X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রেনের ভাড়া বেড়েছে, সেবার মান কি বেড়েছে?

রোকেয়া লিটা
১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৫:০০আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৫:০৭

রোকেয়া লিটা বাবার বাড়ি যাব। আমার বরের পছন্দের বাহন ট্রেন, বাসে তিনি যাবেন না। দু’দিন ধরে অনলাইনে টিকিট কেনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। টিকিট নাই। কাউন্টারে গিয়েও টিকিট পেলাম না। পরে একজনের ‘বিশেষ সহযোগিতায়’ টিকিট জোগাড় হলো।

৩০ শে জানুয়ারি, সকাল বেলা। রাস্তায় জ্যামের কথা ভেবে আমরা সকালবেলা তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হলাম। কিন্তু রাস্তায় কোনও জ্যাম না থাকায়, আমরা প্রায় দেড় ঘণ্টা আগেই বিমানবন্দর স্টেশনে গিয়ে পৌঁছালাম।  এই দেড় ঘণ্টা তো আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। আমরা বসার জন্য ওয়েটিং রুমে গেলাম। ওয়েটিং রুমে দাঁড়াতেই ঝাড়ু হাতে এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী এলেন। তিনি রুম পরিষ্কার করবেন, অতএব আমাদের বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। রুমের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম, সেখানেও শুরু হয়ে গেল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান। আনুমানিক ৯টা বাজে তখন। এই সময়টি কি আসলে কোনও জনবহুল স্থান পরিষ্কার করার উপযুক্ত সময়? সারারাত অথবা ভোরবেলা যখন ভিড় কম থাকে, তখন কী করেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা?

ধূলাময় একটি বিচ্ছিরি পরিবেশে হাঁচি দিতে দিতে দেড় ঘণ্টা কেটে গেল। ট্রেন আসার পরে শুরু হয়ে গেল হুড়োহুড়ি করে বগিতে ওঠার পালা। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, প্লাটফর্মগুলো ট্রেনের দরজার চেয়ে প্রায় দুই ফুট নিচে।  ফলে একজন যাত্রীর লাগেজ নিয়ে ট্রেনে ওঠার যে কষ্ট তা অবর্ণনীয়। কারও সাহায্য ছাড়া নারী, শিশু ও শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী  যাত্রীদের জন্য তো এসব ট্রেনে ওঠা প্রায় অসম্ভব।  তার ওপর সঙ্গে যদি একটি লাগেজ থাকে, তাহলে তো কোনও কথাই নেই। বিদেশে দেখেছি, ট্রেনের দরজা ও প্লাটফর্মের উচ্চতা সমান হওয়ার পরও ট্রেন আর প্লাটফর্মের মধ্যে সামান্য একটু ফাঁকা থাকার কারণে বার বার ঘোষণা দিয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়। আর আমরা আছি কত অসহায় অবস্থায়? দেশের বিভিন্ন জায়গায় রেল স্টেশনের লাল দালানগুলো দেখলেই বোঝা যায়, এগুলোর বেশিভাগই ব্রিটিশ আমলের দালান। নতুন করে কয়টি স্টেশন নির্মাণ বা সেগুলোর মেরামত হয়েছে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। তাহলে, ট্রেনের যে এত ভাড়া বাড়ানো হলো, সেগুলো যায় কোথায়?

ট্রেনের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বগির নাম স্নিগ্ধা। এই বগিতেই আমরা প্রায় ৯০০ টাকা করে দাম দিয়ে একেকটি টিকিট কিনেছিলাম। যাই হোক, ট্রেনের এই স্নিগ্ধা নামক বগিতে উঠে দেখি, বগির অধিকাংশ সিটই ফাঁকা। অথচ কি অদ্ভূত কাণ্ড, এই ট্রেনেরই টিকিট আমরা অনলাইন বা স্টেশনের কাউন্টার, কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না! ট্রেন চলতে শুরু করলো। আমরা চায়ের সঙ্গে আদা-রসুনসর্বস্ব কাটলেট চিবুতে চিবুতে খেয়াল করলাম, টিকিট না কেটেই দুই জন স্নিগ্ধায় উঠেছেন! পরিদর্শক তাদের টিকিকের কথা জিঙ্গেস করলে, তারা জানালেন টিকিট কাটার সময় পাননি। এজন্য টিকিট না কেটেই উঠেছেন! তবে টিকিট কেটে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে তাদের ট্রেন পরিদর্শক বগিতে থাকার অনুমতি দিলেন!

তাহলে কি ধরে নেব, রেলওয়ের ওয়েবসাইটে টিকিট অ্যাভেইল্যাবল দেখায় না বা স্টেশনের কাউন্টারে গিয়ে টিকিট পাওয়া যায় না, কারণ টিকিট না কেটেই ট্রেনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বগিতে চড়ে যাওয়া যায়!  তাহলে শুধু-শুধু টিকিট কাটার পেছনে সময় নষ্ট করবে কেউ? সবাই তো ‘বিশেষ সহযোগিতার’ সন্ধান করতে হবে।  

আমরা এত কষ্ট করে, এত টাকা ব্যয় করে টিকিট কাটলাম, অথচ কিছু মানুষ টিকিট ছাড়াই আমাদের সঙ্গে ভ্রমণ করছেন! শুরু থেকেই বিষয়টা আমার সহ্য হচ্ছিল না। ফলে, ওই সব যাত্রীই আমার মনোযোগ কেড়ে নিলেন। খেয়াল করছিলাম, ট্রেনের দু-একজন পরিদর্শক একটু পরপর আসছেন আর ওই যাত্রীদের পাশে বসে ফিসফিস করে কী যেন বলছেন। কখনও আবার তাদের বগির বাইরে, দরজার দিকে ডেকে নেওয়া হচ্ছে নিরিবিলিতে কথা বলার জন্য। আমার পাশের সিটেই এমন একজন যাত্রী বসেছিলেন।  কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম, ট্রেনের একজন পরিদর্শক এসে ওই যাত্রীর কাছ থেকে পাঁচশ টাকা নিয়ে গেলেন। ব্যস, আমরা যে টিকিট কেটেছিলাম প্রায় ৯০০ টাকায়,  ওই যাত্রী মাত্র পাঁচশ টাকা দিয়েই আমাদের সঙ্গে একই বগিতে যাওয়ার সুযোগ পেলেন! এখন আসুন ভাবি, ওই পাঁচশ টাকা আসলে কার পকেটে গেল? ওই যাত্রীকে ট্রেনের পরিদর্শক যদি টিকিট দিয়েই ট্রেনে থাকার অনুমতি দেবেন, তাহলে তো পাঁচশ টাকায় হবে না। পরিদর্শক নিশ্চয়ই টিকিটের বাকি টাকা নিজের পকেট থেকে দেবেন না। তাহলে তো বোঝাই যায়, ওই যাত্রী আসলে টিকিট না কেটেই ট্রেনে ভ্রমণ করছে! টাকাটা তাহলে আর সরকার পাচ্ছে না। টাকাটা যাচ্ছে ট্রেন পরিদর্শকের পকেটে।

ভালোই তো, সাজানো-গোছানো ব্যবস্থাটা। রেলওয়ের একটি অংশ অনলাইনে বা কাউন্টারে টিকিটের একটা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রাখছে। যাত্রীরা বাধ্য হচ্ছে ট্রেন বাদ দিয়ে অন্য কোনও পরিবহন বেছে নিতে। ফলে বগিতে সিট ফাঁকা থাকছে। এই সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা নিজেদের পকেট ভারি করছে। যদি বলি, পুরো ব্যাপারটাই আসলে একটা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ঘটছে, তাহলে কি ভুল বলা হবে? তা যদি নাই হবে, তবে পুরোটা পথ পুরো বগি দেখলাম ফাঁকা গেল, অথচ কাউন্টারে বা অনলাইনে ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায় না কেন?

ঢাকায় ফেরার দিনেও দেখলাম একই ঘটনা। টিকিট ছাড়া দলে দলে যাত্রী উঠে পড়েছে ট্রেনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বগিতে। ভাবুন তো,  তাহলে বাকি বগিগুলোর কী অবস্থা! আমরা যারা এত উচ্চমূল্যে এসব বগির টিকিট কাটি, তারা আশা করি একটি নিরিবিলি পরিবেশ ও নিরাপত্তা। কিন্তু যারা টিকিট না কেটেই ট্রেনে ভ্রমণ করে, তারা কোন মানের যাত্রী, তা নিয়ে তো ভয়েই থাকতে হয়। পুরো এক রাত এসব যাত্রীর সঙ্গে একই বগিতে থাকাও তো যথেষ্ট অনিরাপদ। কিন্তু, এসব বিষয়ে যাদের খেয়াল রাখা উচিত, সেই ট্রেন পরিদর্শকরাই যদি বাড়তি আয়ের জন্য এসব যাত্রীদের প্রশ্রয় দেন, তবে কার কাছে নিরাপত্তা চাইতে যাব?

লেখক: সাংবাদিক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ