X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

শৃঙ্খলাহীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১২:৪৭আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৬:০৭

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা দেখিয়ে দিয়েছেন তারা কতটা পারেন। চিকিৎসা বিদ্যায় না হলেও শারীরিক ও দলগত সক্ষমতা দেখানোর কাজটা তারা প্রায়ই দেখিয়ে থাকেন। শুধু ইন্টার্নরা নয়, এই পেশার অনেকেই। গত রোববার এই হাসপাতালে ফ্যানের সুইচ সম্পর্কে জানতে চাওয়া নিয়ে বাকবিতণ্ডার জের ধরে ইন্টার্নরা এক রোগীর ছেলেকে মারধর করে গুরুতর আহত করেছেন। তাকে পা ধরে ক্ষমা চাইয়েছেন একং ১০০ বার কান ধরে ওঠবোস করিয়েছেন। এরপর তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছেন; চিকিৎসা সেবায় পুরোপুরি যোগ দেওয়া আগে হাসপাতাল অনুশীলন করতে থাকা এসব নবীন চিকিৎসক। শুধু তাই নয়, নিরাপত্তার অজুহাত তুলে সেই ইন্টার্নরাই আবার চিকিৎসাসেবা থেকে বিরত থাকেন। তারা জরুরি বিভাগে তালা দিয়ে ধর্মঘট করেন। ফলে দুর্ভোগে পড়েন রোগীরা। আরও দুঃখজনক, যার ছেলেকে মারধর করা হয়, সেই রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এই মহান পেশার মহতীরা এতটাই মারমুখী যে, মার খাওয়ার ভয়ে বাবার লাশ আনতে যেতে পারছেন না তার সন্তানরা।
বাংলাদেশের সরকারি স্বাস্থ্যসেবার একটি অসাধারণ চিত্র এটি। জনগণও আসলে জানেইনা যে, চিকিৎসা পেশা কোনও সেবামূলক কিছু নয় এখন আর। সাথে যদি থাকে রাজনীতির যোগ, তাহলে কে ঠেকায় সাধারণ মানুষের এমর মারধর খাওয়া? বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের হামলায় রোগীর স্বজন মার খাওয়া কিংবা রোগীর সঙ্গে আসা লোকদের দ্বারা হাসপাতাল ভাংচুর হওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা দেশে।
রোগীদের দিক থেকে বড় অভিযোগ ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসায় অবহেলা। সবসময় রোগীর এই অভিযোগ হয়তো ঠিক নয়। আর তার প্রতিক্রিয়ায় হাসপাতাল ভাংচুর বা ডাক্তার নির্যাতন কোনোভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসায় অবহেলা যে একেবারে ঘটছে না তাতো নয়। কিছুদিন আগে ফরিদপুরে ও চট্টগামে পর পর দু’বার বেঁচে থাকা রোগীকে মৃত ঘোষণা দিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছে।

সমস্যাতো শুধু ডাক্তারের আচরণে বা রোগীদের প্রতিক্রিয়ায় নয়, অনেক গভীরে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যচিত্রটি বেশ জটিল। মফস্বলতো আছেই, রাজধানী ঢাকার যে কোনও সরকারি হাসপাতালে গেলেই তা বোঝা যায়। রোগীর তুলনায় শয্যার অপ্রতুলতা, চিকিৎসকদের অভাবতো আছেই। সমস্যা আছে হাসপাতাল প্রশাসনের সঙ্গে চিকিৎসক, রোগী ও রোগীর আত্মীয়দের সমন্বয়ের, যা মাঝেমধ্যেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার শৃঙ্খলাহীনতা জানিয়ে দেয়।

হাসপাতালগুলোতে সুস্থ অবকাঠামো আর পরিবেশের অনুপস্থিতি ভয়ংকর। এক্স-রে, ইসিজি, ইইজি, সিটি স্ক্যান ইত্যাদি রোগ নির্ণয়ের জরুরি যন্ত্রপাতি অধিকাংশ হাসপাতালেই অকেজো থাকে, যার ফলে রোগীদের বাইরে থেকে এসব পরীক্ষা করিয়ে আনতে হয়। কিন্তু সিরিঞ্জ, সুচ, স্পিরিট বা গজ-তুলার মতো সামান্য উপকরণগুলোও প্রায়ই সরকারি হাসপাতালে মজুত থাকে না।

সেবার সংকট আস্থার সংকটকে এতো তীব্র করেছে যে, প্রায়ই বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের হাতে চিকিৎসকরা নিগৃহীত হচ্ছেন। আর এর প্রতিবাদে কর্মবিরতি পালন করেন চিকিৎসকরা। স্বজনরা মারমুখী হন, কারণ, তারা চিকিৎসকদের ভরসায় রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। কিন্তু চিকিৎসকদের সেবা পছন্দ না হলেই তাদের ওপর চড়াও হচ্ছেন।

চিকিৎসকরা প্রশ্ন করেন শুধু তাদের ওপরই কি সব নির্ভর করে? তারা কী দিয়ে চিকিৎসা করবেন, যদি তাদের কাছে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা-সামগ্রী মজুত না থাকে?  যদি হাসপাতালের বেডের চেয়ে রোগী অনেক বেশি হয়? যদি চরম অব্যবস্থাপনা আর নৈরাজ্যই স্বাভাবিক হয়ে থাকে? প্রশ্নগুলো যৌক্তিক। কিন্তু তাদের আচরণ কি এমন হতে পারে যা বগুড়ায় ঘটলো? বাংলা ট্রিবিউনেই আমরা দেখেছি সরকারি ডাক্তার মফস্বলের দায়িত্বে অবহেলা করে ফুলটাইম কাজ করছেন রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে।   

রাজধানী সরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থা যখন ভালো নয়, তখন জেলা, উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ের হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর অবস্থা কী রূপ, কল্পনা করতেও ভয় লাগে। একদিকে সরঞ্জামের অভাব, অন্যদিকে মাসের পর মাস চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ক্রমেই সাধারণের নাগালের বাইরে নিয়ে গেছে।

বর্তমানে বেশ কিছু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভালো বাড়ি হয়েছে, বেশ কিছু উন্নত যন্ত্রপাতি বসেছে, কিন্তু এ সব যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, অর্থাৎ রোগীর চিকিৎসা করা সেই উদ্দেশ্যকে সফল করতে যে আন্তরিকতা দরকার তা অনেকাংশে নেই চিকিৎসকদের। শুধু যন্ত্র সব কাজ করতে পারে না। রাজধানীর বাইরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ডাক্তারদের হাজিরার করুণ চিত্র এবং রোগী দেখার আন্তরিকতার অভাব সবাই জানে। চিকিৎসা না পেয়ে গ্রামের রোগী শহরের হাসপাতালগুলোয় চাপ তৈরি করছে।

অনেক সমস্যা নিয়ে কাজ করেন চিকিৎসকরা, একথা সত্যি। তবে এটাও সত্যি যে সরকারি চাকরিটা এখন অনেক ডাক্তারে কাছে নিশ্চিত ভালো মাইনের আয় আর প্রাইভেট প্র্যাকটিসে রোগী টানার যোগাযোগের মাধ্যম মাত্র। রাজনীতি করে ভালো পদ বাগিয়ে নেওয়া মাত্র। অন্য শ্রেণিকর্মীর কাছেও বর্তমানের নিশ্চিত আয় আর সঙ্গে কমিশন ব্যবসা বা অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার মতো কত কী বাণিজ্য।

উপরে অনেকগুলো যদির কথা উঠেছে। প্রশ্ন হলো যদি মানসিকতা না গড়ে ওঠে, তা হলে যতই হাসপাতাল, সরঞ্জাম, ডাক্তার সরকারি ব্যবস্থায় বাড়ানো হোক না কেন, তা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা কম। সরকারি ব্যবস্থা যতই দুর্বল হচ্ছে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের হাতে ক্রমশ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চলে যাচ্ছে। এবং তার পরিণতি হলো আনাচে কানাচে ক্লিনিক আর ডায়গনস্টিক ব্যবসা, যেখানে সেখানে যেমন তেমন হাসপাতাল আর সাধারণ মানুষের টাকার শ্রাদ্ধ। করপোরেট হাসপাতাল বা প্রাইভেট প্র্যাকটিসেও নৈরাজ্যের আওয়াজ পাওয়া যায়। এতে করে চিকিৎসার মতো মহান পেশার মহত্ত্ব আজ প্রশ্নের মুখে।

এসব কি চলতেই থাকবে? চিকিৎসাপ্রার্থী রোগীদের ন্যূনতম সেবা দেওয়ার বন্দোবস্ত কবে হবে এই দেশে? স্বাস্থ্য-প্রশাসনের তরফে একটু দায়বদ্ধতা, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে একটু সদিচ্ছা, চিকিৎসাপ্রার্থী অসহায় রোগীদের প্রতি মানবিকতা ও সহানুভূতির একটু তাগিদ দেখবার আশায় মানুষ।

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সীমান্তে কোনও ধরনের হত্যাকাণ্ড চায় না বাংলাদেশ
সীমান্তে কোনও ধরনের হত্যাকাণ্ড চায় না বাংলাদেশ
দুর্নীতির মামলায় মেজর মান্নান কারাগারে
দুর্নীতির মামলায় মেজর মান্নান কারাগারে
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আমাদের অবশ্যই জেতা উচিত: সাকিব
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আমাদের অবশ্যই জেতা উচিত: সাকিব
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ