X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

নতুন নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন

আনিস আলমগীর
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৬:৪১আপডেট : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৬:৪৩

আনিস আলমগীর নতুন নির্বাচন কমিশন ঘোষণার পর পরই শুরু হয়েছে বিতর্ক। সদস্যদের নিরপেক্ষতার মাত্রা বিচার করা হচ্ছে। আমি আমার আগের লেখায় বলেছিলাম এই দেশে এখন নিরপেক্ষ লোক পাওয়া মুশকিল হবে। তাই অনুরোধ ছিল তল্লাসিতে না গিয়ে এমন লোককে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হোক যিনি সুষ্ঠুভাবে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন। আসলে দলীয় পরিচয়ের চেয়ে ব্যক্তির মেরুদণ্ডই এখানেই প্রধান বিষয় হিসেবে দেখা উচিত। নতুবা যতই দল নিরপেক্ষ ব্যক্তি চেয়ারে বসুক ফলাফল একই হবে।
পাকিস্তানের শেষ প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি সাত্তার সাহেবের প্রসঙ্গ টেনে আমি বলেছিলাম যে, তিনি পাকিস্তানপন্থী লোক ছিলেন আর পাকিস্তানপন্থীরা মনে করতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে গেলে ৬ দফার বাড়াবাড়িতে পাকিস্তান ভেঙে যেতে পারে। পাকিস্তানপন্থী হিসেবে বিচারপতি সাত্তারও অনুরূপ কিছু চিন্তা করা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তার চিন্তা বা তার গোষ্ঠির চিন্তা তাকে প্রভাবিত করেনি। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে করার চেষ্টা করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান, জুলফিকার ভুট্টো, দৌলততানা, মওদুদি কেউই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ সেদিন উত্থাপন করেননি।
নির্বাচন কমিশন গঠন রাষ্ট্রপতির শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব। কোনও সার্চ কমিটি গঠনের কথা শাসনতন্ত্রে নেই। আর রাজনৈতিক দলগুলোর ঘরে ঘরে গিয়ে যাচাই বাছাই করার চেষ্টাতো একটা অহেতুক প্রক্রিয়া। কারণ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে ঐকমত্য সৃষ্টি করার কোনও প্রক্রিয়াই বড় দলগুলো চর্চা করার চেষ্টা করে না। বড় দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের চোখ দেখা দেখি হয় না। এক শীর্ষ নেত্রীর পুত্রের মৃত্যুর পর আরেক শীর্ষ নেত্রী তার বাসায় যাওয়ার পর গেট তালাবদ্ধ করে রাখেন।

আমাদের রাজনীতির অঙ্গনে এমন বেশরম কর্মকাণ্ডের চর্চা যেখানে চলছে, সেখানে ঐকমত্যের নির্বাচন কমিশন গঠনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটাই একটা অহেতুক বিষয় বলে বিবেচনা করা যায়। যাক, সে প্রচেষ্টা থেকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিরত হননি। তিনি নিবন্ধনকৃত সব দলের সঙ্গেই কথা বলেছেন। সার্চ কমিটি গঠন করেছেন। সার্চ কমিটিও দেশের বিশিষ্ট লোকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ১০ জনের একটা সর্বসম্মত তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করেছেন। সোমবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি থেকে তালিকা পাওয়ার পরই পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিয়েছেন। কে.এম. নুরুল হুদাকে প্রধান নির্বাচন কমিশন করা হয়েছে। আর চারজন নির্বাচন কমিশনার হলেন- মাহাবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম, শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী। রাতেই তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।

আমরা নতুন নির্বাচন কমিশনকে অভিনন্দন জানাই এবং আশা করি তারা নিরপেক্ষতার মানদণ্ড রক্ষা করে ভবিষ্যতের সব নির্বাচন পরিচালনা করবেন। মূলত যাকে তুষ্ট করার জন্য এত প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ করা হলো সম্ভবতো তাকে সন্তুষ্ট করা গেল না। আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিএনপি নাকি তার প্রতিক্রিয়া জানাবে। তবে প্রতিক্রিয়া যে ভালো হবে না তা নির্বাচন কমিশনের প্রধানের নাম দেখে বুঝা যায়।

নুরুল হুদা যে অনুপযুক্ত লোক তা নন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। বরিশাল সেক্টরে মেজর জলিলের অধীনে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ক্যাডার সার্ভিসের লোক। দেশ-বিদেশি উচ্চডিগ্রিও রয়েছে। তবে ২০০১ সালে যখন বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসেছিলেন তখন তাকে সচিব পদ থেকে ফোর্স রিটায়ারমেন্টে পাঠিয়েছিলেন। অর্থ-আত্মসাৎ বা ক্ষমতার অপব্যবহার এরূপ কোনও অভিযোগই তার বিরুদ্ধে ছিল না- যেহেতু একজন স্বচ্ছ মুক্তিযোদ্ধা। সুতরাং তাকে সহ্য করার কোনও যুক্তি না থাকায় সম্ভবতো তারা তাকে অপসারণ করেছিলেন। কে. এম. নুরুল হুদা আদালতে মামলা করে এবং মামলায় জিতে পুনর্বহাল হয়েছিলেন।

এমন এক ব্যক্তিকে কখনও বিএনপি মেনে নেবে বলে মনে হয় না। তবে বিএনপি-জামায়াত সরকার একজন নিরাপরাধ সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে যে অপরাধ করেছিলেন তখন আবার তার নিয়োগকে বিতর্কিত করার প্রয়াস চালিয়ে আশা করি দ্বিতীয় অপরাধটা করবেন না। নিষকণ্টক কোনও পথ নেই। কোরআনের সিরাতুল মোস্তাকিম ছাড়া। গণতন্ত্র হলো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ব্যবস্থা। এখানে নিজের কল্পনায় থাকা কোনও সুখকর পথ নেই যে, যা বিনা বাধায় অতিক্রম করে সিংহাসনে বসা যায়। ক্ষমতা এমন জিনিস যার স্থায়ীত্বের জন্য ফ্রান্সের এক রাণী নিজের সন্তানের চোখ তুলে তাকে বিকলাঙ্গ করে দিয়েছিলেন। কারণ নিয়ম ছিল বিকলাঙ্গ লোক ফ্রান্সের সিংহাসনে বসতে পারবে না। তার আশা ছিল তিনি রিজেন্ট থেকে স্থায়ী রাণী হবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার জায়গা হয়েছিল বাস্তিলের কারাগারে।

আমরা আশা করবো এখন থেকে সব দলই নির্বাচনি প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে মাঠের পরিচর্যা করবেন। আগামী নিবাচনটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হোক এটা জাতির প্রত্যাশা। আওয়ামী লীগ আর জাতীয় পার্টি তিনশ আসনে প্রতিদ্ব›দ্বী করার প্রস্তুতির কাজ আরম্ভ করেছে। আশা করি বিএনপি ও তাদের প্রস্তুতির কাজ আরম্ভ করবে। নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। অন্যদেরও দায়িত্ব কম নেই। সবাই সহযোগিতা করলেই এই কমিশন সফল নির্বাচন উপহার দিতে পারবে।

বিএনপি গত ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেনি। নির্বাচন বানচাল করার জন্য ২০১৩ সালের শেষ চার মাস আর নির্বাচনের পরে সরকার উৎখাত করার জন্য ২০১৫ সালের প্রথম ৯৩ দিন যেভাবে সহিংস আন্দোলন করেছেন তাতে ৩১৯ জন আর দ্বিতীয় দফে ১৫২ জন নিরাপরাধ লোকের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মাঝে একজনলোকও সরকারি দলের ছিল না। তাদের এরূপ নির্মমতায় দেশের মানুষ মর্মাহত হয়েছে।

আমরা আশা করবো বিএনপি এবারের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার চেষ্টা করবেন। পূর্বের মতো অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা হবে মারাত্মক। জনতা রুদ্ররোষ জেগে উঠলে অতলান্ত সাগরের নিচে গিয়েও মানুষ আত্মরক্ষা করতে পারে না। এ দেশের ১৬ কোটি মানুষ কোনও দলের অন্নে প্রতিপালিত হয় না। তারা তাদের খেয়াল খুশি মতোই ভোটদানের আশা করে।

সবশেষে আমি আশা করবো, বিএনপির চাপে পড়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যেন নিজেকে নিরপেক্ষ প্রমাণ করতে গিয়ে ‘অতি নিরপেক্ষ’ না হয়ে যান। অতীতেও আমরা এমন চরিত্র দেখেছি আমলা শ্রেণির। ২০০১ সালের নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের কথা মনে পড়ছে এই প্রসঙ্গে। আওয়ামী লীগের পছন্দের বলে অভিযুক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান নিরপেক্ষতার ভাব নিতে গিয়ে নিরপেক্ষতার ১২টা বাজিয়েছিলেন। ক্ষমতা গ্রহণের ৩০ মিনিটের মধ্যে ১৩ সচিবকে বদলি/ওএসডি করেছিলেন। নুরুল হুদা সাহেবও যেন এমন ‘নিরপেক্ষ’ না হন।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
কুমিল্লা মেডিক্যাল সেন্টার হাসপাতালকে ২ লাখ টাকা জরিমানা
কুমিল্লা মেডিক্যাল সেন্টার হাসপাতালকে ২ লাখ টাকা জরিমানা
ফটোকপি দোকানের কর্মচারী, জেলে, রাজমিস্ত্রি তৈরি করতো জাল টাকা
ফটোকপি দোকানের কর্মচারী, জেলে, রাজমিস্ত্রি তৈরি করতো জাল টাকা
রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর নিরাপত্তা জোরদার করছে কিয়েভ
রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর নিরাপত্তা জোরদার করছে কিয়েভ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ