X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

বেলজিয়ামের সালিহা বাংলাদেশের সালেহা

মাসুদা ভাট্টি
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:০১আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:৫৪

মাসুদা ভাট্টি বাংলাদেশে জন্মালে এবং বাঙালি হলে তাকে আমরা ডাকতে পারতাম ‘সালেহা’ বলে, কিন্তু তিনি জন্মেছেন তিউনিসিয়ায় এবং বর্তমানে বেলজিয়ামের নাগরিক, তাই তার নাম ‘সালিহা’, পুরো নাম সালিহা বেন আলী। বাংলাদেশের সালেহাদের মতোই তিনি আর দশজন সাধারণ নাগরিক যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দফতর বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস-এ বসবাস করেন। যে কোনও ইমিগ্র্যান্ট-এর মতোই তার ভেতর আছে উন্নত সমাজব্যবস্থায় খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা। এই চেষ্টায় কখনও ঘর ভাঙা জীবন, কখনও সিঙ্গেল মাদার হওয়া কিংবা চাকরি না পেয়ে সরকারি সাহায্যের ওপর নির্ভর করা যেমন প্রায় প্রতিটি ইমিগ্র্যান্ট-জীবনের গল্প, তেমনই সালিহা বেন আলীর জীবনেও রয়েছে এরকম নানাবিধ গল্প। কিন্তু সে গল্প তাকে কোনও ভাবেই ভিন্ন করেনি, বরং করেছে বৃহত্তর বেলজিয়ামবাসীর একজন। কারণ, এই পাওয়া বা না-পাওয়ার গল্প কেবল ইমিগ্র্যান্ট কমিউনিটির নয়, মূলধারার বেলিজিয়ামবাসীরও। তিন সন্তানের জননী সালিহা বেন আলী। বড় ছেলে সাবরি, বয়স ঊনিশ বছর, অন্তত ২০১৩ সালে তার বয়স ছিল ১৯ বছর। আজ বেঁচে থাকলে তার বয়স হতো তেইশ বছর। সাবরি মারা গেছে, বা বলা ভালো সাবরিকে হত্যা করা হয়েছে। আরও যদি একটু গভীরে গিয়ে দেখি তাহলে প্রায় কৈশোরোত্তীর্ণ সাবরি হয়েছে আমাদের এই পৃথিবীতে চলমান ধর্মীয় রাজনীতির বলি।
বেলজিয়ামের মতো একটি সর্বাংশে ইউরোপীয় সংস্কৃতির শহরে সাবরির মতো বালকেরা যেভাবে বেড়ে ওঠে, ঠিক সেভাবেই সে বেড়ে উঠছিলো। যদিও সালিহা বেন আলী মনে করেন যে, সাবরির ভেতর অনেক না-পাওয়ার ক্ষোভ জমেছিল, যা তিনি আগে কখনও লক্ষ্য করেননি। সাবরির ভেতর জমা প্রশ্নগুলো যেমন, কেন তাকে মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হচ্ছে? কেন সে চাকরি পায় না? (যদিও মাত্র ১৯ বছর বয়েসী কোনও মূলধারার ছেলেকেও অড-জব বা সেলসম্যানের চাকরি করতে হয়) কিংবা তাকে কেন তার পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন করা হয়? (যদিও এমন প্রশ্নের মুখোমুখি সব দেশেই সবখানে সংখ্যালঘুকে হতে হয়, যেমনটি এদেশে একজন হিন্দু বালক বা বালিকাকে হতে হয়, স্কুলে কিংবা খেলার মাঠে তাকে ধর্ম নিয়ে সামান্য হলেও কটাক্ষমূলক প্রশ্ন বা চাহুনির শিকার হতেই হয়)। কিন্তু সালিহা নিজে এ বিষয়ে তখনও জানতে পারেননি, যতোদিন না সাবরি তথাকথিত আইসিস-এর হয়ে সিরিয়ায় গিয়ে যুদ্ধে যোগ দেয়। মাঝে মাঝে দু’একটি মোবাইল ম্যাসেজে সাবরি মায়ের কাছে উষ্মা প্রকাশ করেছে, কখনও বা একথাও জানিয়েছে যে, বেলজিয়ামের স্থানীয় মসজিদে গিয়ে সাবরি কারও সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পায়নি, কারণ মসজিদগুলো খোলা থাকে শুধু নামাজের সময়গুলোতে। আর সে সময় সাবরির পক্ষে সেখানে গিয়ে তার ভেতরে জন্ম নেওয়া প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সম্ভব হয়নি। পারিবারিক ভাবে তার পিতা-মাতা দু’জন বিচ্ছিন্ন মানুষ, তাই বাবার কাছে গিয়েও তার পক্ষে কিছু জানা সম্ভব হয়নি। ফলে তার ভেতরে যে শূন্যতার জন্ম হয়েছে ঠিক সেখানেই আঘাত করার সুযোগ পেয়েছে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী আইসিস-এর প্রতিনিধিরা। যারা তাকে অনলাইনে প্রলুব্ধ করেছে এই ধ্বংসের পথে যোগ দিতে, এবং সেজন্য তারা লোভ দেখিয়েছে মৃত্যুর পরে অপার শান্তিময় জীবনের, তারা লোভাতুর করেছে সাবরিকে অনন্ত নারীসঙ্গের কথা বলে।

যে সাবরি কোনওদিন মায়ের কাছে কোথাও যাওয়ার অনুমতি নেয় না, সেই সাবরিই একদিন সন্ধ্যায় মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে যে, ‘আমি কি একটি বিবাহসভায় যেতে পারি?’ সালিহা বেন আলি অবাক হন ছেলের এই প্রশ্নে, তিনি হেসে সম্মতি দেন। কিন্তু সে রাতে সাবরি আর ফেরে না, সকালে সালিহা ছেলের রুমে ঢুকে বুঝতে পারেন, ছেলে কোথায় গেছে। অবশ্য তিনি ম্যাসেজও পান ছেলের কাছ থেকে, কোথায় গেছে সে সম্পর্কে। মাত্র ছ’মাস পরেই এক অপরিচিত কণ্ঠস্বর তাদেরকে জানিয়ে দেয় যে, ‘আপনার ছেলেটি শহীদ হয়েছে’, যদিও সিরিয়ায় যাওয়ার পর সাবরি’র নামটি পর্যন্ত বদলে দেওয়া হয়েছিল। মাত্র ঊনিশ বছর বয়সেই সাবরি নামের এই তরুণটি প্রাণ হারায় সিরিয়ায় তথাকথিত আইসিস-এর হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে। ছেলেকে হারিয়ে মা সালিহা বেন আলি যখন ভয়ঙ্কর দিশেহারা তখন তাকে শুরু করতে হয় নতুনতর সংগ্রাম।

সালিহা বেন আলী একপক্ষ তাকে দোষারপ করে তার ধর্মবিশ্বাসের জন্য, যা ছেলেকে জিহাদি হতে সাহায্য (নাকি বাধ্য?) করেছে। আরেকপক্ষ, যারা তার নিজের ধর্মে বিশ্বাসী, তারা সালিহাকে এসে বলে, ‘ভেবো না, তোমার ছেলে শহীদ হয়েছে। তার জন্য রয়েছে অপার শান্তিময় পরকাল’। সালিহা কারও কথাই ঠিক বুঝতে পারেন না, কেবল এটুকুই তিনি বুঝেন যে, তার ছেলেকে আর তিনি ফিরে পাবেন না, দূরদেশে গিয়ে তার ছেলে প্রাণ হারিয়েছে, তার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। আর হত্যা করেছে কারা? যারা তার মগজধোলাই করে জিহাদি বানিয়েছে, তাকে বেলজিয়ামের সাধারণ-সংগ্রামময় জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে গেছে মরুভূমিতে তথাকথিত ধর্মযুদ্ধে, যার কোনও ভিত্তি নেই। যে যুদ্ধ আসলে আরোপিত এবং বহুপক্ষের স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভুত, কল্পিত শত্রু সৃষ্টি করে অস্ত্র বিক্রি ও রাজনৈতিক ধর্মের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লোলুপতা থেকে সৃষ্ট সে যুদ্ধ।
সে কারণেই সালিহা বেন আলী নেমে পড়েন রাজপথে, শুরু করেন দেশে দেশে গিয়ে একজন মা হিসেবে ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে, ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা, ধর্মব্যবসায়ীদের জন্য তথাকথিত যুদ্ধে যোগ দিয়ে প্রাণ হারানো ছেলের গল্প বলে তিনি চেষ্টা করেন মানুষকে বোঝাতে বিশেষ করে সেই সব মায়েদের তিনি সঙ্গে তিনি যোগ দেন, যারা তাদের সন্তানদের সালিহার মতো হারিয়েছেন, যোগ দেন এ কারণে যে, তাদের গল্প বলে অন্য মায়েদের বোঝানো, যাতে তারা নিজের সন্তানকে বোঝার চেষ্টা করেন, চেনার চেষ্টা করেন, তাদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করে যাতে অন্য কাউকে এমন সুযোগ দেওয়া না হয়, সে সুযোগের কারণে সালিহা বেন আলির ছেলে সাবরি তথাকথিত ধর্মযুদ্ধে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে। নাইজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং আমেরিকায় গিয়ে সালিহা বেন আলি মায়েদের ভেতরে সন্তানকে বোঝার নতুন বোধ জাগ্রত করতে চান, তৈরি করেন সোসাইটি এ্যাগেইস্ট ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজম বা সেইভ বা উগ্র সন্ত্রাসবাদের বিপক্ষে কাজ করার লক্ষ্যে একটি প্ল্যাটফরম। প্রতিবার প্রতিটি দেশে গিয়ে তিনি একাধিক আয়োজনে কথা বলেন, যেখানে ডাকা হয় সেসব দেশের সুশীল সমাজকে, রাজনৈতিক দলকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কিংবা যারাই শুনতে চান একজন সন্তানহারা মায়ের গল্প, সেখানে তিনি তার গভীর দুঃখের গল্প শোনান আর গল্পশেষে আহ্বান জানান মায়েদের, সাধারণ মানুষকে, নীতিনির্ধারকদের এই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য। কতটুকু কাজ হয় তাতে সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় এখনও আসেনি, কিন্তু কে জানে হয়তো এর মাধ্যমে একজন মাকেও যদি সচেতন করা যায় কিংবা একজন মানুষের ভেতরও যদি জাগ্রত করা যায় মানবতাবাদ উগ্র সন্ত্রাসবাদের জন্য প্রবল ঘৃণা, তাহলে সেটাই হবে সালিহা বেন আলির সাফল্য। তার হারানো সন্তানের দুঃখ এতে কতোটুকু লাঘব হবে সেটা জানি না, কিন্তু অন্য কোনও মাকেতো এরকম দুঃখ পেতে হবে না, তাই না?

সালিহা বেন আলী এসেছিলেন বাংলাদেশে, ঢাকায় বিভিন্ন আয়োজনে তিনি যখন তার সন্তানের গল্পটি বলেছেন, তখন তিনি যেমন কেঁদেছেন, উপস্থিত অনেকের চোখকেই করেছেন অশ্রুসজল। তখন আর তাকে বাংলাদেশের একজন সালেহা-মায়ের চেয়ে পার্থক্য করা যায়নি কোনও ভাবেই। এদেশেও একের পর এক সাবরিরা (পড়ুন নিবরাস কিংবা হলি আর্টিজান বা শোলাকিয়ায় হামলাকারীদের যে কেউ) এই উগ্র ধর্মান্ধ হিংস্রতার পথ বেছে নিয়েছে, এদেশের মাটিতেই ঘটিয়েছে ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড, কিংবা পাড়ি দিয়েছে বিদেশে, তথাকথিত আইসিস-এর হয়ে যুদ্ধ করতে, তথাকথিত ধর্মযুদ্ধ। যে যুদ্ধ কে করছে, কার জন্য করছে তার কোনও ঠিক ঠিকানা নেই, যেমন নেই সে যুদ্ধের লেজ অথবা মাথার কোনও চিহ্ন কোথাও। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বা উগ্র ধর্মান্ধ শক্তিটি কতোশত সাবরি বা নিবরাসের জীবন নষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে তার প্রকৃত হিসেব অজানা হলেও একথা আজ দিনের আলোর মতোই সত্য যে, এদেশে এদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাই এই ভয়ঙ্কর দানবকে রুখতে যে কোনও পদক্ষেপই গুরুত্বপূর্ণ আর সে কারণেই এই নির্মম সময়ে সালিহা বেন আলির বাংলাদেশে আসাটা এবং তার অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য একাধিক অনুষ্ঠান আয়োজন খুবই জরুরি ও সময়োচিত পদক্ষেপ, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।

কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, এরকমই একটি আয়োজনে সালিহা বেন আলীর সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে গিয়ে এদেশের এক শ্রেণির এনজিও-জীবীদের চরম রাজনৈতিক হয়ে ওঠার যে দৃশ্য দেখা গেলো, তা ছিল রীতিমতো নোংরা এবং স্বার্থবাজির চরম উদাহরণ। এর চেয়ে সাধারণ মায়েদের ডেকে যদি তাদের অভিজ্ঞতার গল্প শোনানো যেতো সালিহাকে তাহলে এই প্রমাণই পাওয়া যেতো যে, বেলজিয়ামের সালিহা আর বাংলাদেশের সালেহা’য় পার্থক্য আসলে নেই, সবারই এক পরিচয়, তারা সবাই একেকজন ‘মা’। আর কোনও মা’ই আসলে নিজের সন্তানকে নিয়ে কোনও ধরনের রাজনীতিকেই প্রশ্রয় দেবেন না, তিনি বেলজিয়ামের মা হোন আর বাংলাদেশের মা হোন।

বেলজিয়ামে যেমন মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াকে সালিহা বেন আলী নিজের সন্তানের জন্য দুর্ভাগ্যজনক মনে করেন তেমনই বাংলাদেশের সালেহাও যদি জানতে পারেন যে, তার ছেলেকে সামনে রেখে এদেশের এক শ্রেণির এনজিও-জীবী তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইছেন, তাহলে তারাও বিষয়টিকে ভালোভাবে নিতে পারবেন না।

বিদেশিদের সামনে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে এতোটা খোলা না করে সালিহা বেন আলীর বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব চষে বেড়ানোর উদ্দেশ্যকে গুরুত্ব দিলে এদেশের মায়েদের জন্য তা হতো অত্যন্ত উপকারের, যেটি হয়নি। আমি আয়োজকদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না, প্রশ্নটি তুলছি এদেশের এনজিও-নেতৃত্বের উদ্দেশ্যে।

সালিহা বেন আলী’র মতো এদেশের সালেহা-মায়েরাও সাহসী হয়ে উঠুন, তারাও এগিয়ে আসুন, প্রতিবাদী হোন, সোচ্চার হোন ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে এবং নিজের সন্তানকে এই সন্ত্রাসের হাত থেকে রক্ষা করার সঙ্গে এদেশকেও রক্ষা করুন।

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন শুনানি হয়নি
গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন শুনানি হয়নি
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
র‌্যাবের নতুন মুখপাত্র কমান্ডার আরাফাত
র‌্যাবের নতুন মুখপাত্র কমান্ডার আরাফাত
২০৪১ পর্যন্ত কর অব্যাহতি আদায় করতে চাই: মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম
বেসিস নির্বাচন২০৪১ পর্যন্ত কর অব্যাহতি আদায় করতে চাই: মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ