X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘ধাক্কাধাক্কি’ সত্য-অসত্য এবং রামপাল

গোলাম মোর্তোজা
২৮ জানুয়ারি ২০১৭, ১৪:৪২আপডেট : ২৮ জানুয়ারি ২০১৭, ২৩:৩৪

গোলাম মোর্তোজা গত দুই দিনে তিনটি ছবি আলোচনায় এসেছে।
ক. একজন সিনিয়র সিটিজেনকে অনেক পুলিশ সদস্য মিলে কিল-ঘুষি-লাথি মেরে টানাহ্যাঁচড়া করছেন।
খ. একদল পুলিশ নির্মমভাবে প্রহার করছে দু’জন সাংবাদিককে।
গ. হাস্যোজ্জ্বল প্রধানমন্ত্রী নাতি-নাতনিদের নিয়ে ভ্যানে গ্রাম ঘুরে দেখছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় বেশ কিছু পুরনো ছবি নতুন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্থান পেয়েছে। প্রমাণিত দুর্নীতিবাজ স্বৈরাচার এরশাদ সাইকেল চালিয়ে অফিসে যাচ্ছেন,  পুলিশ রাস্তায় ফেলে মতিয়া চৌধুরী ও মো. নাসিমকে পেটাচ্ছে, পিটিয়ে সাদেক হোসেন খোকার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। এই ছবিগুলো ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
পুরো বিষয়টি আলোচনায় এসেছে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদে ডাকা হরতালকে কেন্দ্র করে। রামপাল এখন শিশু-বৃদ্ধ সবার আলোচনার বিষয়। আর শুধু বাংলাদেশের বিষয় নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গন ও গণমাধ্যমেরও ইস্যু।
উল্লিখিত ছবি ও রামপাল ইস্যু এবং তার প্রেক্ষাপট নিয়ে সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ।

১. একজন শিশু বা কিশোর তার মায়ের কাছে জানতে চাইছেন, রামপাল ইস্যুতে তোমার অবস্থান কী? আসলেই কি রামপালের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে?

মা বলছেন, ‘আমি কনফিউজড। নিশ্চিত না যে, ক্ষতি হবে কিনা। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিও না।’

তোমার কী ধারণা, মা সন্তানের কাছে জানতে চাইছেন।

উত্তরে শিশু বলছে, ‘দেশের প্রধানমন্ত্রী মিথ্যা বলতে পারেন না। তিনি যেহেতু বলছেন ক্ষতি হবে না, সুতরাং ক্ষতি হবে না।’

এটা কাল্পনিক গল্প নয়। ফেসবুকে একজন মোটামুটি এ রকমই লিখেছেন। লিখেছেন নিজের সন্তানের বিশ্বাসের কথা।

একজন নিষ্পাপ শিশু বা কিশোর তার স্বাভাবিক বিশ্বাসের কথা অকপটে বলেছে। দেশের রাজনীতি, ক্ষমতা, নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়ে এখনও অতটা ধারণা তার হয়নি, হওয়ার কথা নয়। ক্ষমতা, নির্বাচন, ক্ষমতাসীনদের সত্য-অসত্য বলার বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা আছে মায়ের। মা এসব সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা রাখেন। ১৯৭৫ সালের পর থেকে যারা দেশ পরিচালনা করছেন, তারা কয়জন, গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে ‘সত্য’ বলেছেন, বলেন? এই শিশু বড় হয়ে জানবে, তার বিশ্বাসই ঠিক ছিল? দেশের বাস্তবতা তাই বলে?

২. বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে যোগ দিতে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংবাদে বলা হয়েছে, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, অত্যন্ত সম্মানজনক একটি ফোরাম। এমন গুরুত্বপূর্ণ ফোরামে বাংলাদেশকে আগে কখনও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এবারই প্রথম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সম্মানজনক ঘটনা।

এই ফোরামের একটি প্যানেল আলোচনায় আমেরিকার সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর তুলেছিলেন রামপাল ইস্যু। প্যানেলে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার জবাব দিয়েছেন তার মতো করে। এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। আল গোরের প্রসঙ্গ উত্থাপন এবং প্রধানমন্ত্রীর জবাব বিষয়ক ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, ‘ইউনূস ও তার লোকজন টাকা খরচ করে ডাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে রামপাল কয়লা কেন্দ্র নিয়ে প্রশ্ন উঠিয়েছেন।’

এত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফোরামে ‘টাকা খরচ করে’ প্রশ্ন ওঠানো যায়? আল গোরের মতো ব্যক্তিকে টাকা দিয়ে কেনা যায়? বিশ্বাসযোগ্য বক্তব্য? দেশ বিদেশের কোনও মানুষ তা বিশ্বাস করবেন? ‘টাকা খরচ করে’প্রশ্ন ওঠানোর বক্তব্য যদি সত্যি ধরে নেই, তাহলে বিষয়টি কেমন দাঁড়ায়! যে ফোরামে ‘টাকা খরচ করে’ প্রশ্ন ওঠানো যায়, তা আর যাই হোক ‘গুরুত্বপূর্ণ বা সম্মানজনক’ কোনও ফোরাম হতে পারে না। তাহলে আমাদের সিদ্ধান্ত কী হবে, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম কি ‘গুরুত্বপূর্ণ-সম্মানজনক’ না ‘টাকার বিনিময়ে কেনা-বেচা’র প্ল্যাটফর্ম?

ভৌগলিকভাবে সুন্দরবন বাংলাদেশে, গুরুত্ব সারা পৃথিবীর কাছে। আগামী দিনে আরও অনেক প্লাটফর্মের চেয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি বাংলাদেশকে হতে হবে। কোনও নন্দ ঘোষের ওপর দায় চাপিয়ে পরিত্রাণ মিলবে না।

৩. এবার আসি ছবি প্রসঙ্গে। একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন জনমানুষের কাতারে নেমে এসে ভ্যানে বসে গ্রাম ঘুরে দেখেন, সেই ছবি আমাদের আনন্দিত করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন একজন সাধারণ গ্রামীণ নারীর প্রতিচ্ছবি।

একজন সিনিয়র সিটিজেন যিনি রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদ করেন, সুন্দরবনকে বাঁচাতে চান। হরতাল আহ্বানকারীদের ওপর পুলিশ যখন জলকামান ব্যবহার করে, সিনিয়র সিটিজেন তখন জলকামানের গাড়ির সামনে ওঠে প্রতিবাদ করেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে কী দানবীয় নির্যাতন! একজন বয়স্ক মানুষকে বিশ ত্রিশজন পুলিশ মিলে কিল-ঘুষি-লাথি-লাঠি... অমানবিকতার চেয়েও বেশি কিছু। সেই ছবি ছাপা হয় পত্রিকায়, ছড়িয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। সরকার, রাষ্ট্রের কর্ণধাররা নির্বিকার থাকেন। অথচ সংবিধানই প্রতিবাদের অধিকার দিয়েছে তার নাগরিকদের।

রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় দু’জন সাংবাদিককে নির্যাতনের ঘটনায়। একজন পুলিশের এএসআইকে সাসপেন্ড করা হয়। তারপরই চমকপ্রদ (যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের জন্য অত্যন্ত স্বাভাবিক) বক্তব্য আসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে। ‘পুলিশ সাংবাদিকদের নির্যাতন করে না। মাঝে মাঝে পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি লেগে যায়।’

পুলিশের এই নির্মম বর্বরতাকে যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘ধাক্কাধাক্কি’ বলে সমর্থন করেন, তখন ছবির পাল্টা ছবি-বক্তব্যের প্রসঙ্গ চলে আসে।

মতিয়া চৌধুরী-মো. নাসিমকে পেটায়নি, পুলিশের সঙ্গে ‘ধাক্কাধাক্কি’ হয়েছিল? সেই পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ অনেক মিছিল-মিটিং-হরতাল করেছে। সেসব ভুল ছিল, স্বীকার করে নেবে আওয়ামী লীগ?

পুলিশি বর্বরতা মানুষকে ক্ষুব্ধ করছে। মানুষের মনে স্থায়ী আসন তৈরি করে নিচ্ছে নির্যাতনের ছবি। আনন্দ ভ্রমণ মানুষের হৃদয়ে স্থান পাচ্ছে না।

এত অন্যায়-অনাচার, অন্যায্যতার মাঝে প্রধানমন্ত্রীর ভ্যান ভ্রমণের প্রাণবন্ত ছবি মানুষকে যতটা না পুলকিত করে, তার চেয়ে বেশি এরশাদের সাইকেল ভ্রমণের সঙ্গে তুলনা করতে উদ্বুদ্ধ করে।

৪. রামপাল বিষয়ে অনেক তথ্য-প্রমাণ দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতার দাম্ভিকতার কাছে তথ্য-প্রমাণ গুরুত্ব পায় না। সেসব তথ্যের দিকে না গিয়ে ‘সত্য-অসত্য’ প্রসঙ্গ দিয়ে লেখা শেষ করব।

রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বিষয়ে সরকারের বক্তব্য মোটামুটি এরকম- ‘এমন প্রযুক্তিতে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে, যেন পরিবেশ দূষণ হবে না। সেই প্রযুক্তির নাম আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি। সরকার বিজ্ঞাপনে বলেছে পৃথিবীর ‘সর্বোচ্চ প্রযুক্তি’ ব্যবহার করা হবে। এমন জাহাজে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা পরিবহন করা হবে, যা থেকে কয়লা পানিতে পড়বে না। এমনকি সেই সব জাহাজে কোনও শব্দও হবে না।’

আরও অনেক কথা বলেছে। সব কথায় যাচ্ছি না। সরকারের এসব বক্তব্য এবং এখনকার বক্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করলে প্রমাণিত হয়, ভারতীয় কোম্পানির বক্তব্যই সরকারের বক্তব্য। সরকারের নিজস্ব কোনও গবেষণামূলক বক্তব্য নেই। কেন বলছি এ কথা, তার পক্ষে কয়েকটি তথ্য-

ক. হঠাৎ করে একদিন কোম্পানির এমডি বললেন, আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি বলতে পৃথিবীতে কিছু নেই। রামপালে সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। তাহলে এতদিন সরকার এবং সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এমনকি ভারতীয় কোম্পানির কর্তারাও কিসের ভিত্তিতে বলছিলেন আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কথা? আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি পৃথিবীতে নেই- এই বক্তব্য শতভাগ অসত্য। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, এশিয়ার জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন প্রভৃতি দেশে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। ‘সুপার ক্রিটিক্যাল’ ৩০ বছর আগের পুরনো প্রযুক্তি। অথচ সরকার বিজ্ঞাপনে বলেছে ‘পৃথিবীর সর্বোচ্চ’ প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা। সত্য-অসত্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কারও কোনও সমস্যা হওয়ার কথা না।

খ. পৃথিবীর কোনও দেশেই জাহাজে পরিপূর্ণভাবে ঢেকে কয়লা পরিবহন করা হয় না। কোথাও কোথাও বিশেষ পরিস্থিতিতে ঢেকে কয়লা পরিবহন করা হয়। ভারত নৌ-রেল-সড়ক কোনও পথেই কয়লা ঢেকে পরিবহন করে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা করবে, কোনও যুক্তিতেই বিশ্বাসযোগ্য বক্তব্য নয়। ‘শব্দ হবে না’ এমন জাহাজ তো পৃথিবীতে নেই।

সম্পূর্ণ অসত্যের ওপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতার দাম্ভিকতায় চলছে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ। অসত্য তথ্যের বিরুদ্ধে, সুন্দরবন ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে, সত্যের পক্ষে- সুন্দরবন বাঁচানোর পক্ষে অবস্থান নেওয়া প্রতিটি নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাবি ছাত্রলীগের সেই ৩ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ 
জাবি ছাত্রলীগের সেই ৩ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ 
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩৮
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩৮
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ