X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

নারী চরিত্র খোঁড়াখুঁড়ি মানেই ব্যবসা?

সাদিয়া নাসরিন
৩০ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:২৩আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:৩৫

সাদিয়া নাসরিন আরাফাত সানি, আমাদের তারকা ক্রিকেটার। দেশের গৌরব সুনামের দায়িত্ব ক্রিকেটারদের হাতে তুলে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাই। সেই সানি, তথ্যপ্রযুক্তি আইনে এক নারীর দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হলেন। সানির বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি সেই নারীকে বিয়ে করছেন কিন্তু স্বীকৃতি না দিয়ে উল্টো অন্তরঙ্গ ছবি প্রকাশ করে ব্ল্যাকমেইল করছেন। বিষয়টি বিচারিক কার্যক্রমে আছে। কিন্তু আদালতের পাশাপাশি পত্রিকাগুলো যেভাবে সত্য মিথ্যা প্রমাণের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে, সেখানে আমাদের সত্যিই পপকর্ণ খাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। কোনও পত্রিকা যদি বলছে সানি বিয়ে করেছে, তো অন্য পত্রিকা একেবারে গোয়েন্দা স্টাইলে কাজী অফিসের ঠিকানায় মাংসের দোকান খুঁড়ে কাজীকে বের করে প্রমাণ করে ছাড়ছে কাবিন নামা ভুয়া! কী অসাধারণ!
সানির খবরে বাজার কাটতি পাওয়া যাচ্ছিল না বলে যথারীতি আমাদের অফলাইন অনলাইন পত্রিকাগুলো লেগে গেলো ‘নাসরিন’ এর ময়নাতদন্ত করতে। ‘কে এই নাসরিন’ দিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়ে তা বিস্তৃত হয়ে গেলো, ড্রাইভারের মেয়ে আইফোন কিভাবে ব্যবহার করে, ইয়েলো ব্র্যান্ডের জামা কিভাবে পরে সেই পর্যন্ত। অনলাইন-অফলাইনের পত্রিকারা একেবারে সরেজমিন তদন্ত, আশেপাশের মানুষের বরাত দিয়ে রমরমা স্টোরি বানিয়ে ফেললেন। ‘... ঘর দেখুন, কে বিশ্বাস করবে আরাফাত সানির সঙ্গে তার (নাসরিন) ওঠাবসা আছে। সবই স্বার্থ। পোশাক দেখে কেউ বুঝবে না ওদের ক্লাস কী? চলাফেরায় বোঝার উপায় নেই। কোথা থেকে এ টাকা আসে। এ রকম আরও অনেককে মুরগি বানিয়ে টাকা বাগিয়েছে... অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনেই চলে ওদের পরিবার। তাই ফাঁদ পেতে আরাফাত সানিকে আটকানোর চেষ্টা চলছে...’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আগেও এই মিডিয়া সন্ত্রাস আর তারকাদের পুরুষ ভক্তকূলের চাপে হ্যাপি এভাবেই কোনঠাসা হতে হতে রুবেলের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং ‘খারাপ মেয়ে’ হিসেবে ট্যাগ হয়ে গিয়েছিল। এবারও নিশ্চয়ই তার অন্যথা হবে না। এমন সোনার মিডিয়া থাকতে কার সাধ্য আমাদের সোনার ছেলেদের আটকে রাখে?
বটেই তো! রুবেল- সানিরা হলেন বিশ্বখ্যাত খেলোয়াড়, তার ওপর আবার পুরুষ! এরকম দু’ চারটা ‘বস্তির মেয়ে’কে রক্ষিতা বানিয়ে না রাখলে কিসের পুরুষ! ‘বস্তির মেয়ে’ নাসরিন, সানির মতো মহান পুরুষের দয়ায় থাইল্যান্ড বেড়িয়ে এসেও গদগদ না হয়ে আবার ‘ঘরের বউ’ এর স্বীকৃতি চায়? এসব মেয়েদের সাথে রাত কাটানো যায়, কিন্তু ঘর বাঁধা যায় না এই সত্য ভুলে হ্যাপি কিনা, রুবেলের বউ হওয়ার বায়না করে? মেনে নেওয়া যায়? কাভি কাভি নেহি...তাই নারীকে চুপ করিয়ে রাখার, ব্ল্যাকমেইল করা পুরনো শর্টকাট পথেই হাঁটলেন সানি, রুবেল, ও আমাদের পুরুষরা। কিন্তু এই হ্যাপি-নাসরিনরা এতই বেয়াড়া যে, মানী লোকের মানটাও রাখতে জানে না। চরিত্র আর মানসম্মানের জুজুবুড়িকে একতুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে রুবেল-সানিদের ইজ্জতের মানচিত্রটা বদলে দিল একেবারে! নিপীড়ন, হয়রানি আর হুমকি উপেক্ষা করে লড়াইয়ের ময়দানে দাঁড়িয়ে গেলো রুবেল সানির এত এত ক্ষমতা আর টাকার মুখোমুখি! একেবারে চৌদ্দ শিক আর লাল-হলুদ রিমান্ড! কী বাজে মেয়েরে বাবা, পুলিশ পর্যন্ত ম্যানেজ করে ফেলে!
এবার আসল কথায় আসি। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অনলাইন পত্রিকাগুলোর সাংবাদিকতার মান নিয়ে কথা বলা সময়ের অপচয়। কিন্তু মূলধারার গণমাধ্যমের হাতেও কি নারী নিরাপদ? নারী কি গণমাধ্যমে মানুষ হিসেবে উপস্থাপিত হয়? একটি টিভি শো'র স্টুডিওতে রেকর্ডিং এর ফাঁকে চারজন নারীকে নিয়ে সাজু খাদেমের নোংরামি এবং তাকে সমর্থন দেওয়া নির্লজ্জ শিল্পী সমাজ আমাদের গণমাধ্যমেরই তো অংশ।
গুলতেকিন আহমেদ-এর একটি সাক্ষাতকার নিয়ে গণমাধ্যম কিভাবে প্রতিক্রিয়া করেছিলো তা আমরা দেখেছি যেখানে তিনি প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে কিছু নির্মম সত্য উচ্চারণ করেছিলেন। আমরা এও দেখেছি হুমায়ূন গুলতেকিন এর ঘর ভাঙার দায় একলা শাওনের ওপর চাপিয়ে কিভাবে তার চরিত্রের ব্যবচ্ছেদ করেছে এই গণমাধ্যম।
মিডিয়ার এই তথ্যসন্ত্রাসের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সংবাদকর্মীরাও। জয়স্রী জামানের দুই সন্তান আত্মহত্যার পর শোকাতুর জয়স্রীর চরিত্র হননে কিভাবে মাতাল হয়েছিল আমাদের গণমাধ্যম, তা আমরা ভুলে যাইনি। সাংবাদিক রুনি মরেও বাঁচতে পারেনি মিডিয়ার হাত থেকে। ২০১১ সালে স্বামীর হাতে নির্মমভাবে আহত হয়ে দৃষ্টি হারানো রুমানা মঞ্জুর, মিডিয়া যার জীবন্ত ময়নাতদন্ত করেছে কথিত ‘ইরানি’ বন্ধুর সঙ্গে রোমানা মঞ্জুরের ছবি আর সূত্রবিহীন মেইল প্রকাশ করে। এই তো কিছুদিন আগের ঘটনা। বনস্রীর মাহফুজা, নিজের কিশোরী মেয়ে আর শিশু পুত্রকে খুন করার দায় মাথা পেতে নিয়েছিল। ঘটনার কোনও ক্লু বের করতে না পেরে আমাদের মিডিয়া প্রচার করে দিলো পরকীয়ার কারণে সন্তানকে হত্যা করেছে। অবশেষে ‘মিতু’ কী অবিশ্বাস্য থ্রিলিং গল্প ফেঁদেছিল আমাদের মিডিয়া! ভাবলেই শিউরে ওঠি। তনু, যার সঙ্গে নাকি মরার আগে ‘সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স’ হয়েছিল, সে নাটক করতো, রাত করে বাড়ি ফিরতো, সে নাকি ২১টা সিম ব্যবহার করতো! দিনাজপুরের ইয়াসমিন, রাউজানের সীমা চৌধুরী এমন কী পাঁচ বছরের তানিয়া, কেউ রক্ষা পায়নি এই তথ্য সন্ত্রাস থেকে।
নারী বা নারী চরিত্র খোঁড়াখুঁড়ি মানেই ব্যবসা, এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক গণমাধ্যম। আজকে যখন ধর্ষিতা সমাজের ভয়ে কুঁকড়ে থাকে আর ধর্ষক বুক ফুলিয়ে ঘরে বেড়ায়, সেই দায় কি গণমাধ্যমেরও পড়ে না? সাংবাদিকতার শুরু থেকে সংবাদকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, সংবাদ তৈরিতে নারীকে যেমন করে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে নারী শুধুই মুনাফাদায়ী পণ্য। তাই পুরুষতান্ত্রিক স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটাতে আমাদের চলচ্চিত্র, বিজ্ঞাপন বা নাটকে যে কোনও অশ্লীলতা বা পুরুষের পদস্খলনের জন্য নায়িকা বা নারীকে দায়ী করার প্রবণতা বিস্তৃত হয়ে চলে এসেছে বাস্তব নারীর চরিত্র খনন করে ব্যবসা বাড়ানোর উপায়ে।
পুরুষতান্ত্রিকতার মুখপাত্র হয়ে আমাদের গণমাধ্যম পুরুষের ভাষায় কথা বলে, সংবাদ বা সচেতনতা ও সিনেমার ‘আইটেম’ গান বানিয়ে ফেলে। তাই স্তন ক্যানসার সচেতনতার বিজ্ঞাপনে নায়লা নাঈমের শরীর মূখ্য হয়ে ওঠে, সিনেমায় প্রতিশোধ নেওয়ার একমাত্র অস্ত্র হিসেবে নায়িকাকে উঠিয়ে নেওয়া বা ধর্ষণ করা দেখানো হয়, সাবানের বিজ্ঞাপনে বাথটাবে অর্ধনগ্ন নারী শরীর দেখানো হয়। এক ধর্ষণের শিরোনাম করতে গিয়ে যেভাবে – ধর্ষণ, গণধর্ষণ, রাতভর ধর্ষণ, নির্জন স্থানে ধর্ষণ, চলন্ত বাসে ধর্ষণ, কিশোরী ধর্ষণ, তরুণী ধর্ষণ, যুবতী ধর্ষণ, পাহড়ি নারী ধর্ষণ ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের বিশেষণ তৈরি করে, তখন সেই নারীকে পুরো পুরুষতন্ত্র দ্বারা ধর্ষণ করার সুযোগ করে দেয় পুরুষতান্ত্রিক মিডিয়ার ভাষা ও শব্দ ।
যতদিন মিডিয়া আমাদের শেখাবে, ওড়না ধরে টান দেওয়া বা জোর করে চুল খুলে ফেলার নামই রোমাঞ্চ; যতদিন ‘আরসির মজা কতো, তোমার মতো, যখন যেমন চাই’ হবে বিজ্ঞাপনের ভাষা, যতদিন রুবেলের মুখে 'এরপর আর কেউ বাঁচাইতে পারবো না, ডাইরেক্ট ভাইঙ্গে দিবানি”... উচ্চারণ করবে আমাদের বিজ্ঞাপন, ততদিন সব কিছু এভাবেই ভেঙে পড়বে, কেউ বাঁচাতে পারবে না। ভেঙে পড়বে অপরাধকে অপরাধ বলার ক্ষমতা, ভেঙে পড়বে নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার মনোবল, ভেঙে পড়বে ধর্ষণের (ধর্ষিতার নয় শুধু) বিচার করার সামাজিক শক্তি, ভেঙে পড়বে ব্যক্তিগত সম্পর্কের অন্তরঙ্গ মুহূর্তকে ফেসবুকের খোলা পাতায় নিয়ে আসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা।
এই ‘ভেঙে দেওয়া’ বা ‘যখন যেমন চাই’ আসলে রাজনৈতিক ভাষা। যে রাজনীতি পুরুষের একক ক্ষমতা ও শক্তি চর্চার কথা প্রচার করে। যেমন সদ্য নারী নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত একজন জামিন পেয়েই ‘সব কিছু ভাইঙ্গা’ দিচ্ছেন মানে ক্ষমতা প্রকাশ করছেন। বিজ্ঞাপনে রুবেলের বডি ল্যাংগুয়েজ বলছে, যে ক্ষোভে তিনি ভাঙছেন, সেই ক্ষোভে তিনি বিজ্ঞাপনের বাইরেও অনেক কিছু ভাঙতে চাচ্ছেন। ঠিক তেমনি ‘দেখবেন, ধরবেন আর চেক করবেন’ এ নারী শরীর আর এক্সপ্রেশন দিয়ে নায়লা নাইম কিন্তু বলেছেন পুরুষের যৌন ইচ্ছা আর শক্তি প্রদর্শনের কথা। যেমনটি শক্তির মহড়া দেখাতে গিয়ে বডি স্প্রের বিজ্ঞাপনে ক্যাপশন থাকে মেড ফর মেন, ওয়ার্ক অন উইমেন; পুরুষের ফেয়ারনেস ক্রিম হাতে নিয়ে শাহরুখ খান বলেন, ‘পুরুষের একটু বেশি বেশি চাই…’।
পুরুষের একটু বেশি চাই বলেই আমাদের ‘হিরো’ রা গাছের ওপরেরটা ধরার জন্য সব ভেঙে দেন আর আমাদের নাসরিন, হ্যাপিরা গাছের তলারটা হয়ে মাটিতে পড়ে থাকেন। আর মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে নারী চরিত্রের ময়না তদন্ত করে ‘সংবাদ-পণ্য’ করে ফুলে উঠতে থাকে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক মিডিয়া। কিন্তু আর কত? ভিকটিম ব্লেইমিং বা শ্লাট শেইমিং এর শর্টকাট ব্যবসা বন্ধ করে একটু মানুষের বেদনা, রাগ অনুভূতি দিয়েই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কাজ করুন না। তাহলেই অপরাধীকে অপরাধী হিসেবেই দেখতে পাবেন। হোক না সে অপরাধী সানি কিংবা নাসরিন।
লেখক: কলামিস্ট; প্রধান নির্বাহী, সংযোগ বাংলাদেশ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ