X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা নামের নদী

ইকরাম কবীর
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:৪৭আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৪:০৪

ইকরাম কবীর ফেব্রুয়ারি এলেই আমাদের দেশের গণমাধ্যমে অনেকের মধ্যে কিছু বিদেশিদের দেখা যায়। এরা খুব ভালো বাংলা জানেন, অনর্গল বাংলায় কথা বলেন, ক্যামেরার সামনে বাংলা গান শোনান, বাংলা ভাষা নিয়ে তাদের গবেষণার কথা শোনান আর আমাদের বাংলা নিয়ে বাঙালিদের উপদেশ দেন। আমরা নাকি আজকাল ঠিক মতো বাংলা বলি না, উচ্চারণ করতে পারি না ইত্যাদি। এদেরকে আমার বাঙালির চেয়েও বেশি বাঙালি মনে হয়। আমাদের দেশেও কিছু মানুষ আছেন না, নিজেদের আমেরিকানদের চেয়েও বেশি আমেরিকান মনে করেন, মনে মনে বিদেশে থাকতেই বেশি পছন্দ করেন? ঠিক তেমন। এই বাংলা জানা বিদেশিরা বলেন বাঙালিরা আজকাল অ-বাংলা শব্দ বেশি ব্যবহার করছে এবং ব্যাপারটি লজ্জাজনক। এবং আমাদের গণমাধ্যম এদেরই সাক্ষাৎকার প্রতি বছর দেখিয়ে যায়। আমাদের অনেকেই বাংলাভাষী বিদেশিদের মন্তব্য শুনে আহা-উহু করেন।
তাদের কথা একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছি না। আমরা আসলেই কথার মাঝে অনেক বিদেশি শব্দ এবং বাক্য ব্যবহার করছি। তাহলে, আসলেই কি আমরা বাংলা ভুলে যাচ্ছি? আমাদের বাংলার উচ্চারণ কি ঠিক হচ্ছে না? আমরা অ-বাংলা শব্দ বেশি বলে আমাদের ভাষার প্রতি অন্যায় করছি?
তবে বলি। যে কোনও ভাষা আমার কাছে একটি নদীর মতো মনে হয়; বয়ে চলার সময় অনেক কিছু নিজের করে নেয়; আবার অনেক কিছু পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যায়। বয়ে চলার পথে বিভিন্ন হাটে-ঘাটে নতুন কিছু খুঁজে পায়।
একটি ভাষায় কথা বলা এবং অন্যান্য চর্চা করা নির্ভর করে একটি জাতির সামগ্রিক অভিজ্ঞতার ওপর এবং সে অভিজ্ঞতাই সে দেশে স্থায়ী হয়ে যায়। যারা সেই ভাষাভাষী তারাই ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যান। পথ চলতে চলতে কিছু ছোট-ছোট ঝরনা নদীতে গিয়ে পড়ে এবং নদীর সঙ্গে মিশে এক হয়ে যায়। এমন পরিবেশে বসবাস করা মানুষগুলোর ওপরই নির্ভর করে তাদের ভাষা কেমন হবে। চলিত ভাষা যখন চর্চা হয় তখন সে ভাষাই সেখানে দাঁড়িয়ে যায়, প্রথায় রূপ নেয়।
প্রতিটি ভাষাই তাই ছিল। ইংরেজি তৈরি হয়েছিল ফরাসি এবং ল্যাটিনের সংমিশ্রণে। তারপর থেকে এই ভাষাটি নদীর মতো চলতে চলতে অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে। ইংরেজি অভিধানে এখন দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকান, রুশ – অনেক ভাষার বহু শব্দ খুঁজে পাওয়া যাবে যা ইংরেজ ভাষাভাষীরা এখন রিতীমত চর্চা করেন। তেমনি করেই, আমাদের ভাষাতেও অনেক বিদেশি শব্দ ও তাদের ব্যবহার যুক্ত হয়েছে বহু শতাব্দী ধরে। ব্যবসায়িক, ঔপনিবেশিক ও আরও নানা কারণে তা হয়েছে।
বছর চারেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৌরভ শিকদার একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশ তুর্কি এবং মোঘলদের অধীনে ছিল অনেক বছর। সে’কারণেই সংস্কৃতের আধিপত্যে অনেক বাংলা শব্দ হারিয়ে আরবি এবং ফার্সি শব্দ ঢুকেছে।’
বাংলাপিডিয়া থেকে আমাদের ভাষা নিয়ে একটি উদ্ধৃতি দেখুন, ‘বাংলা ভাষার উদ্ভবের পর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে এর শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে বিভিন্ন পর্যায় ও সূত্রের প্রভাবে। সেগুলো হলো: ক) প্রাচীন বাংলার ভাষারূপের সঙ্গে কিছু সংস্কৃত প্রভাব প্রথম থেকেই যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। কারণ খ্রিষ্টীয় অব্দের প্রথম থেকেই সংস্কৃত ভাষা ছিল প্রায় সমগ্র ভারতের সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার বাহন। প্রাচীন বাংলার যুগে বাংলাভাষী অনেকেই কাব্যচর্চা করতেন সংস্কৃতে। ভারতের ইন্দো-আর্য ভাষা যখন প্রাচীন ও মধ্যস্তর উত্তীর্ণ হয়ে আধুনিক স্তরে পৌঁছায়, তখন বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর প্রভাব সত্ত্বেও [পাল রাজত্বে গৌড় সম্রাজ্যের পত্তন সত্ত্বেও] সুপ্রসিদ্ধ বাঙালি কবিগণ (জয়দেব, উমাপতিধর, গোবর্ধন আচার্য প্রমুখ সংস্কৃতেই কাব্য রচনা করেছেন। ফলে প্রাচীন যুগ থেকে তৎসম ও অন্যান্য প্রভাব বাংলায় এসে গেছে; খ) ১৩শ শতকে বঙ্গদেশে মুসলিম শাসনের পর থেকে আরবি-ফারসি ও তুর্কি ভাষার প্রভাব বাংলায় পড়তে শুরু করে; গ) ১৪শ/১৫শ শতকে মুসলিম শাসনামলে ফারসি রাজভাষা হওয়ায় এবং এর বিশেষ মর্যাদার কারণে, সেই সঙ্গে এই ভাষা-সম্পৃক্ত সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলায় স্থান পায় প্রচুর বিভাষী শব্দ; ঘ) আবার একই সঙ্গে মুসলমান শাসকগণ ‘জবান-এ-বাংলা’র সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করার ফলে তৎকালীন পণ্ডিতদের কথিত ‘গৌড় ভাষার’ শ্রীবৃদ্ধি ঘটে, অর্থাৎ বাংলায় তৎসম শব্দের ব্যবহার বেড়ে যায়; ঙ) ১৬শ শতকে পর্তুগিজদের আনীত শব্দাবলি বাংলায় অন্তর্ভুক্ত হতে শুরু করে [আনারস, আতা, তামাক ইত্যাদি]; চ) মধ্যযুগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ফারসি এবং এর মাধ্যমে আগত শব্দ ও ভাষিক প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়; ছ) ১৭শ শতকে বিদেশিদের আগমন বৃদ্ধির সঙ্গে-সঙ্গে পর্তুগিজ এবং ওলন্দাজ ছাড়াও ফরাসি ও ইংরেজি শব্দের প্রভাবও বাড়তে থাকে [ফরাসি: কার্তুজ, কুপন, ডিপো; ওলন্দাজ: হরতন, ইস্কাবন, ইস্কুরুপ; ইংরেজি: টেবিল, চেয়ার, লাট, জাঁদরেল ইত্যাদি]; জ) ১৭শ/১৮শ শতকে  খ্রিষ্টধর্ম প্রচারকদের প্রচেষ্টায় বাংলায় প্রথমবারের মতো গদ্য-ভাষার কার্যকর ব্যবহার শুরু হয়; ঝ) ১৮শ/১৯শ শতকে ইংরেজ শাসনে ইউরোপীয় শিক্ষার প্রভাবে ইংরেজি ও তার মাধ্যমে অন্যান্য বিদেশি ভাষার প্রভাব বাংলা ভাষায় যুক্ত হতে থাকে। ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে বাংলা বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর তার প্রধান উইলিয়ম কেরি ও তার সহযোগী বাঙালি পণ্ডিতদের প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষা সৌষ্ঠবপূর্ণ গদ্য-সাহিত্য রচনার উপযোগী হয়ে ওঠে; ঞ) পরবর্তী পর্যায়ে ১৯শ শতকে রাজা রামমোহন রায়, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মধুসূদন দত্ত, মীর মশাররফ হোসেনের প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে এবং গতি সঞ্চার হয়। তৎসম-তদ্ভব শব্দের ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে এই ভাষা হয়ে ওঠে সাহিত্যের যথার্থ বাহন; ট) বিশ শতকে কথ্য ভাষা লেখ্য সাহিত্যিক ভাষায় উন্নীত হয় প্রথম চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ এবং আরও অনেক প্রতিভাবান বাঙালির হাতে।’

ইংরেজি ভাষা কি পরিবর্তিত হয়নি? হয়েছে। কালের যাত্রায় অনেকবার হয়েছে। তেমনি করেই পৃথিবীর সব ভাষাতেই কি বিবর্তন আসেনি? কেউ যদি চসারের ‘ক্যান্টারবারি টেলস্’ পড়েন তাহলে বর্তমান ইংরেজির সঙ্গে তার পার্থক্য দেখতে পাবেন। তাহলে আর বাংলায় কেন ইংরেজি শব্দ ঢুকছে তা নিয়ে আর আমাদের ভৎসনা করবেন না। ইংরেজি মহাকাব্য ‘বেউলফ’ পড়লেও দেখবেন বর্তমান ইংরেজির থেকে কত তফাৎ।

ভাষা অনেক কারণে বদলে যায়। একটি ভাষার পরিবর্তন আসে যখন সে ভাষায় যারা কথা বলে ও পড়ে তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন বদলে যায়। প্রতিদিন নতুন প্রযুক্তি, পণ্য ও অভিজ্ঞতা সামনে এসে দাঁড়ায়। সেগুলোর জন্য নতুন শব্দের প্রয়োজন হয়। ধরুন, কুড়ি বছর আগে কেউ যদি বলতো যে সে একটি ‘টেক্সট মেসেজ’ করেছে। আমরা কেউ বুঝতাম? তখন ‘টেক্সট’ শব্দের অর্থই’তো ভিন্ন ছিল।

‘টেক্সট ম্যাসেজ’ বা ‘এসএমএস’এর একটি বাংলা আমরা আবিষ্কার করেছিলাম – ‘ক্ষুদে বার্তা’, কিন্তু সর্বস্তরের মানুষ তা মেনে নেয়নি। বলুন তো ‘মোডেম’, ‘ফ্যাক্স মেশিন’ ‘কেবল টিভি’বা ‘টেলিভিশন’ এবং ‘ইন্টারনেট’এর বাংলা কী হবে? বলা মুশকিল।

আমার বন্ধু এবং আমার ভাষার অভিজ্ঞতা যদি একই হয়, তাহলে আমরা কী করবো? আমরা দু’জন বাংলাভাষী যদি ফরাসি ভাষা জানি, তাহলে বাংলা বলার সময় কিছু ফরাসি শব্দ বলে ফেললে তো অবাক হওয়ার কিছু নেই। তা স্বাভাবিক ভাবেই চলে আসবে। এভাবেই আমরা অন্য ভাষা থেকে শব্দ জোগাড় করি।

‘সুশি’ শব্দের বাংলা কী হতে পারে? তেমনি এমন অনেক খাবার বাংলাদেশে প্রচলন হয়েছে যেগুলোর বাংলা এখনও নেই। ভেবে দেখুন ইংরেজি ভাষায় ‘ব্রেকফাস্ট’ এবং ‘লাঞ্চ’ মিলে হয়েছে ‘ব্রাঞ্চ’।

আমরা যখন বিদেশি কোনও ভাষায় কথা বলি তখন কোনও বাংলা শব্দ ব্যবহার করি না। আমরা সেই ভাষাটি শিখেই কথা বলছি তথাপি বাংলা ব্যবহার করি না। তেমনি করেই বিদেশিরা যখন বাংলা শেখেন তখন বাংলা বলার সময় আর তাদের ভাষার শব্দ বলেন না। তারা সজ্ঞানে বিদেশি পরিবেশে বাংলা ভাষা শিখছেন বা শিখেছেন, সে কারণেই তারা অ-বাংলা শব্দ বলেন না।
আমি মনে করি না বাংলা বলার সময় ইংরেজি বা অন্য কোনও ভাষা ব্যবহার করলে আমাদের ভাষা-জ্ঞানের জন্য লজ্জার কিছু আছে। সভ্যতার শুরু থেকেই সব ভাষা নানা পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে এসেছে; ভাষা ভেঙেছে, আবার অন্য ভাষার সাহায্যে গড়েও উঠেছে। আমাদের বাংলাও আরও পরিবর্তিত হবে। ইংরেজি ভাষা যেমনটা পরিবর্তিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন শব্দ আহরণ করে। এ কথা সব ভাষার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এবং তা কোনও লজ্জার বিষয় নয়। ভাষা নিজেকে প্রকাশ করার একটি বাহন। কিন্তু কোনও কোনও ভাষাবিদ মনে করেন পুরনো দিনের ভাষাই সবচেয়ে মার্জিত, সঠিক এবং যুক্তিযুক্ত। আসলেই কি তাই? যেমন ধরুন ‘পাখি’ ইংরেজিতে এক সময় লেখা ও বলা হত ‘brid’ হিসেবে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে মানুষের উচ্চারণ যখন বদলে গেল তখন তার বানান হয়ে গেল ‘bird’।
আমরা কি এখনও রবি ঠাকুরের বাংলায় লেখালেখি করি। আমাদের কবিতা কি এখন মধুসূদনের রচনাশৈলী অনুসরণ করে? আমাদের বিভিন্ন প্রয়োজনে তিনটি ভাষার ব্যবহার রয়েছে- বাংলা, ইংরেজি ও আরবি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এ ভাষাগুলো প্রচলিত। তাহলে আমরা কী করে ভাবি যে কিছু অ-বাংলা শব্দ আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারে ও সাহিত্যে ঢুকবে না? ভাষা সব সময়ই নিজেকে গড়ে তোলে, খাপ খাইয়ে নেয় ও পরিবর্তন হয়।

এতে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। যতদিন ভাষা ব্যবহারকারীদের দৈনন্দিন প্রয়োজনের পরিবর্তন হবে ততদিন ভাষারও পরিবর্তন হবে। তবে এই পরিবর্তন খুব ধীরে হবে।

আমাদের সন্তানেরা সঠিক বাংলা পারে না বা বলে না এই বলে আক্ষেপ করার কিছু দেখি না। তাদেরকে ছোট করে না দেখে বিবেচনা করা উচিৎ তারা পরিবর্তনশীল সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থায় বেড়ে উঠছে। তাদের সন্তানেরা আরও পরিবর্তন দেখবে। আমাদের বাংলা ভাষাও একটি নদীর মতো। বয়ে চলার সময় আশপাশ থেকে নানা নুড়ি-পাথর কুড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে যায়।

লেখক: গল্পকার

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ