X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

হেরে যাবে না কুন্দেরপাড়া, জেগে আছে বাংলাদেশ!

শারমিন শামস্
২৯ জানুয়ারি ২০১৭, ১৭:০৩আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০১৭, ১৭:০৭

শারমিন শামস্ আমি ঠিক জানি না, কোন ভাষায় ক্ষোভ প্রকাশ করলে মনে শান্তি আসবে! আমি জানি না, কী বললে আর কী করলে শাসকের টনক নড়বে। আমি সত্যিই বুঝতে পারি না, কেন তারা চোখের সামনে অন্ধকারের আলামত স্পষ্ট দেখার পরও চোখ বুজে আছেন! আমার বোধে আসে না, অশুভের এই আঁধারও কেন তাদের স্পর্শ করে না? কেন তাদের বিবেকে আঘাত করে না, কেন তাদের মনে আতঙ্ক আর আশঙ্কার কোনও ছায়া পড়ে না!
গাইবান্ধার কুন্দেরপাড়ায় যে স্কুলটিতে রাতের অন্ধকারে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই স্কুল থেকে এবার ৭৭জন পরিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। একটি প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে, এক সময় যেখানে কোনও স্কুলই ছিল না, সে রকম একটি জায়গা থেকে বছরে ৭৭ জন এসএসসিতে অংশ নেওয়া কোনও ছোটখাটো ব্যাপার নয়। আগুনে পুরো স্কুল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পুড়ে গেছে বেঞ্চ-চেয়ার-টেবিল-বই-খাতা-কাগজসহ স্কুলবিল্ডিং। আমি চোখের সামনে যেন দেখতে পাই রাতের অন্ধকার চিরে দাউদাউ করে জ্বলছে আগুনের লেলিহান শিখা আর পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে গ্রামের স্কুলের অতি যত্নে গড়ে ওঠা লাইব্রেরি, শত শত বই। আমার বুকের ভেতর জমে থাকা একটা বেদনার বরফ গলে গলে সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে।

পত্রিকার পাতায় যে বাচ্চাগুলোর ছবি দেখলাম, কান্নায় ভেঙে পড়া, এই কান্নার চেয়ে বিশুদ্ধ আর কিছু নেই। নিজের স্বপ্নের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল ছেলে-মেয়েগুলো। তারা তো আর ঢাকা শহরের ননী মাখন খাওয়া ছেলেমেয়ের দল নয় যে, সারাদিন বাবা-মা তাদের চোখের সামনে হরলিক্সের গ্লাস রেখে ‘পড়ো পড়ো’ করবেন। তারা হলো সেই ছেলেমেয়ে, যারা পড়ে বলেই হয়তো পরিবার আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশীর কাছে প্রায়ই খোঁটা খায়, বিশেষ করে মেয়েগুলোকে নিশ্চয়ই প্রায়ই বিয়ের হুমকি দিয়ে পড়া বন্ধ করে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। হয়তো কখনও সেই ভয় সত্যে পরিণতও হয়। বিয়ে হলে পড়া বন্ধ হয়ে যায় অনেকের। তবু বহু মেয়ে সেই চূড়ান্ত প্রতিকূল পরিবেশে স্বপ্ন দেখে বড় হওয়ার, মানুষের মতো মানুষ হওয়ার। সেই স্বপ্ন দেখে তারা ছোট্ট ওই স্কুলঘরটিকে কেন্দ্র করে, ওই লাইব্রেরিটিকে বুকে ধরে। পরনে সবার ইউনিফর্ম নেই, বইয়ের ব্যাগ নেই, পায়ে জুতো নেই। কিন্তু স্কুলঘরটা আছে, বই আছে। সেই স্কুল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই। কী আশ্চর্য এই দেশ এই রাষ্ট্রব্যবস্থা!

গত বৃহস্পতিবার রাতে ব্রহ্মপুত্র নদের চরাঞ্চল কামারজানী ইউনিয়নের কুন্দেরপাড়ায় স্থাপিত স্থানীয়দের স্বপ্নের এ স্কুলে আগুন লাগে। এতে আসবাব, শিক্ষা সরঞ্জাম, শিক্ষার্থীদের সনদ ও বইপত্র পুড়ে যায়। না, ‘দুর্বৃত্ত’ এখনও চিহ্নিত হয়নি। তবে সরেজমিন পরিদর্শন আর প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, নাশকতার উদ্দেশ্যেই সুপরিকল্পিতভাবে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে স্কুলটি। স্থানীয়রা মনে করছেন, যে মৌলবাদী চক্র দীর্ঘদিন ধরে ওই এলাকায় নারীশিক্ষা ও উন্নয়নের বিপক্ষে নানা অপতৎপরতা চালিয়ে আসছিল, তারাই বিদ্যালয়টি ধ্বংস করতে আগুন দিয়েছে।

মনটা কেমন স্তব্ধ আর নিথর হয়ে আসে। যেন আমি চলৎশক্তিহীন, যেন আমি শক্তিহীন। যেন আমি নির্বাক, নির্বোধ। যেন আমি জন্মেছি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখার জন্য।

স্কুলটির শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্থানীয়রা বলছেন, শিক্ষার বিকাশ ঘটায় কুন্দেরপাড়া, পার্শ্ববর্তী সিধাই, চিথুলিয়া দিগর, মোল্লারচর, মৌলভীরচর, রসুলপুরসহ চরাঞ্চলে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, যৌতুক প্রথা অনেক কমে গেছে। এসব এলাকায় নারীশিক্ষার হারও দিন দিন বাড়ছে। বিদ্যালয়টি নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে আশীর্বাদস্বরূপ। কেননা মেয়েরা প্রাথমিক পাসের পর অনেক দূরে হাই স্কুলে যেতে পারত না। ফলে তাদের অল্প বয়সেই বিয়ে দেওয়া হতো। বিদ্যালয়টি থাকার কারণে বাল্যবিবাহ ও নারী নির্যাতন কমেছে। এ জন্য একটি মৌলবাদী চক্র স্কুলটি ধ্বংসের পরিকল্পনা করতে পারে বলে তাদের ধারণা।

গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা এবং পাঠদান দুটি কাজই এমনিতেই অনেক কষ্টকর। নানা প্রতিকূলতা পেরোতে হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয় পক্ষকেই। গাইবান্ধায় মৌলবাদী চক্রের গাত্রদাহের কারণগুলো উপলব্ধি করি। কতটা দুর্গম আর প্রতিহিংসাপরায়ণ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে ছেলেমেয়েগুলো লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিল, বিশেষ করে মেয়েরা, তাও বোঝার চেষ্টা করি। আর তাদের শিক্ষকরাও নিশ্চয়ই নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা বন্ধক রেখেই শিক্ষাদানের কাজটি করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা তো আর হলো না। গ্রাম্য রাজনীতি, মৌলবাদ আর জমি দখলের চিরাচরিত ঘটনাগুলোর শিকার এই বিদ্যালয়টি আর কখনও কি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে? আমি আশায় বুক বাঁধি, মানুষের শুভবোধ, বিবেক আর আদর্শ কি পরাজিত হবে শেষমেষ? নাকি ওই পুড়ে যাওয়া জমিতেই আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে স্কুলের নতুন ভবন? নিশ্চয়ই হবে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পদভারে আবার হেসে উঠবে স্কুলের আঙ্গিনা। ক্লাসরুমগুলো থেকে ভেসে আসবে সমস্বরে নামতা পড়ার শব্দ, স্পোর্টস ডে’তে একশো মিটার দৌড়ে সবাইকে হারিয়ে প্রথম হবে রহিমা খাতুন—এইসব স্বপ্ন দেখা আমি ছাড়ছি না। আমি কখনোই স্বপ্ন দেখা ছাড়ি না। আমার স্বপ্নরা দুঃস্বপ্নের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচে। এই ষোলো কোটির দেশে মৌলবাদ, অশুভ রাজনীতি, দখল বাণিজ্য, ক্ষমতার ভোগদখল যেন আমাদের স্বপ্নকে ছিনিয়ে না নেয়।

আঘাত তো আসবেই। যেমন আঘাত এসেছে কুন্দেরপাড়ায়, কিন্তু তাই বলে কি হারিয়ে যাবে পড়ালেখার স্বপ্ন? বড় হওয়ার ইচ্ছেগুলো? না। আমরা হারব না। আমরা হারতে দেব না ওই ছেলেমেয়েগুলোকে, যারা চোখের পানি মুছে পুড়ে যাওয়া ভবনের পাশে তাবু খাটিয়ে আবারও ক্লাস করতে বসেছে। ওদের গায়ে ভালো জামা নেই, মাথার ওপরে ফ্যান, এসি নেই। বরং ভয়, আতঙ্ক, আশঙ্কা আর বেদনা বুকে ধরে আবারও পড়ায় মন দিয়েছে ওরা। আমরা, সারা বাংলাদেশ ওদের সঙ্গে আছি। আমরাই ওদের শক্তি যোগাবো। প্রতিবাদ করে, প্রতিরোধ করে, ধিক্কার দিয়ে, ঘেন্না প্রকাশ করে আমরা ওদের শত্রুদের চিরতরে হটিয়ে দেব। শিক্ষার আলো জ্বলবেই। আমরা আছি। কুশিক্ষা, কুসংস্কার, লোভ, অসততার ছায়া ওই ছেলেমেয়েগুলোর স্বপ্নের পথে কোনও বাধা হয়ে যেন দাঁড়াতে না পারে, এজন্য পুরো বাংলাদেশ অতন্ত্র প্রহরীর হয়ে জেগে থাকুক। জয় হোক।

লেখক: প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিএসএফের গুলিতে নিহত যুবকের মরদেহ হস্তান্তর
বিএসএফের গুলিতে নিহত যুবকের মরদেহ হস্তান্তর
এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপের সভায় সভাপতিত্ব করা ছিল অসাধারণ অভিজ্ঞতা: স্পিকার
এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপের সভায় সভাপতিত্ব করা ছিল অসাধারণ অভিজ্ঞতা: স্পিকার
বিএসএমএমইউ’র দায়িত্ব নিয়ে যা বললেন নতুন ভিসি
বিএসএমএমইউ’র দায়িত্ব নিয়ে যা বললেন নতুন ভিসি
বাজেটে শিক্ষা খাতে ১৫ শতাংশ বরাদ্দের দাবি
বাজেটে শিক্ষা খাতে ১৫ শতাংশ বরাদ্দের দাবি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ