X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাইপ্রাসে স্বাগতম: যেন একখণ্ড বাংলাদেশ

নাদীম কাদির
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৫:২৪আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৫:৩১

নাদীম কাদির সাইপ্রাসের রাজধানী নিকোসিয়ায় আমাকে সাদর সম্ভাষণ জানানো হলো। কিন্তু সত্যিই কি এটি নিকোসিয়া? নাকি এ এক অন্য ঢাকা? আচমকা শুনে এটাকে অদ্ভুত প্রশ্ন বলেই মনে হবে। তবে নিকোসিয়া থেকে সৈকতের এলাকা পাফোসে পৌঁছানোর পর আমি চমকাতে শুরু করলাম।
ওই শহরের একটি অংশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনের ঘাঁটি। সেখানে ফোর্স কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তা এম. হুমায়ুন কবির। ওই এলাকায় গেলে আপনারা বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের জোরালো কণ্ঠস্বর শুনতে পাবেন। এমন অনেকেই আছে সেখানে!
একসময় আমি শুনেছিলাম, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন স্বল্পোন্নত দেশের মানুষদের কাছে শিক্ষা, চাকরি আর ইউরোপে যাওয়ার দুয়ার হিসেবে সাইপ্রাস একটি পছন্দের গন্তব্য। কিন্তু এসব সুবিধার অপব্যবহারের কারণে ধীরে ধীরে সাইপ্রাসে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদেরকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। নিকোসিয়া কর্তৃপক্ষ আবিষ্কার করলো, অনেকেই তাদের পড়াশোনা আর চালিয়ে যায় না এবং বিভিন্ন অজুহাতে থেকে যায়। অনেকে অবৈধভাবে বসবাস করছে।
এ বিষয়টি খুব গর্ব করার মতো যে সাইপ্রাসে নিয়োজিত জাতিসংঘ মিশনের ফোর্স কমান্ডার একজন বাংলাদেশি। দেশের জন্যও তা অনেক সম্মানের। আমি যখন তার ঠিকানা জানতে চাইলাম স্থানীয়রা খুব সহজেই তা বলে দিতে পারলো। তাদের কাছে এটি একটি অভিজাত এলাকা। 
শনিবার দিনটিতে কেনাকাটা, আড্ডা দেওয়া কিংবা কেবল পার্কে হাঁটার জন্য স্থানীয় বাসিন্দারা দলে দলে তাদের ঘর থেকে বের হয়েছিল। এদিন দুপুরের খাবারের জন্য আমি একটি সিরীয় রেস্তোরাঁয় থামলাম। সেখানে দেখলাম অনেক তরুণ বাংলা ভাষায় কথা বলছে। দ্বীপ দেশ সাইপ্রাসের মতো এমন একটি বিদেশভূমিতে এ ধরনের দৃশ্য আমাকে অনেক পুলকিত করলো। আমি তাদের একজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম। তাকে দেখে ভীত বলে মনে হলো এবং আমাকে এড়াতে চাইলেন। কিন্তু আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, ‘ভাই, আমি লন্ডন থেকে ঘুরতে এসেছি। আপনি এখানে কী করছেন?’
জবাবে নিজের নাম উল্লেখ না করে ওই তরুণ জানান, তার বাড়ি চট্টগ্রামে। তিনি সাইপ্রাসে পড়াশোনা করছেন। চাকরি করছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ বোধক উত্তর আসে তার কাছ থেকে। তবে তিনি জানান, ‘এমনটা করা কঠিন... আমাদের সবার কাজের অনুমতি নেই’।
‘বাড়ি ও পরিবারের শূন্যতা বোধ করেন?’ আমি জানতে চাইলাম। মাথা ঝুঁকিয়ে তিনি বললেন, ‘ফিরে যাওয়ার আগে আমাকে কিছু করতে হবে। আমাকে এখানে পাঠানোর জন্য পরিবারের লাখ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।’

আমি যখন নিকোসিয়া শহরের রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম তখন দেখলাম সেখানে বাংলাদেশিদের কোনও কমতি নেই। অবশ্যই সেখানে পাকিস্তান আর ভারতের লোকজনও আছে। প্রবাসী এশিয়ানদের সেখানে আনাগোনা প্রচুর। সপ্তাহান্তে পাবে, পার্কে কিংবা বাড়িতে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় কাটান প্রবাসীরা। কেউ কেউ অন্য শহরগুলোতে ঘুরতে যান।

সৈকতের শহর পাফোসে পুরনো বন্ধুদের একজন থাকে। ২০ এর কোটায় বয়স তার। পাফোস থেকে নিয়মিত লিমাসোলের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করে সে। চা খাওয়ার জন্য আমি তার সঙ্গে এবং তার বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলাম।

বাস্তবিক অর্থে জীবন অনেক কঠিন। এ তরুণরা আমাকে জানালো তারা বাগানে গাছ থেকে কমলা পাড়ার কাজ করে কিংবা আঙ্গুর ক্ষেতে কাজ করে। তাদের কষ্ট হয় কিন্তু টাকা প্রয়োজন। কেবল পড়াশোনার জন্যই নয়, বেঁচে থাকতে এবং বাড়িতে পাঠানোর জন্য তাদের টাকা দরকার।

বিশ্বাস করা কঠিন হলেও এটা বাস্তব যে অনেকে সেখানে গৃহকর্মী হিসেবেও কাজ করেন। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনারা এখানেই যদি এগুলো সব করতে পারেন তাহলে গ্রামে ফিরে গিয়ে কেন পরিবারকে চাষাবাদে কিংবা ঘরের কাজে সহায়তা করছেন না?’

জবাবে মাহাদি নামের একজন বললেন, ‘সাইপ্রাসে আসতে আমার যে টাকা খরচ হয়েছে অন্তত সে টাকা তো আমাকে পরিশোধ করতে হবে।’

মাহাদির বক্তব্যের সঙ্গে যোগ করে আলম নামের একজন বললেন, ‘আমরা বাড়িতে এসব কাজ করতে পারি না, লজ্জা লাগে... এখন আমরা এখানে যখন আছি তখন এভাবে চালিয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে ভালো। দেখা যাক ভবিষ্যতে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে।’

কঠোর পরিশ্রম আর পড়াশোনা এবং কম বিশ্রামের কারণে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু সাইফ অত্যন্ত শুকিয়ে গেছে। ঢাকায় আমি তাকে যেমন দেখেছিলাম তখনকার চেয়ে এখন তার গায়ের রঙও কালো হয়ে গেছে।

সে আমাকে বললো, ‘আমি বুঝতে পারিনি এ কাজ এতো কঠিন হবে... কিন্তু ইউরোপীয় দেশে পড়াশোনা করাটা আমার স্বপ্ন ছিল।’

জীবন কতটা কঠিন হতে পারে তা ভেবে আমি বিস্মিত হলাম। এসব লোকদের যদি বাড়িতে ফিরিয়ে এনে আমরা চাকরি দিতে পারতাম তাহলে তারা খুশি হত এবং দেশ লাভবান হতো। চলুন আমরা একটি উপায় খুঁজে বের করি।

লেখক: সাংবাদিকতায় জাতিসংঘের ড্যাগ হ্যামারসোল্ড স্কলার এবং লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ