X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

অস্থির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি: কারা, কেন, কিভাবে?

মাসুদা ভাট্টি
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:০১আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:১৯

মাসুদা ভাট্টি বোঝা যাচ্ছে দেশে নতুন অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা শুরু হয়েছে, যদিও বোঝা যাচ্ছে না এর অন্তে ঠিক কী আছে। কারণ, আগামী কয়েক মাসে দেশের রাজনীতিতে নতুনতর সংযোজন ঘটবে সন্দেহ নেই। বিশেষ করে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনসহ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান বিচার প্রক্রিয়ার রায় ঘোষণাসহ বেশ কিছু আলোচিত ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে কয়েক মাসের মধ্যেই। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই দেশকে খানিকটা অস্থিতিশীল করা গেলে যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে এ যাবত চালিয়ে আসছিলেন নিজেদের কোটারি রাজনীতি, তাদের জন্য সেটা সুবিধা বৈ অসুবিধের হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকারের ভেতর কেন অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে? বিশেষ করে সরকারি দলের ভেতর? এবং আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হবে, কেন দলকে সর্বত্র দৃষ্টিকটুভাবে দৃশ্যমান করে তোলা হচ্ছে? কারা করছেন? কেন করছেন? এবং কিভাবে করছেন? আজকের আলোচনা এসব নিয়েই।
তবে আলোচনা শুরুর আগে দেশে সাংবাদিক হত্যা নিয়ে কিছু কথা বলতেই হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে যখন দেশে সাংবাদিক মানেই ক্ষমতাসীনদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল তখন প্রায়ই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গিয়ে সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়াতেন। আক্রান্ত সাংবাদিকগণ ও তাদের পরিবারের সদস্যবৃন্দ শেখ হাসিনার কাছে গেলে তিনি তার সাধ্যমতো সাহায্য সহযোগিতা করতেন। এমনকি তিনি ক্ষমতায় আসার পর আহত ও নিহত সাংবাদিকদের পরিবারের সদস্যদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া ছাড়াও তিনি তাদের নানাবিধ সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছেন বলে জানা যায়। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, শেখ হাসিনার সরকারের আমলেও দেশে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন হয়েছে এবং নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন একাধিক সাংবাদিক, এবং তার চেয়েও বড় কথা হলো সাংবাদিক নির্যাতনের লোক দেখানো বিচার হয়েছে ঠিকই কিন্তু এখনও আক্রান্ত সাংবাদিকরা ন্যায় বিচার বলতে যা বোঝায় তা পাননি। উদাহরণ হিসেবে আমরা সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির নাম করতে পারি যারা তাদের নিজেদের ঘরের ভেতর তাদের একমাত্র সন্তানের সামনে নৃশংসভাবে ভাবে নিহত হন, আজ অবধি সেই হত্যাকাণ্ডের কোনও কূল-কিনারা করা গেলো না। এই দায় কেউ সরকারের ওপর দিচ্ছে না, কিন্তু হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন রাষ্ট্রের দায় ও দায়িত্ব। কিন্তু সে দায় ও দায়িত্ব পালনে কোথায় যেন গড়িমসি লক্ষ্য করা যায়। প্রায়ই সাংবাদিকদের ওপর নেমে আসছে পুলিশি নির্যাতন, তুচ্ছ কারণে সরকারের পুলিশ চড়াও হচ্ছে সাংবাদিকদের ওপর এবং তারপর তাদেরকে বেধড়ক পেটানো হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে সরকার দলের এমপিদের কারও কারও সাংবাদিকদের ওপর কুপিত হওয়ার ঘটনা। কিন্তু সর্বশেষ সাংবাদিক-হত্যার ঘটনাটি এতোটাই ভয়ঙ্কর যে, এটি উল্লেখেও হাত কেঁপে ওঠে। সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলায় আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষ চলাকালে মাথায় গুলি লেগে সিরাজগঞ্জ জেলার সমকাল প্রতিনিধি শিমুল গুরুতর আহত হলে ঢাকায় নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। স্বাভাবিক ভাবেই এই হত্যাকাণ্ডের দায় ‘এ-ও-তার ঘাড়ে’ চাপানোর চেষ্টা চলছে কিন্তু তাতে সত্য বদলাবে না। সাংবাদিক শিমুল মারা গেছেন এবং এর দায় দল হিসেবে আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে কারণ এই মৃত্যু দলের দু’টি বিবাদমান গ্রুপের ভেতর সংঘর্ষের কারণে ঘটেছে।
শিমুলের সঙ্গে আমার সামান্য পরিচয় ছিল। সিরাজগঞ্জ শহরে একটি ওয়ার্কশপে অংশ নিতে গিয়ে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তিনি সে সময় টেলিফোন নম্বর সংগ্রহ করে রেখেছিলেন, বছর খানেক আগে তার সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল কিংবা হয়নি, সে তথ্য এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি- তা হলো, তিনি নিহত হয়েছেন এবং সেটা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ঘটা হামলা ও পাল্টা হামলার কারণে। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাৎক্ষণিকভাবে সাংবাদিক শিমুল হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু আগেই বলেছি যে, সরকার কথায় আন্তরিক হলেও কাজে আন্তরিক বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি, বিশেষ করে সাংবাদিক নিগৃহীত হওয়ার ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে এখন অবধি কোনও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের খবর এই মুহূর্তে ঠিক উল্লেখ করতে পারছি না। সুতরাং, ওবায়দুল কাদেরের প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করতে চাইলেও বিশ্বাস করার সুযোগ এখানে কম। তাহলে? আবারও স্মরণ করতে চাই বিএনপি-জামায়াত জোট আমলের কথা। যখন একের পর এক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন দেশময় দলটির নেতাকর্মীদের হাতে। আর যখন সেই সময়কার বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের দিকে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তখন স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি-জামায়াত সরকারের ওপর থেকে সাংবাদিকদের আস্থা কমতে কমতে ক্রমশ শূন্যে মিলিয়ে গেছে। এই মুহূর্তে যেভাবে দেশে সাংবাদিকদের ওপর সরকারি দলের নেতাকর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এবং পুলিশের হাতে যেভাবে সাংবাদিকরা নির্যাতিত হচ্ছেন তাতে এই সরকারের ওপর থেকেও যে সাংবাদিকরা মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন, তাতে কারও সন্দেহ থাকলে তিনি ব্যক্তি উদ্যোগে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।
এই লেখাটি যখন লিখছি তখন খুলনার ফুলতলা এলাকায় এক কথিত যুবলীগ নেতাকে গুলি করে ও বোমা মেরে হত্যা করা হয়েছে। যদিও স্থানীয় যুবলীগ নেতৃবৃন্দ বলেছেন যে তিনি যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত না থাকলেও তিনি আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি যুবলীগ নেতা ছিলেন কী ছিলেন না সেটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে দেশের সর্বত্র কেন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি একটু একটু করে ভেঙে পড়ছে সেটিই উচ্চারিত হচ্ছে সবার মুখে। কেবলমাত্র সরকার ও সরকারি দল এখনও বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছে বলে বিশ্বাস হয় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘পুলিশের সঙ্গে সাংবাদিকদের ঠেলাঠেলি’ দেখেন প্রথমে তারপর ‘খোঁজ-খবর নিয়ে’ দেখেন যে, সত্যিই পুলিশ সাংবাদিকদের পিটিয়েছে এবং তিনি সে জন্য অনুতাপ করেন মিডিয়ার সামনে। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ব্যাপার, কারণ ভুল স্বীকারের রাজনৈতিক উদাহরণ এদেশে তেমন নেই, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেটি করেছেন, সেজন্য তাকে ধন্যবাদ। কিন্তু পরিপূর্ণ ধন্যবাদটি তাকে দিতে হলে তাকে অবিলম্বে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার সঙ্গে সঙ্গে তার দলের নেতাকর্মীদের হাতে যাতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনোরূপ অবনতি না ঘটে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদ চালু আছে, সেটি হলো ‘কচু গাছ কাটতে কাটতে একদিন পোলায় ডাকাইত হইবো’, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আওয়ামী লীগের ‘পোলারা’ কচুগাছ কাটতে কাটতে এখন ‘ডাকাইত’ হতে শুরু করেছে, যা সত্যিই ভয়ঙ্কর।
হ্যাঁ, ওপরে এই ‘ডাকাইত’ হওয়ার কথা বলতে বলতে একথাও জোর দিয়েই বলতে চাইছি যে, অত্যন্ত সুকৌশলে আওয়ামী লীগের ভেতরে একদল ‘ডাকাইত’ ঢুকেও পড়েছে। কারণ পর পর দু’বার ক্ষমতার বাইরে থাকার মতো রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক দৃঢ়তা জামায়াত-বিএনপি’র নেই, ফলে তারা আশ্রয় নিয়েছে এসে আওয়ামী লীগে। আর আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্ব তাদেরকে কখনও সামান্য কখনওবা ‘অসামান্য’ অর্থের বিনিময়ে আওয়ামী লীগের বুকে টেনে নিয়েছে, অতীতের সমস্ত ‘রগকাটা’র স্মৃতি ভুলে গিয়ে। এখন অনেক ক্ষেত্রেই (সবক্ষেত্রে নয়, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধোয়া তুলসিপাতা মনে করার কোনোই কারণ নেই) সেইসব ‘কচুগাছ কাটিয়েদের’ (যারা আওয়ামী লীগের ভেতরে ও বাইরে ডাকাতি করার লক্ষ্য নিয়েই সেখানে ঢুকেছে) দেখছি বন্দুক-বোমা-চাপাতি হাতে কখনও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হচ্ছে, কখনও সাংবাদিক নির্যাতন করে জাতীয় সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষও আওয়ামী লীগের উন্নয়ন নয়, কেবলমাত্র এই অত্যাচার-অনাচারকেই দেখতে পাচ্ছে; যদিও তারা জানতেও পারছে না যে, ঘটনা আসলে ঘটাচ্ছে কোন ডাকাত, প্রকৃত আওয়ামী লীগের ডাকাত? নাকি অন্য দল থেকে ‘মাল্টিপল উদ্দেশ্য’ নিয়ে আওয়ামী লীগে ঢোকা ডাকাত? দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্ব বিষয়টি নিয়ে বহুবার কথা বলেছেন, কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হয়নি। যে কারণে শুরুতেই বলেছি যে, আগামী কয়েক মাস দেশের জাতীয় রাজনীতিতে অনেকগুলো নতুন ঘটনাকে সামনে রেখে নতুন করে অস্থিরতা শুরু হয়েছে, তবে দুঃখের বিষয় হলো অস্থিরতা অন্যান্য দলের চেয়ে ক্ষমতাসীন দলেই যেন বেশি চোখে পড়ছে। কেন এটা হচ্ছে এবং কাদের দ্বারা এসব হচ্ছে, সেকথা এতোক্ষণে আশাকরি স্পষ্ট করতে পেরেছি।

 

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
রাঙামাটিতে হলো সংসদীয় কমিটির বৈঠক
রাঙামাটিতে হলো সংসদীয় কমিটির বৈঠক
ডুবে যাওয়া জাহাজের ১১ নাবিক উদ্ধার, সবার আগে লাফ দেওয়া মাস্টার নিখোঁজ
ডুবে যাওয়া জাহাজের ১১ নাবিক উদ্ধার, সবার আগে লাফ দেওয়া মাস্টার নিখোঁজ
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ