X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

সাংবাদিকদের প্রতি ‘কামান দেগে’ শুরু করলেন ট্রাম্প!

চিররঞ্জন সরকার
২৮ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:০১আপডেট : ২৮ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:০৪

চিররঞ্জন সরকার প্রেসিডেন্ট হয়েই সাংবাদিকদের হুমকি দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। শপথ নেওয়ার দুদিনের মাথাতেই সাংবাদিকদের ‘সবচেয়ে অসৎ মানুষ’ বলে আক্রমণ করলেন তিনি। তার সঙ্গে কোনও রকম অসহযোগিতা করলে বা তার বিরুদ্ধে ভুয়া খবর প্রকাশিত হলে, তার ফল যে মোটেই ভালো হবে না, সেই হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন তিনি।
ট্রাম্প বলেছেন, ‘সাংবাদিকদের সঙ্গে আমার যুদ্ধ চলছে। কারণ তারাই দুনিয়ার সবচেয়ে অসৎ মানুষ। মিথ্যা খবর দেখানোর ফল ভালো হবে না।’ শুধু সাংবাদিকদের হুমকি প্রদানই নয়, প্রতিশ্রুতি মতো হোয়াইট হাউসে ঢুকে বারাক ওবামার বিপরীত পথে হাঁটা শুরু করেছেন তিনি। ওভাল অফিসে তার দ্বিতীয় দিনেই সই করেছেন ‘ওবামাকেয়ার’-এর প্রভাব কাটানোর নির্দেশে। দেশের অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনতে ‘পেশেন্ট প্রটেকশন অ্যান্ড অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট’ এনেছিল ওবামা প্রশাসন। চলতি ভাষায় যা পরিচিত ‘ওবামাকেয়ার’ নামে। কিন্তু ওই পদক্ষেপে রাষ্ট্রীয় তহবিলের ওপরে চাপ বেড়েছে বলে দাবি ট্রাম্পসহ রিপাবলিকানদের।
ট্রাম্প যে প্রশাসনিক নির্দেশে (এক্সিকিউটিভ অর্ডার) সই করেছেন তাতে সরকারি তহবিলের ওপরে ‘ওবামাকেয়ার’-এর চাপ কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোকে। এতে ‘ওবামাকেয়ার’-এর অধীন বেশ কিছু ব্যবস্থা তথা পরিষেবা বাতিল করা যাবে। ট্রাম্পের এই নির্দেশের প্রশাসনিক গুরুত্বের চেয়ে প্রতীকী গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ, প্রথম দিন থেকেই ওবামার বিপরীত পথে হাঁটার বার্তা দিয়ে রাখলেন তিনি। 
কেবল এই নির্দেশ নয়, বিতর্ক রয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের অন্য পদক্ষেপ নিয়েও। দ্বিতীয় দিনে প্রতিরক্ষা সচিব পদে জেমস ম্যাটিস ও হোমল্যান্ড সিকিউরিটি দফতরের সচিব পদে জন এফ কেলির নাম অনুমোদন করেছে কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন বিভিন্ন পদে তাদের নিযুক্ত ব্যক্তিদের অনুমোদন পাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ডেমোক্র্যাট সিনেটররা।
ট্রাম্পকে আমেরিকার এক শ্রেণির মানুষ মেনে নিতে পারেননি। তাইতো নির্বাচনি ফল ঘোষণার পর থেকেই চলছে বিক্ষোভ। শপথের পর থেকে বিক্ষোভ ও হিংসার জেরে গোটা দেশে গ্রেফতার হয়েছেন ২১৭ জন। মার্কিন ইতিহাসে এমন বিক্ষোভের নজির কমই আছে। ট্রাম্পের বক্তৃতার সঙ্গে ‘ব্যাটম্যান’ সিরিজের জনপ্রিয় খলনায়ক বেনের বক্তৃতার মিল খুঁজে পেয়েছেন অনেকে। বিক্ষোভের বহর দেখে তারা বলছেন, ‘আমেরিকার মানুষের বড় অং‌শের কাছে ট্রাম্প এখন খলনায়কই।’ এমন পরিস্থিতিতে কেমন কাটবে ট্রাম্পের আগামী দিনগুলো-তা নিয়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক জল্পনা।
চার বছরের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০ জানুয়ারি, ২০১৭ শপথ নিয়েছেন। দেড় বছর ধরে নির্বাচনি প্রচার এবং ভোটে জয়লাভের পর দুমাস ধরে যে তর্জন-গর্জন তিনি করেছেন সেটা অনুসরণ করলে আমেরিকার অভ্যন্তরে এবং গোটা পৃথিবীতে মার্কিনি দৌরাত্মের আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে সন্দেহ নেই। ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারের মূল স্লোগান ছিল ‘আমেরিকাকে আবার মহান করে তোলো‌’ (মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন)। এ স্লোগানকে ব্যঙ্গ করে এবং ট্রাম্পের স্লোগানের আসল মর্মবস্তু হিসেবে শপথ অনুষ্ঠানে নিউইয়র্ক সিটিতে পোস্টার দেখা যায় ‘মেক আমেরিকা হেইট অ্যাগেইন’। হতেও পারে। ট্রাম্পজমানায় যে কোনও কিছুই হওয়া সম্ভব!

ক্ষমতাসীন হয়ে ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন যে, তিনি আমেরিকাকে ঐক্যবদ্ধ করবেন এবং প্রত্যেকের জন্য আমেরিকাকে মহান করে তুলবেন। উপহাসের ঢেউ তুলে শপথে তিনি ঘোষণা করেছেন, ক্ষমতা আপনাদের হাতে, অর্থাৎ জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছি। নির্বাচনের আগে ট্রাম্প অনেক আবোল-তাবোল কথা বলেছিলেন। অনেকে ভেবেছিলেন জিতলে হয়তো ট্রাম্প অত হাস্যকর কথা বলবেন না। কিন্তু শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানেও তিনি যা বলেছেন, তাতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আক্কেল গুড়ুম। শপথে তিনি সকলের চাকরিসহ সব সমস্যা সমাধান করে আগে কখনও হয়নি এমন জয়ের রাস্তায় আমেরিকাকে নিয়ে যাওয়ার ঢালাও প্রতিশ্রতি দেন। তার বক্তব্যে রাজনীতিবিদদের প্রতি ক্ষোভও ঝরে পড়ে। রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করে ট্রাম্প বলেন, তারা নিজেদের পকেট ভরেছেন, দেশের নাগরিকদের রক্ষা করেননি। তিনি আশ্বাস দেন, ‘আমেরিকা আবারও মহান হবে। এখন থেকে আমেরিকা আর হারবে না, একের পর এক বিজয় ছিনিয়ে আনবে।’ অনেকে এই বক্তব্যকে ‘ভাঁওতাবাজি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ যে বিধ্বস্ত ও পরাজিত আমেরিকার ছবি ট্রাম্প তার ভাষণে চিত্রিত করেছেন, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। যুক্তরাষ্ট্র এখনও সবচেয়ে ধনী ও শক্তিধর পরাশক্তি। ২০০৮ সালের পর যুক্তরাষ্ট্র যে মন্দাবস্থায় পড়ে, বারাক ওবামার শাসনকালের আট বছরে তা অনেকখানি কেটে গেছে। দেশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা শুরু করেছে। এক কোটির বেশি নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে।

ট্রাম্প কাদের স্বার্থ রক্ষা করবে তা তার প্রশাসনকে দেখলেই বোঝা যায়। পৈতৃক ধারায় জমি-বাড়ি-সম্পত্তি কেনাবেচা দিয়ে যার যৌবনের সূত্রপাত তার সম্পত্তির পরিমাণ এখন প্রায় ৪৫০ কোটি ডলার । ইতিমধ্যে মন্ত্রিসভায় তিনি যাদের বেছে নিয়েছেন তারা তার মতো বা তার চেয়েও বড় ধনী। ট্রাম্প তার মতো এবং তার চেয়ে বড় ধনীদের স্বার্থ রক্ষায় আমেরিকার অভ্যন্তরে এবং বিশ্ব আধিপত্যে আরও বেশি আগ্রাসী ভূমিকা নেবে এই আশা-ভরসায় ইতিমধ্যে ধনীরা কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে। এর থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামরিক অভিমুখ অনুমান করা যায়। এই কারণে আতঙ্ক ছড়িয়েছে আমেরিকায় এবং বহির্বিশ্বে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার চলতি পররাষ্ট্রনীতি উপড়ে দিয়ে নতুন ও আরও আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের কথা খোলাখুলি ঘোষণা করেছেন। ইতিমধ্যেই তিনি ‘এক চীন’ নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাইওয়ানকে ঘিরে এবং দক্ষিণ চীন সাগরকে কেন্দ্র করে চীনের সঙ্গে বিরোধ বাধানোর ক্ষেত্র তৈরি করেছেন। চীনের বিরুদ্ধে পুতিনের রাশিয়াকেও কাছে টানার চেষ্টা করছেন। এমনকি বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির বিপদ উড়িয়ে দিয়ে তিনি বিশ্ব-উষ্ণতা বৃদ্ধি চীনেরই প্রচার আখ্যা দিয়ে বলেছেন, চীনের উদ্দেশ্য নাকি আমেরিকার উৎপাদিত সামগ্রীকে প্রতিযোগিতার বাইরে রাখা। চরম হাস্যকর শোনালেও ট্রাম্পেরই মুখনিঃসৃত বাণী— নিউইয়র্ক ঠাণ্ডায়-বরফে কাঁপছে এবং তার জন্য আমাদের দরকার বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি!

ট্রাম্প ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন যে, কোনও বাণিজ্যচুক্তিই উনি মানবেন না; অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ হবে মূল কথা; বাণিজ্যে উদারীকরণ চলবে না; আমেরিকাকে সেরা করতে আমেরিকা তার পারমাণবিক ক্ষমতাকে অনেক বাড়িয়ে তুলবে ও সম্প্রসারিত করবে; অবৈধ অভিবাসীদের আমেরিকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে তার অকপট বক্তব্য- ওখানে থাকতে হবে এবং তেল সম্পদ রাখতে হবে।

শপথ অনুষ্ঠানেও ‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদকে’ দুনিয়া থেকে নির্মূল করার কথা ঘোষণা করেছেন! কিন্তু বিন-লাদেন আর আইএস-এর স্রষ্টা আমেরিকার নতুন রাজা কিভাবে তা করবেন, সে বিষয়ে কিছু বলেননি। ভুলে গেলে চলবে না যে, ২৬ বছর আগে ১৯৯১ সালের ১৬ জানুয়ারি ইরাকে মার্কিনি বোমাবর্ষণের সূচনা । গত প্রায় আড়াই যুগে চার জন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় এসেছেন-গেছেন, কিন্তু এই আগ্রাসন থেকে একচুলও সরেননি। ২০১৬ সালে বিভিন্ন দেশে আমেরিকা নিক্ষেপ করেছে ২৬,১৭১টি বোমা; এর বেশিরভাগটাই ইরাকে, কিছু সিরিয়ায়। কিছু লিবিয়ায়, আর সৌদি আরবের মাধ্যমে ইয়েমেনে। সন্ত্রাসের জনক আমেরিকার অজুহাতের অভাব নেই—গণতন্ত্র, সন্ত্রাসদমন, মানবাধিকার যখন যেখানে যেমন প্রয়োজন। ব্রিটেনে তদন্ত হয়েছে ইরাক-আগ্রাসনে ব্রিটেনের ভূমিকার জন্য। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, যদিও শাস্তি হয়নি। কিন্তু আমেরিকা তদন্তের ঊর্ধ্বে। নির্বাচনি প্রচারে দূরে রাখা হয়েছে এই ঘোর অপরাধকে।  মন্তব্যের ব্যাপারে এত যে বেহিসেবি, তবু এ ব্যাপারে তিনি টুঁ শব্দটি করেন নি। করবে কী, ট্রাম্পকে যতই ‘পাগল’ বলা হোক কেন, স্বার্থের ব্যাপারে তিনি যে অন্যদের চেয়েও হিসেবি!

এর আগে আমেরিকার যারা প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তাদের অন্তত একটা মুখোশ ছিল, কিছু রাখঢাক ছিল। ট্রাম্প সাহেব ওসবের ধার-ধারেন না। আর বিপদটা সেখানেই। নিজের ঘরে প্রতিশ্রুতি রাখতে ব্যর্থ হয়ে না জানি বাইরে নতুন করে কী লঙ্কাকাণ্ড বাধান-এ নিয়ে পশ্চিমা পণ্ডিতরা পর্যন্ত চিন্তিত! আমেরিকার চরম দক্ষিণপন্থী ও নয়া-ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠীগুলো নতুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমর্থনে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপের চরম দক্ষিণপন্থীরা এতে উৎসাহ পেয়েছে। আরও কত রক্তপাত, বিভীষিকা, মৃত্যুবর্ষী গোলা নতুন প্রেসিডেন্টের নির্দেশে বর্ষিত হবে সেই আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে এক বিরাট সংখ্যক মার্কিন নাগরিক ও দুনিয়ার মানুষ! সাংবাদিকদের প্রতি কামান-দেগে যার যাত্রা শুরু, তার শেষটা যে কাকে দিয়ে, কিভাবে হবে, এখন এটাই দেখার বিষয়।

লেখক: কলামিস্ট

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ