X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ইস্যু: সমস্যা ও সমাধান মিয়ানমারের হাতে

মাসুদা ভাট্টি
১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৪:১৫আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৬:০১

মাসুদা ভাট্টি রোহিঙ্গা-ইস্যুতে বাংলাদেশকে ক্রমশ একটি ‘পক্ষে’ ফেলার চেষ্টায় প্রায় সফল হতে বসেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। অথচ বিষয়টি বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যাপার। সেখানে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘নিশ্চিহ্ন’ (এথনিক ক্লিনজিং) করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী রাষ্ট্রটির ‘ডি ফ্যাক্টে’ সরকার-প্রধান কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী অন সান সু চি বিষয়টিকে শুরুতে একেবারে অগ্রাহ্য করলেও অতি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে একটু সাড়া দিতে শুরু করেছেন। কিন্তু সে সাড়াটুকু নিতান্তই লোক দেখানো। তিনি প্রথমেই তার দূত পাঠিয়েছেন বাংলাদেশে, অথচ বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপনের জন্য ক্রমাগত দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশসহ আরও কিছু দেশ। বাংলাদেশে দূত পাঠিয়ে যে কোনও লাভ নেই সে কথা বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশ সাফ জানিয়েছে যে, বিষয়টির সমাধান বাংলাদেশের হাতে নয়। বরং বাংলাদেশ আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের যতোটুকু সম্ভব সাহায্য-সহযোগিতা দিচ্ছে। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে। অথচ বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের অনেকেই (পড়ুন পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের ক্লাব) বার বার কক্সবাজার গিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করছেন এবং সবক দিয়ে চলছেন বাংলাদেশকেই। তাদের এতটুকু সামর্থ্য নেই মিয়ানমারকে এ বিষয়ে কোনও কথা বলার। এই পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতগণ এভাবে বাংলাদেশকে এই ‘রোহিঙ্গা-সমস্যায়’ একটি ‘পক্ষ’ বানিয়ে নানা ধরনের নসিহত করতে শুরু করেছেন।
বাংলাদেশের ভেতর শরণার্থী শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদেরকে কক্সবাজার সংলগ্ন একটি দ্বীপে জায়গা করে দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। এটি এ কারণেই যে, বাংলাদেশের মতো জনবহুল একটি দেশের পক্ষে ক্রমবর্ধমান রোহিঙ্গা মুসলিম জনসংখ্যার চাপ সামলানো খুব সহজ কাজ নয়। তাছাড়া বাংলাদেশ যদি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এদেশে নিরাপদ থাকার জায়গা দেওয়া হলে সেটা মিয়ানমারের জন্য একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচিত হবে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের এদেশে ঠেলে দেওয়ার। যা আসলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতিই এক ধরনের অবিচার হবে। অপরদিকে বাস্তবিক কারণেই এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা মুসলমানদের এদেশে স্থান দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। সম্পদ ও স্থান বিচারে বাংলাদেশের তুলনায় মিয়ানমারের অবস্থা শতগুণ ভালো। সেখানে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের স্থান সংকুলানে কোনও ধরনের সমস্যা হওয়ার কথা নয়, অথচ বিষয়টিকে সে দেশের সরকার এমনভাবে দেখছে যেন, এই সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিতাড়িত করা গেলে রাষ্ট্রটি যেন বেঁচে যায়। সে কারণে পুলিশ, সেনা বাহিনী ও সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের যুগপৎ লেলিয়ে দিয়ে রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়কে উৎখাতের প্রচেষ্টা চলছে।

এদিকে এই রোহিঙ্গা মুসলমান সম্প্রদায়ের এই নাজুক অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করছে সুযোগ-সন্ধানী বিভিন্ন গোষ্ঠী। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারকারী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং চোরাচালানকারী অসাধু মাফিয়াচক্র। সম্প্রতি মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা উ থং টাং ভারত সফরে গেলে দেশটির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তার কাছে যে অভিযোগ জানানো হয় তা কেবল উদ্বেগজনকই নয় বরং চরম আতঙ্কের। উত্থাপিত অভিযোগে বলা হয় যে, মিয়ানমারের এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে পাকিস্তানের উগ্র সন্ত্রাসবাদী সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়্যেবার যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে এবং বাংলাদেশের সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় তারা একটি শক্তিশালী ঘাঁটি তৈরিতে সমর্থ হয়েছে। যা মূলত মিয়ানমার, ভারত ও বাংলাদেশের জন্য সত্যিই বিপদের কথা। এমনিতেই বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী চক্র কাজ করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদা ও আইএস (ইসলামিক স্টেইট) বাংলাদেশে তাদের অবস্থান জানান দিয়েছে। বাংলাদেশকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে জঙ্গিবাদের মতো ভয়াবহ দানবের, যারা এদেশে ইতোমধ্যেই আত্মঘাতী হামলার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছে। ফলে ভারতের পক্ষ থেকে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের কাছে একটি চিহ্নিত সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলিমদের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে অভিযোগ করা হয় তখন বাংলাদেশের আতঙ্কিত হওয়ারও যথেষ্ট কারণ তৈরি হয়। অন্তত এ কারণটিকে মাথায় রেখেও বাংলাদেশের উচিত রোহিঙ্গা মুসলিমদের শরণার্থী শিবিরটি কক্সবাজার সংলগ্ন দ্বীপে সরিয়ে নেওয়া। তাহলে তাদের সহযোগিতার ক্ষেত্রটি আরও প্রসারিত হবে সেই সঙ্গে তাদের ভেতর সন্ত্রাসী তৎপরতা যাতে না ছড়িয়ে পড়ে সেদিকটিও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

প্রশ্ন হলো এই স্বাভাবিক বিষয়টি কেন আন্তর্জাতিক-মহল অ-স্বাভাবিক করে তুলতে চাইছে? এখানে স্বাভাবিক বিষয় বলতে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ইস্যু হিসেবে রোহিঙ্গা সমস্যাটিকে চিহ্নিত করার কথা বলছি এবং সেই সঙ্গে শরণার্থী হিসেবে রোহিঙ্গাদের ঠেঙ্গারচরে পাঠানোর বিষয়টিকে বুঝিয়েছি। আবারও বলতে চাই যে, রোহিঙ্গা ইস্যুটির সমাধান আসলে নির্ভর করে মিয়ানমার সরকার, সে দেশের সেনাবাহিনী ও দেশটির সুশীল সমাজের। এ বিষয়ে ব্যাংকক পোস্ট পত্রিকায় সম্প্রতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নেগিনপাও কিপজেন, যিনি জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স-এর সহযোগী অধ্যাপকও, লিখেছেন যে, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুটি সমাধান কার হাতে তা নিয়ে অনেকেই কৌতুহলী। অনেকেই এর দায়িত্ব আউন সান সূ চি’র সরকারের ওপর দিতে চান। ২০১২ সাল থেকে জাতিসংঘ, ওআইসি, আসিয়ান, বাংলাদেশ সরকারসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সমস্যাটি সমাধানে নানা তত্ত্ব দিয়ে আসছে। তবে এর চূড়ান্ত দায়িত্ব মিয়ানমার সরকার, সেনাবাহিনী ও দেশটির সুশীল সমাজের ওপর নির্ভর করছে’। মজার ব্যাপার হলো, দেশটি বহুদিন পর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ফিরে এসেছে বলে দাবি করা হলেও আসলে দেশটির সেনাবাহিনীর ওপর কথা বলার মতো সাহস ও যোগ্যতা এখনও কোনও রাজনৈতিক দলের হয়নি বলেই প্রতীয়মান হয়। বিশেষ করে অন সান সূ চি’র নেতৃত্বে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারও সেনাবাহিনীর হাতে স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও সীমান্ত রক্ষা মন্ত্রণালয়সমূহ দিয়ে রেখেছে। দেশটির জাতীয় ও রাজ্য-সংসদে প্রায় ২৫ শতাংশ আসন বরাদ্দ রাখা হয়েছে সেনাবাহিনীর জন্য। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগ্রহণের জন্য যে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ রয়েছে সেখানেও রয়েছে সেনাবাহিনীর আধিপত্য। ফলে মিয়ানমার সরকারের পক্ষে একা কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব নয়। এমনকি দেশটির সুশীল সমাজের অবস্থাও আসলে ‘ভাঙা-চোরা’ গোছের। আর এর মধ্যে অন সান সু চি’র সরকার পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরির চেষ্টায় হত্যা দিয়ে নেমেছে এবং দেশটিকে বিদেশিদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

মূলত দেশটির বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর পশ্চিমা বেনিয়া রাষ্ট্রগুলোর লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে এবং সেখানে দেশটিকে কে কত বেশি সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলছে। ফলে মিয়ানমারের যে কোনও অপরাধকে ক্ষমা করতে তারা দশ হাত বাড়িয়েই রয়েছে বলতে গেলে। নাহলে গণতন্ত্রের নামে সেখানে মূলত সেনাতন্ত্রই কায়েম রয়েছে এবং তাকেই পশ্চিমারা গণতন্ত্র বলে সার্টিফিকেট দিচ্ছে কী কারণে? আর মিয়ানমার সরকার, সেনাবাহিনী ও সংখ্যাগুরুর বৌদ্ধ সম্প্রদায় মিলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সে দেশ থেকে বিতাড়নে যে ভাবে উঠেপড়ে লেগেছে তাতে অন্য যে কোনও দেশ হলে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর মানবাধিকারবোধ অনেক আগেই তেড়েফুঁড়ে উঠতো। অথচ এখানে কেমন নীরব বিবেকের ভূমিকা পালন করে চলেছে তারা বছরের পর বছর ধরে এবং বাংলাদেশ যেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে সেখানে বাংলাদেশকেই চাপ দেওয়া হচ্ছে অত্যন্ত কদর্যভাবে। আর বাংলাদেশের কতিপয় জ্ঞানপাপীর দরদের থলে যেন উপচে পড়ছে মানবাধিকারের আধিক্যে। অথচ এরাই এদেশের হিন্দুদের এদেশ থেকে উচ্ছেদে ‘হা রে রে’ বলে সবার আগে এগিয়ে আসেন, তখন তাদের মানবাধিকারবোধ বঙ্গোপসাগরে ভেসে যায়।

মিয়ানমার রাষ্ট্রটি পৃথিবীর বাইরের কোনও রাষ্ট্র নয়। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসংঘেরও দায়িত্ব রয়েছে রাষ্ট্রটির সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা ও পূর্ণ নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের তত্ত্বাবধানে একটি কমিশন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের সমস্যা নিয়ে কাজ করছে, তারা সম্প্রতি বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছে, মিয়ানমার তাদেরকে সে দেশে এখনও প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। অপরদিকে মিয়ানমারের সেনা সরকারও একটি কমিশন গঠন করেছিল রোহিঙ্গা ইস্যুটি নিয়ে। কিন্তু তাদের তৎপরতার খবর জানা যায় না, কারণ মিয়ানমারের গণমাধ্যম এখনও পূর্ণ স্বাধীন নয়। যদিও তা নিয়ে আমাদের আন্তর্জাতিক স্বাধীনতাবিশারদগণের কোনও মাথাব্যাথা আছে বলে প্রমাণ নেই। আর সে দেশের সুশীল সমাজ আসলে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক বলেই মনে করে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। অধ্যাপক নেগিনপাও কিপজেন-এর মতে, সু চি নিজেও গণতন্ত্রের লড়াই করে করে ক্লান্ত হয়ে শেষাবধি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে একটি ‘প্যাচ-আপ’-এর মাধ্যমে ক্ষমতা পেলেও দেশটির সংখ্যাগুরু বার্মিজদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে ভোট হারাতে নারাজ, ফলে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে তার মাথাব্যাথা সামান্যই। সু চি বিষয়টি পশ্চিমাদের দিয়ে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিতে পারলেই বাঁচেন বোধকরি, তার কর্মকাণ্ডের আমার সেটাই মনে হচ্ছে। তবে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অবশ্যই শরণার্থী হিসেবে রোহিঙ্গাদের সাহায্য-সহযোগিতা করবে কিন্তু সমস্যাটির সমাধান যে মিয়ানমারকেই করতে হবে সে ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান বদলানো হবে আত্মঘাতী, তা পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো থেকে যতোই এ ব্যাপারে চাপ আসুক না কেন। আর সে জন্যই অবিলম্বে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির ঠেঙ্গারচরে সরিয়ে নেওয়াই হবে সঠিক পদক্ষেপ। এ বিষয়ে কারও দূতিয়ালিকেই পাত্তা দেওয়া উচিত হবে না বাংলাদেশের।

লেখক: কলামিস্ট

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ