়া খেয়ে আরেকদিকে গিয়ে ওরা বসবেই। তাদের লক্ষই সরকারি জায়গা দখল করা।
একটা উদাহরণ দিলে স্পষ্ট হবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের খিলগাঁও এলাকার ফুটপাত থেকে হকারদের উচ্ছেদ করা হলো কয়েক মাস আগে। ওখানেও বুলডোজার চালানো হয়েছিল। উচ্ছেদকালে মানুষ মন্তব্য করেছে, কয়েকদিনের মধ্যেই আবার ফুটপাতগুলো বেদখল হয়ে যাবে। যেমনি আগেও হয়েছে। অবাক হওয়ার মতো ঘটনাই বলতে হবে। এই এলাকায় ফুটপাতে দোকান এখনও বসেনি আগের মতো। তাহলে ফুটপাতের দোকানগুলো কি গ্রামে ফিরে গেছে?

বাস্তবতা হচ্ছে, ওরা চৌধুরীপাড়া ঝিল মাঠে বাজার বসিয়ে দিয়েছে। ঝিল ভরাট করে সেখানে তৈরি হয়েছিল খেলার মাঠ। না এমন ভাবার কারণ নেই, ওরা শুধু এখানেই বসে আছে। ওদের উচ্ছেদ করার আগে তাদের ছিল একটি দোকান, উচ্ছেদের পর এখন ওরা দুটি করে দোকানের মালিক হয়েছে। খেলার মাঠে চৌকি বসিয়ে দোকান করার পাশাপাশি ভ্যান গাড়িতে করে গলিতে গলিতে দোকান চালাচ্ছে একইসঙ্গে।

তাই উচ্ছেদের কারণে তাদের উন্নতি হয়েছে। আর চাঁদাবাজদেরতো পোয়া বারো হয়েছেই। ওরা এখন বাজার থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করছে আবার ভ্যান গাড়ি থেকেও আদায় করছে। পথচারী ও গাড়ি চলাচলে সুবিধা হয়েছে সামান্য।

প্রশ্ন হচ্ছে, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে যে অভিযান চলছে সেখানেও তেমন কিছু হবে কিনা। ইতোমধ্যে হকারদের সন্ধ্যায় দোকান চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সেটা যদি তারা মেনেও নেয়- তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য ঘড়ি নিয়ে কে বসে থাকবে? সিটি করপোরেশনের কোনও কর্মচারী যদি এই দায়িত্বটি পান তাহলে তিনি গোলাপশাহ’র মাজারে অন্তত বাতি দেবেন এটা বলা যায়। সুতরাং ঢাকা শহরকে হকারমুক্ত করার এই অভিযান দেখে যারা স্বস্তি বোধ করছেন তাদের জন্য কিছুটা আশঙ্কা অপেক্ষা করছেই।

এদিকে কিছু রাজনৈতিক সুবিধাভোগী মানুষ বলছেন হকারদের রুটি-রুজির বিষয়টি ভাবতে হবে। তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে আগে। হকারদের কথা, তাদের পরিচয়পত্র দিতে হবে একইসঙ্গে। অথচ এই হকাররা ইলাস্টিকের মতো। আজ যদি ৫ লাখ পরিচয়পত্র ইস্যু হয় কাল দেখা যাবে ৫০ হাজার বেড়ে গেছে। আর এই সুযোগে কিছু অসাধু হকার ও কর্মচারী দু’পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে। বড় কথা হচ্ছে হকাররা যে পরিচয়পত্র প্রদানের দাবি করছে সেটা কি সমাধান? তাদের বলা হলো ওসমানী উদ্যানের ভেতরে বসার জন্য। তারা সেখানে যেতে রাজি নয়। তাদের বলা হলো সন্ধ্যার পর দোকান নিয়ে বসতে, তাতেও তারা রাজি নয়। সমাধানটা তাহলে কী? টেলিভিশনে হকারদের নেতাদের কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয় তাদের প্রস্তাব বা দাবি কী? সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারে না তারা। বারবার মানবিক বিষয়টিই উত্থাপন করছে তারা।

তারা মাঝে মাঝে পুনর্বাসনের কথা বলে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী ঢাকা শহরে হকার আছে ১০ লাখ। এবং তাদের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তারা যেভাবে দোকান চালিয়ে আসছে সেটাই তারা চালিয়ে যেতে চায়। তাদের দাবি বিশাল সংখ্যার মানুষকে ভাগ্যবঞ্চিত করার অধিকার কারও নেই। এই ১০ লাখ মানুষের পুনর্বাসনের ক্ষমতা কি আছে সিটি করপোরেশনের? তারা বেআইনিভাবে সাধারণ মানুষের চলার পথ বন্ধ করে দিয়ে ব্যবসা করছে। সেই সাধারণ মানুষের সংখ্যাতো প্রায় দুই কোটির কাছাকাছি। সঙ্গত কারণেই প্রায় দুই কোটি মানুষের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। ঢাকাকে সিঙ্গাপুর বানানোর প্রসঙ্গ নয়, ঢাকার নাগরিকদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখার দায় সিটি করপোরেশনসহ কিছু প্রতিষ্ঠানের। তারা কি অবৈধ দখলদারদের স্বার্থ দেখবে নাকি বৈধভাবে বসবাসকারী মানুষের স্বার্থ চিন্তা করবে।

বৈধতার প্রশ্নে মানবিকতা কতটা কার্যকর? নাগরিক হিসেবে আমার বাসস্থানের নিশ্চয়তা দিতে হবে রাষ্ট্রকে। আমি ঢাকায় থাকি, আমার কোনও জায়গা নেই থাকার। আমি কি সরকারি কোনও খালি জায়গা দখল করে বসবাস করতে পারবো? বাসস্থানের চাহিদা আমার আছে, সেই চাহিদা পূরণের জন্য যেমন আমি সরকারি জায়গা ব্যবহার করতে পারি না হকারদেরও কি সেই অধিকার আছে? কাল যদি ঢাকার এক কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে দাবি করে, বাসস্থানের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ দাবি পূরণ করতে হবে, তখন সরকার কি পারবে সেটা পূরণ করতে? সুতরাং হকারদের বর্তমান দাবিকে এভাবেই দেখা দরকার।

যারা মানবিকতার কথা বলেন, তাদের মনে করিয়ে দেওয়া দরকার কয়েক বছর আগের কথা। ঢাকার বড় রাস্তাগুলোয় যখন রিক্সা চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হলো এবং ঢাকায় রিক্সা চলাচলে যখন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হলো তখন তারা একইভাবে মানবিকতার কথা বলেছিলেন। হাজার হাজার রিক্সাচালকের বেকার হয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। একইভাবে সিএনজি চালিত তিনচাকার যান সীমিত করার সময়ও একই কথা বলা হয়েছিল। বাস্তবতা হচ্ছে- বড় রাস্তাগুলোয় রিক্সা চলাচল নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। কোনও রিক্সাচালক কিন্তু বেকার হয়নি। আসলে মানুষ সময় ও সুযোগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার পেশারও পরিবর্তন করে। আজকে অবৈধ হকারদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য হবে। তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা তাদের নিজেদেরই করতে হবে। সরকার হয়তো তাদের পাশে দাঁড়াতে পারে। নিজ নিজ এলাকায় যদি তারা উৎপাদনশীল কোনও খাতে নিয়োজিত হতে চায় কিংবা ট্রেডিং ব্যবসায়েও জড়িত হতে চায় তাহলে তাদের বাঁচার পথের অভাব হবে না। সেক্ষেত্রে নিজেদের উদ্যোগ ও সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। তাই মানবিকতা দোহাই দিয়ে নাগরিকের দুর্ভোগ টিকিয়ে রাখার অবকাশ নেই।

অন্যদিকে সিটি করপোরেশন যে কাজটি করছে, এটি আরও বহু আগেই হওয়া প্রয়োজন ছিল। সেই কবে ২০০১ সালে দেশের উচ্চ আদালত ঢাকাকে হকারমুক্ত করার জন্য নির্দেশনা জারি করেছেন। এরপর বহুবার এই বিষয়ে লেখা হয়েছে। আদালতও বারবার তাগাদা দিয়েছে। এখন হকারমুক্ত ফুটপাত প্রতিষ্ঠা শুধু নাগরিক দায়িত্বই নয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনারও পালন হিসেবে গণ্য।

পুনর্বাসনের বিষয় হিসেবে সান্ধ্যকালীন বেচাকেনার প্রস্তাব করা হয়েছে, হলিডে মার্কেটের কথা বলা হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে নগরীর কম ব্যস্ত রাস্তাগুলোও। যেখানে হকাররা দিনের নির্দিষ্ট সময় বেচাকেনার সুযোগ পায়। তবে ঘনবসতির এই ঢাকায় হকারদের বিকল্প পেশা বেছে নেওয়াই উত্তম বলে মনে করি। উল্লেখ্য গ্রামীণ জীবনের উন্নয়নের সুবাদে এখন গ্রামেও বাণিজ্য সুবিধা বিস্তৃত হয়েছে। অধিকতর মুনাফার জন্য শহরমুখী মানসিকতাও ত্যাগ করতে হবে। সর্বোপরী বলা দরকার- হকার সমস্যা সমাধানে একমুখী চিন্তা ফলপ্রসু হবে না। সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি হকারদেরও ভূমিকা নিতে হবে বিকল্প পথ খোঁজার জন্য। তা নাহলে আজকে উচ্ছেদ হলে কাল আবার ভরাট হবে হকারে। ক্রমবর্ধমান গাড়ি ও মানুষের চাপ সইতে পারবে না মহানগরী ঢাকা।

লেখক: সাংবাদিক, শিশু সাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার হুমকি আব্বাসের
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার হুমকি আব্বাসের
জানা গেলো বেইলি রোডে আগুনের ‘আসল কারণ’
জানা গেলো বেইলি রোডে আগুনের ‘আসল কারণ’
গরমে খান দইয়ের এই ৫ শরবত
গরমে খান দইয়ের এই ৫ শরবত
সাভারে ভাঙারির দোকানে আগুন, এক ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে
সাভারে ভাঙারির দোকানে আগুন, এক ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ