X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

সার্চ কমিটি ও বিএনপির বিতর্কের রাজনীতি!

আশরাফ সিদ্দিকী বিটু
০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৭:০২আপডেট : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৭:০৪

আশরাফ সিদ্দিকী বিটু নতুন  নির্বাচন কমিশন গঠন প্রসঙ্গে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার জন্য বিএনপি প্রথম দাবি জানায়।  রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বিএনপির সঙ্গেই প্রথম আলোচনা করেন। রাষ্ট্রপতি গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩১টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন, সবার অভিমত নেন। এরপর তিনি ২৫ জানুয়ারি ৬ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করেন। এই কমিটিতে একজন নারী প্রতিনিধিকেও রাখা হয়। যাকে শুভ উদ্যোগ বলছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। কমিটি ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে পাঁচ জন করে নাম আহ্বান করে এই কমিটি। পাশাপাশি দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সঙ্গেও আলোচনা করেছে। দলগুলো নামও প্রস্তাব করেছে। আশা করা যাচ্ছে, চলতি (ফেব্রুয়ারি) মাসের শুরুতেই প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।
২০১২ সালের ২২ জানুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের উদ্যোগে প্রধান নির্বাচন কমিশনরাসহ নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি সিইসিসহ চারজনকে নিয়োগ দেওয়া হয় আর একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি। ২০১২ সালের সার্চ কমিটির কাছে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত আওয়ামী লীগসহ ২৩টি দল নাম পাঠায়। বিএনপিসহ ১৬টি দল কোনও নাম প্রস্তাব করেনি। বিএনপি ও তাদের জোটের দলগুলো সেই সার্চ কমিটির বিরোধিতা করেছিল। বিএনপি এবার নাম দিয়েছে। কিন্তু নতুন সার্চ কমিটি গঠনের পর সমালোচনা করছে এবং অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টাও করছে।
সার্চ কমিটি গঠনের আগে বিএনপি চেয়েছিল স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াত ও জাতির পিতার হত্যাকারীদের দল ফ্রিডম পার্টির সঙ্গে রাষ্ট্রপতি আলোচনা করুক। রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জানাই তিনি কোনও স্বাধীনতাবিরোধীদের  দল এবং খুনিদের দলকে আলোচনায় ডাকেননি।
বিএনপি যখন নির্বাচন বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে তখন তাদের অতীত কর্মকাণ্ড সামনে চলে আসে। সেনা ছাউনিতে জন্ম নেওয়া দলটি শুরু থেকেই দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনি ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করেছে, নির্বাচনকে কলুষিত করেছে।
১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করার পর ‘হ্যাঁ/না’ ভোট করেছিলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি একেএম নুরুল ইসলাম, যিনি পরে সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের আইনমন্ত্রী হন। হ্যাঁ/ না ভোটে অনেক স্থানে শতভাগের বেশিও ভোট কাস্ট দেখানো হয়। এরশাদের সময়েও ভোটে কারচুপির দৃশ্য একই ছিল।বিএনপির নেতৃত্বেই ভোটের সময়ে ভোটারের ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে, সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করা হয় এবং অনেককে দেশ ছাড়তেও বাধ্য করা হয়েছে। ২০০১ এর নির্বাচনের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন কেউ ভোলেনি।

খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচন করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের এমপি ও বিরোধীদলীয় নেতা বানানো হয়। ২০০১ সালে বিএনপি ও জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে তাদের পুরনো চরিত্র অনুযায়ী বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন গঠন করে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এমএ আজিজ (২০০৫ থেকে ২১.০১.২০০৭)-এর সময়ে কলঙ্কজনকভাবে ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কয়েকটি অগ্রহণযোগ্য ও কারচুপির নির্বাচন হওয়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত বিতর্কিত কমিশনাররাও ১ বছরের মধ্যে পদত্যাগ করেন।

২০০৮ এর নির্বাচনের আগে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা হয়। আওয়ামী লীগের প্রস্তাবনার আলোকেই স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা করা হয়, যেন ভুয়া ভোটার অন্তর্ভুক্তি বন্ধ হয়। ফলে এক ব্যক্তি একাধিক নামে বা একাধিক জায়গায় ভোট দিতে পারবেন না।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার যখনই মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরু করে, তখনই  সরকার পতনের জন্য নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বিএনপি ও জামায়াত দেশে আন্দোলনের নামে হত্যাযজ্ঞ চালায়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখেও বিএনপি-জামায়াত আবারও সহিংসতার পথ বেছে নেয়। ২০১৪ সালের পাঁচ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনকালীন একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন। বিএনপি-জামায়াত জোট নেত্রী সে প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে সারাদেশে ত্রাসের সৃষ্টি করে। পেট্রোলবোমা, অগ্নিসংযোগ, বোমা হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা করলেও নির্বাচন বন্ধ করতে পারেনি। ২০১৫ সালের প্রথম চার মাসেও মানুষ হত্যার ঘৃণ্য খেলা চলে। প্রশ্ন হলো, এভাবে মানুষ পুড়িয়ে কী পেলো তারা? এর উত্তর বিএনপি নেত্রী কোনও দিন দিতে পারবেন না!

নানা জল্পনা-কল্পনার ইতি ঘটিয়ে সার্চ কমিটিতে বিএনপি নাম প্রস্তাব করলেও নির্বাচন কমিশন নিয়ে আইন করার বিষয়ে কোনও প্রস্তাবনা দেয়নি; ক্ষমতায় থাকতে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। তারা এখনই আইন চান না; ইলেক্ট্রনিক ভোটিং সিস্টেমও না। বিএনপি কি ভাবছে আইন হলে তাদের ক্ষতি! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামীতে নির্বাচন কমিশন বিষয়ে আইন হলে দেশের গণতন্ত্রের জন্যই মঙ্গল হবে।

সার্চ কমিটি নিয়ে বিএনপির সমালোচনা বা বিতর্ক করা কতটা বাস্তব সম্মত, তা বোধগম্য নয়। তবে আগেভাগে বিতর্ক সৃষ্টি করে রাখলে হয়ত তাদের সুবিধা হবে নতুন নির্বাচন কমিশনকে প্রত্যাখ্যান বা আগামী নির্বাচন বর্জনের জন্য। ধারণা করা যায়, তাদের অযৌক্তিক ১৩ দফা দাবি থেকেই এই অপচেষ্টার শুরু।

আরেকটি বিষয়, কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে বিএনপির কাছে কোন ব্যক্তি  নিরপেক্ষ, তা বলা অসম্ভব। কারণ সবাই নিরপেক্ষ বললেও বিএনপি হয়ত মানবে না। কোনও কিছু মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি বিএনপির মাঝে নেই। বরং অন্যের ওপর অনৈতিক ও অযোগ্য ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়াই তাদের কাজ। বিতর্ক ও বিভ্রান্ত সৃষ্টিই যেন তাদের রাজনীতি। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিএনপি যতই বিতর্ক করার চেষ্টা করুক বা রেষারেষি করুক, এতে তারা লাভবান হবে না। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলে ক্ষতি তাদেরই। কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় বিদেশিদের ডেকে আনা বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের পরিচায়ক হবে। দেশের মানুষকেই অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান করতে হবে।

বিএনপিকে মনে রাখতে হবে যে নির্বাচন কমিশন গঠন রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক দায়িত্ব। দেশের সবাই চায় গ্রহণযোগ্য কমিশন এবং এতে বিএনপির ভূমিকারও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। নতুবা প্রমাণিত হবে, তারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না। কিন্তু নিজের মনের মতো না হলে আন্দোলন করতে হবে তা গণতন্ত্রের জন্য শোভন নয়। সেজন্যই হয়ত আওয়ামী লীগসহ অন্যরা আইন করার পক্ষে মত দিয়েছে। বিএনপির মনের মতো কমিশন না হলে দলের নেতারা আন্দোলনের হুমকিও দিচ্ছে। তাদের আন্দোলন মানেই জ্বালাও-পোড়াও আর মানুষ হত্যা। ভবিষ্যতে কোনও ধ্বংসলীলা দেশবাসী আশা করে না। দেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালীকরণ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, জনগণের অধিকার নিশ্চিত করতে জ্বালাও-পোড়াও কোনও সমাধান হতে পারে না।

সার্চ কমিটির সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেওয়া বিশিষ্টজনেরা সৎ, দক্ষ, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ, নির্দলীয় ও দায়িত্ব পালনে সক্ষমব্যক্তিদের কমিশনে চেয়েছেন। সকলের প্রত্যাশা সার্চ কমিটি যোগ্য, প্রগতিশীল, মুক্তিযু্দ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ও সক্ষম ব্যক্তিদেরই নাম প্রস্তাব করবে। বিশ্বাস করি, কোনও স্বাধীনতাবিরোধী বা  তাদের বংশধরদের কেউ কমিশনে থাকবে না। শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য কমিশন গঠনে যোগ্যদেরই নিতে হবে নতুবা ‘আজিজ মার্কা’ কমিশন আমাদের সেই পুরনো অন্ধকার পথই দেখাবে।

নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। যার মূল দায়িত্ব হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান। দেশে স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সুষ্ঠু নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই কমিশনকে নির্বাচন অনুষ্ঠানে অধিকতর সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে, যেখানে অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তির সম্মিলন থাকবে। পুনর্গঠিত কমিশনের অধীনেই আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। আমরা চাই সবার অংশগ্রহণে অবাধ, স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন; যার মাধ্যমে অপরাজনীতির পথ রুদ্ধ হবে এবং দেশের গণতন্ত্রের মর্যাদা সমুন্নত থাকবে।

লেখক: পরিচালক, সিআরআই।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মেটা-ডেমোক্র্যাসি ইন্টারন্যাশনালের ডিজিটাল সুরক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ
মেটা-ডেমোক্র্যাসি ইন্টারন্যাশনালের ডিজিটাল সুরক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো যুবকের
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো যুবকের
ড. ইউনূস মহাসমুদ্র, তিনি কেন পুকুর চুরি করবেন: দাবি আইনজীবীর
ড. ইউনূস মহাসমুদ্র, তিনি কেন পুকুর চুরি করবেন: দাবি আইনজীবীর
ভারতীয় শাড়ি দিয়ে কাঁথা সেলাই করা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে রিজভী
ভারতীয় শাড়ি দিয়ে কাঁথা সেলাই করা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে রিজভী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ