X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রশ্নটি পুলিশের বই পড়া নিয়ে নয়

হারুন উর রশীদ
৩১ জানুয়ারি ২০১৭, ১৫:৩৯আপডেট : ৩১ জানুয়ারি ২০১৭, ১৬:৩৩

হারুন উর রশীদ বইমেলার আগেই আলোচনায় এসেছে ‘পুলিশের বই পড়া’ নিয়ে একটি খবর। আর তা হলো এবার নাকি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি দল বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের ওপর নজর রাখবে। এই নজরদারির উদ্দেশ্য ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে’- এমনসব বইকে আইনের আওতায় আনা।
এই খবরটি বাংলা ট্রিবিউনসহ আরও অনেক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আর খবরের উৎস হিসবে উদ্ধৃত করা হয়েছে বাংলা একাডেমির সচিব মো. আনোয়ার হোসেনকে। তিনি আরও বলেছেন, পুলিশ এ ধরনের বইয়ের বিরুদ্ধে নিজেদের উদ্যোগে ব্যবস্থাতো নেবেই, বাংলা একাডেমি’র নজরে এ ধরনের বই এলে তারাও পুলিশকে খবর দেবেন। তাহলে যা দাঁড়ালো এবার বাংলা একাডেমি’র অমর একুশে বইমেলায় যেসব বই প্রকাশিত হবে বা বিক্রির জন্য রাখা হবে, তার সবই পুলিশের নজরদারির আওতায় চলে গেলো। আর এই নজরদারির প্রক্রিয়াটা কেমন হবে, তা এখনও স্পষ্ট না হলেও সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদ মাধ্যম খবর দিয়েছে, ‘পুলিশের একটি দল বই পড়ে দেখবে’। আর শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুবকর সিদ্দিক জানিয়েছেন, তারা এরইমধ্যে প্রেসে প্রেসে গিয়ে যেসব বই প্রকাশিত হচ্ছে, সেগুলো দেখছেন, নজরদারি করছেন। তাহলে বোঝা গেলো জ্ঞানপিপাসা বা আনন্দ লাভের জন্য পুলিশ বই পড়ার এই উদ্যোগ নেয়নি। তারা খুঁজবেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের বিষয়। আর এই বিষয়টি বেশ সিরিয়াস। এখানে তাই কয়েকটি প্রশ্নের জবাব পাওয়া জরুরি।
১. বইমেলা উপলক্ষে প্রতিবছর কমবেশি চার হাজার বই প্রকাশিত হয়। এছাড়া পুরনো হাজার হাজার বইতো আছেই। পুলিশ কি সব বই পড়বে?
২. একমাসের মধ্যে হাজার হাজার বই পড়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো জনবল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কি আছে?
৩. জনবল থাকলেও তারা কি বই পড়ে বিষয় বিবেচনার জন্য দক্ষ ও প্রশিক্ষিত?
৪. সরাসরি পুলিশ সদস্যদের এই নজরদারি এবং ব্যবস্থা নেওয়ার আইনগত বৈধতা আছে কি?
৫. তারা কি এসব বই কিনে পড়বেন, না ফ্রি নিয়ে যাবেন?
৬. এই কাজে পুলিশ বাংলা একাডেমির অনুমতি নিয়েছে?
পুলিশ বই পড়বে, তা নিয়ে লেখক-প্রকাশক কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়। আমি এ নিয়ে যতজন লেখক ও প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা সবাই বলেছেন, এটা আনন্দের খবর। বইয়ের পাঠক বাড়বে। বই বিক্রি বাড়বে। ব্যবসাও ভালো হবে। তবে এটা যেন পাঠক হিসেবে হয়। এটা ব্যবস্থা নেওয়া বা আইনি পদক্ষেপের জন্য হলে তাদের আপত্তি আছে। তাদের সোজা কথা, বইয়ের ওপর নজরদারি বা আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পুলিশ কোনও কর্তৃপক্ষ নয়। এজন্য দেশে আইন আছে, কর্তৃপক্ষ আছে। প্রকাশকরা বই প্রকাশের পর নিয়ম মেনে তাদের বই সেখানে জমা দেন। তাই পুলিশের নতুন এই তৎপরতায় তারা উদ্বিগ্ন এবং শঙ্কিত।
বাংলাদেশ কেন পৃথিবীর কোনও দেশেই প্রকাশককে বই প্রকাশ করতে আলাদা কোনও অনুমতি নিতে হয় না। তবে বই প্রকাশের পর সেই বইয়ের বিষয়বস্তুর কারণে কেউ বা কোনও পক্ষ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তারা প্রতিকার চাইতে পারেন, আদালতে যেতে পারেন। আমাদের দেশে আদালতের বাইরে প্রিন্ট অ্যান্ড পাবলিকেশন অ্যাক্টে সরকারও সরাসরি বই নিষিদ্ধ বা বাজেয়াপ্ত করতে পারে। যেমন, হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তাহলে পুলিশকে বইমেলা সামনে রেখে কেন নজরদারির ঘোষণা দিতে হবে? প্রকাশকতো তার বইয়ের কপি সরকারে সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা দেন। আর বইমেলার সময় বাংলা একাডেমিতেও জমা দেন। তা দেখার জন্য সরকারে এবং বাংলা একাডেমিতে লোক আছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে কেন বাড়তি চাপ নিতে হবে?
আমার মনে হয় এর একটি উদ্দেশ্য আছে। আর তা হলো প্রকাশক ও লেখকদের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করা। তাদের সেল্ফ সেন্সরে ফেলে দেওয়া। কিন্তু এতে ক্ষতি হবে মুক্তচিন্তা ও বই প্রকাশের স্বাধীনতার। কারণ ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ লাগার বিষয়টি আপেক্ষিক। আর এর কোনও আইনগত সংজ্ঞাও নেই। ফলে একজনের কাছে যা আঘাত আরেকজনের কাছে তা যৌক্তিক বিশ্লেষণও হতে পারে। প্রকাশকরা ভয় পেয়ে কোন বই প্রকাশ করবেন আর কোন বই প্রকাশ করবেন না, তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে যাবেন। এই বিভ্রান্তি এড়াতে তারা কার কাছে যাবেন, কী করবেন তারও কেন গাইডলাইন নেই। থাকার কথাও নয়।
আর পুলিশ যে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’-এর বিষয় খুঁজবে তার বা নীতিমালা কী? পুলিশের কাছে কি কোনও অনুমোদিত নীতিমালা আছে? সরকার কি কোনও নীতিমালা ঘোষণা করেছে? আমার জানামতে এ ধরনের কোনও নীতিমালা নেই। আর তাই যদি হয়, তাহলে এই নজরদারি বা আইনগত ব্যবস্থা হবে অন্ধের হাতি দেখার মতো। কারণ অনুসন্ধান বা নজরদারিতে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরা যার যার ব্যক্তিগত ইচ্ছা এবং চিন্তা অনুযায়ী কাজ করবেন। আর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার বিষয়তো সব ধর্মের জন্যই সমান। নজরদারিতে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরা কি সব ধর্ম সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান রাখেন?
এরইমধ্যে প্রকাশক এবং লেখকদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ অতীতে দেখা গেছে, পুলিশ শুধু বই জব্দ বা বাজেয়াপ্ত নয়, বইয়ের প্রকাশক, লেখক, বিক্রয়কর্মী সবাইকে আটক করে। স্টল বন্ধ করে দেয়। আর মামলা দেয় তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায়। পুলিশের কাছে এখন এই আইনটি একটি সহজ অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। ২০১৬ সালের বই মেলায় ব-দ্বীপ প্রকাশনীর ‘ইসলাম বিতর্ক’ বইটি শুধু বাজেয়াপ্তই করা হয়নি, বইয়ের লেখক ও প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিকসহ চারজনকে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় গ্রেফতারও করা হয়েছে। স্টলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই মামলায় চার্জশিটও দেওয়া হয়েছে। মানিক এখনও কারাগারে আটক আছেন। তার বিরুদ্ধে প্রিন্ট অ্যান্ড পাবলিকেশন আইনে মামলা করা যেত। পুলিশ সেটা না করে বিতর্কিত তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করে। আর প্রকাশনা সংস্থাটি একবছর ধরে বন্ধ রয়েছে।
এর আগে ২০১৫ সালে অমর একুশে গ্রন্থ মেলায় রোদেলা প্রকাশনী নামের একটি প্রকাশনা সংস্থারও স্টলও বন্ধ করে দেয় মেলা কর্তৃপক্ষ। তখন ‘নবী মোহাম্মদের ২৩ বছর’ বইটি নিষিদ্ধ করা হলেও কাউকে আটক করা হয়নি।
শ্রাবণ প্রকাশনীর কর্ণধার রবিন আহসান এসবের প্রতিবাদ করেছিলেন। বিশেষ করে শামসুজ্জোহা মানিককে গ্রেফতারের প্রতিবাদ করে বাংলা একাডেমির রোষের শিকার হন। বাংলা একাডেমি এবারের বইমেলায় শ্রাবণ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অবশ্য লেখক- প্রকাশকদের প্রতিবাদের মুখে সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে শেষ পর্যন্ত শ্রাবণকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
কয়েকজন প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুলিশ আগে থেকেই বই মেলার বইয়ের ওপর নজদারি করে আসছে। এবার তা প্রকাশ্যে ঘোষণার পর তারা তা বুঝতে পারছেন। তারা জানান, গত দুই বছর ধরে পুলিশ দল বেধে বইয়ের স্টলে যায়, জানতে চায় কোন বইয়ে কী লেখা আছে। প্রকাশক সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়, বই উল্টে পাল্টে দেখে। দু’একটি লাইন পড়ে তার মানে জানতে চায়। আর সবশেষে তাদের পছন্দের কিছু বই ফ্রি নিয়ে যায়। আর এবার হয়তো তারা বিষয়টি আনুষ্ঠানিক করলো। কিন্তু বইয়ের ওপর পুলিশের এই নজরদারি-খবরদারি তাদের বই ব্যবসা নিয়ে ভাবিয়ে তুলেছে।
লেখকরা সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর চিন্তার মানুষ। তারা বহুমাত্রিক। তাদের চিন্তা ও ভাবনা সাধারণ মানুষের সাধারণ চিন্তা নয়। তারা একটি সাধারণ ঘটনাকেই অসাধারণভাবে দেখতে পারেন। তাই সৃজনশীলতার কোনও নিয়মে বাঁধা যায় না। যায় না কোনও আইনে নির্দিষ্ট করে দেওয়াও। চিন্তার কোনও সীমানা নাই আর এর ভিন্নতার কোনও সংখ্যা নাই। সভ্যতা চিন্তার বহুমাত্রিকতা, ভিন্নতা আর নানা দৃষ্টিকোণ ধরেই এগিয়ে গেছে। আমরা যা চিন্তাও করতে পারি না, তাই লেখকরা আমাদের সামনে হাজির করেন। আমরা যা ভাবিও না তারা তাই নিয়ে ভাবনার নতুন জগৎ সৃষ্টি করেন। একেকজন লেখক একেকটি নতুন পৃথিবী। সেই পৃথিবী নিয়ে নজরদারি করার দায়িত্ব আমরা কাকে দেব, সেটাই প্রশ্ন। আর এই নজরদারির আদৌ প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।
পুলিশের এই নতুন নজরদারি নিয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক নাকি অন্ধকারে আছেন। তিনি কিছুই জানেন না। আর তিনি এ ধরনের নজরদারিকে নাকি উৎসাহিতও করেন না। তবে পুলিশ যদি কিছু করে তাতে তার কিছু আবার বলারও নেই। এখানেই হলো ধরি মাছ না ছুঁই পানি। মহাপরিচালকের এই অবস্থান স্পষ্ট নয়, অস্বচ্ছ। তার অবস্থান পরিষ্কার হওয়া দরকার, বই প্রকাশের স্বাধীনতা, লেখকের স্বাধীনতা, পাঠকের স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার স্বাধীনতার পক্ষে।
বাংলা একাডেমি বলছে সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনও বইয়ে রাষ্ট্রবিরোধী কিছু আছে কিনা, তা দেখে। পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) এটা নজরে রাখে। সেই কাজতো সরকার করবে। আমার কথা হলো নতুন করে তাহলে আতঙ্ক ছড়াতে হবে কেন? আর সরকার বিরোধী এবং রাষ্ট্রবিরোধী বিষয় দু’টি আলাদা। সরকার বিরোধিতা মানে রাষ্ট্রবিরোধিতা নয়।
আমরা এবার নতুন পাঠ্যপুস্তকে দেখেছি নানা পরিবর্তন। ওড়না নিয়ে বিতর্ক শুরু হলেও আসলে মূল জায়গা সেটা নয়। মূল জায়গা হলো ধর্মান্ধতার কাছে নতি স্বীকার। আর বইমেলায় তার প্রভাব দেখতে পাচ্ছি। ওই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে খুশি করতে এবার বইমেলায় বইয়ের ওপর পুলিশের নজরদারির ঘোষণা। আইনের বাইরে গিয়ে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’-এর বিষয় খুঁজতে নামছে পুলিশ। আর প্রশ্নটি এখানেই। পুলিশ বই পড়বে তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন থাকতেও পারে না।

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: [email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বার্সার বিদায়ে কান্সেলোর অনাগত সন্তানেরও মৃত্যু কামনা করেছেন সমর্থকরা!
বার্সার বিদায়ে কান্সেলোর অনাগত সন্তানেরও মৃত্যু কামনা করেছেন সমর্থকরা!
পাগলা মসজিদের দানবাক্সে এবার মিললো ২৭ বস্তা টাকা
পাগলা মসজিদের দানবাক্সে এবার মিললো ২৭ বস্তা টাকা
বিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
উপন্যাসবিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
ইরান-সমর্থিত ইরাকি সেনা ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ, নিহত ১
ইরান-সমর্থিত ইরাকি সেনা ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ, নিহত ১
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ