X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাংস্কৃতিক হতাশার মূলেও রাজনীতি

গোলাম মোর্তোজা
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৬:৩৭আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৬:৩৯

গোলাম মোর্তোজা ট্রাফিক কনস্টেবল বা ট্রেনের চালক হওয়ার আগ্রহ শিশুকালে অনেকেরই থাকে। মুখস্থ রচনায় তারা পাইলট, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
ক্ষমতা বা সাফল্য বা বড় কিছুর প্রতি মোহ মানুষের শিশুকাল থেকেই। ভেতরে কোথাও ব্যাপারটা থেকে যায়। তারই প্রকাশ ঘটে ট্রাফিক কনস্টেবল হতে চাওয়ায় বা ট্রেন চালানোর ইচ্ছায়। একজন ট্রাফিকের হাতের ইশারায় ছোটবড় সব গাড়ি থেমে যায়, এতবড় ট্রেন একজন চালিয়ে নিয়ে যায়! বিস্মিত শিশুমন নিজেকে সেখানে কল্পনা করে। পাইলট, ইঞ্জিনিয়ার; তাও সেই বড় কিছু হওয়ার স্বপ্ন থেকেই।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর স্বপ্ন বদলায়। ট্রাফিক কনস্টেবল বা ট্রেনের ড্রাইভার আর সে হতে চায় না। পাইলট, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন তখনও থাকে। তবে সমাজ বাস্তবতার প্রভাবে তার স্বপ্ন আবর্তিত হয়। একটা দেশ-সমাজের চেহারা যেমন, মানুষও তেমন মন-মানসিকতা, স্বপন্ন নিয়েই বেড়ে ওঠে। ভালো মানুষ, ন্যায় নীতিবান মানুষ আমাদের মতো দেশে সফল মানুষ হিসেবে সাধারণত পরিচিতি পান না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনৈতিক, অসৎ মানুষই সফল মানুষ হিসেবে সমাজে বড়ভাবে পরিচিতি পান। এটা আমাদের জাতিগত সাংস্কৃতিক সংকট। এই সাংস্কৃতিক সংকটে উন্নত-সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। পুরো সমাজ সফল হওয়ার সংস্কৃতিকে ধারণ করে। যেহেতু ন্যায়পথে সফল হওয়া কষ্টকর, সেহেতু অধিকাংশ মানুষ ন্যায়ের পথ পরিত্যাগ করে।
দেশ পরিচালনা করেন রাজনীতিকরা। তারা যা করেন, যে নীতিতে চলেন, সে সংস্কৃতি ধারণ করেন, জনমানুষের ওপর তার বড় প্রভাব পড়ে। এই প্রভাবের ফলে সমাজের একটা চেহারা দৃশ্যমান হয়। বর্তমানের বাংলাদেশকে আমরা তেমন একটা চেহারায় দেখছি। এখন অনেকের কপালে ভাঁজ পড়লেও এর সূচনা যে বহু আগে থেকে হয়েছে, তা অনুধাবন করতে চাই না বা স্বীকার করতে চাইছি না। রাজনীতির ক্ষেত্রে দুই-একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে:

ক. বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের দিকে তাকান। তাকান মওলানা ভাসানীর জীবনের দিকে। একজনের সঙ্গে আরেকজনের নীতি নিয়ে একটা পর্যায়ে এসে দ্বিমত আছে, বিতর্ক আছে। কিন্তু কোথাও নীতিহীনতা নেই। বঙ্গবন্ধু জীবনে আন্দোলন-সংগ্রাম-জেল, কত কষ্ট! সামান্য আপসে বিশাল লাভের সম্ভাবনা। কোনও দিন সে পথে যাননি, চিন্তা-ই করেননি। বঙ্গবন্ধুকে যারা অপছন্দ করেন, তীব্রভাবে তার রাজনীতি, দেশ পরিচালনা নিয়ে সমালোচনা করেন, বঙ্গবন্ধুর আর্থিক অসততা বা নীতিহীনতার (পরিবর্তন আর হীনতা এক নয়) সমালোচনা তারাও করেন না। বঙ্গবন্ধুর চারপাশে যারা ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদসহ কারও আদর্শ বা আর্থিক অসততা নিয়ে প্রশ্ন ছিল না। ছিল না বলেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আন্দোলন, তার শারীরিক অনুপস্থিতিতে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে।

খ. স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু বা তাজউদ্দীন আহমদরা অসততার সঙ্গ আপস করেননি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর চারপাশের অনেকে বা অধিকাংশ নেতা আপস করেছেন। নীতিহীনতায় ডুবে গেছেন। খেয়াল করে দেখুন, ১৯৭১ সালের আগে যাদের প্রায় কিছুই ছিল না, তাদের অনেকে স্বাধীন দেশে হঠাৎ করে বিত্তবান হয়ে উঠলেন। এখন তাদের অনেকে বিশাল ধনী। অথচ তারা দৃশ্যমানভাবে রাজনীতি ছাড়া অন্য কিছু করেননি। সেই সময়ের তরুণ এখন যারা রাজনীতিতে আছেন, তাদের অর্থ-বিত্তের বিশ্বাসযোগ্য উৎস খুঁজে পাবেন না। কিন্তু তারা অর্থ-বিত্তের মালিক।

গ. স্বাধীনতার পর, রাজনীতিবিদদের অসততা, নীতিহীনতায় ডুবে যাওয়ার সুযোগ নিয়েছেন সামরিক শাসকেরা। পুরো দেশ-সমাজ-প্রশাসনকে তারা কলুষিত করে দিয়ে গেছেন। তা করেছেন রাজনীতিবিদদের ব্যবহার করেই। আজকের সামাজিক অবক্ষয়ের দায়ভার, সামরিক শাসকদের তো বটেই, রাজনীতিবিদরাও সমভাবে তার জন্য দায়ী।

২.

অসৎ, অনৈতিক পথে অর্থ উপার্জন করে সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়াটা আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিতে প্রায় বৈধতা পেয়ে গেছে। ছাত্র সংগঠনের নেতারা দু’এক বছরের মধ্যে কোটিপতি হয়ে যায়। কেউ প্রশ্ন করে না, কী করে সম্ভব? সে তো ছাত্র! এমপি হওয়ার আগে যার প্রায় কিছুই থাকে না, পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি হয়ে ওঠেন বিশাল ধনী। পাঁচ বছরে ১৫ লাখ টাকা হয়ে যায় ৬০ কোটি টাকা। একটি পুকুর বা খালেরও মালিক যিনি নন, তিনিও ‘মৎস্য চাষ’ করে শত কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। যার দশ একর জমি ছিল না, হয়ে গেছেন ৩ হাজার একর জমির মালিক। এখন এই ধারা বিস্ময়করভাবে বেড়েছে। তারেক জিয়াদের ৫০ কোটি টাকার দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, আলোচনা হয়েছে কোকোর ২০ কোটি টাকা ফিরিয়ে আনা নিয়ে। এখন হাজার কোটি টাকাও বড় দুর্নীতির আলোচনা নয়। পরিমাণে কমবেশি দিয়ে যদিও দুর্নীতি পরিমাপ করা উচিত নয়। তা করছিও না। কিন্তু দুর্নীতিকে নীতিতে পরিণত হওয়ার ধারা বা সংস্কৃতি বেশ ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। যে শিশু আগে ট্রাফিক কনস্টেবল বা ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইত, সে আগামীর বাংলাদেশে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায় একটি ব্যাংকের এমডি না হোক অন্তত পরিচালক হতে চাইবে। এটাই হবে তার নীতি-স্বপ্ন। এই পথে কষ্ট নেই, অর্থ আছে। অর্থের পরিমাণ শত বা হাজার কোটি।

রডের পরিবর্তে ‘বাঁশ’ দিয়ে রাস্তা-বিল্ডিং বানানো দেখে দেশের মানুষ এখন বিস্মিত হন না। রেললাইনে বাঁশের পাত বসিয়েও বড় কর্তারা পদে বসে থাকেন। হত্যা-ধর্ষণ মামলার আসামিদের মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। প্রতিটি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়। শিক্ষামন্ত্রীর গলাবাজি বন্ধ হয় না। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ব্যয়ে, সবচেয়ে নিম্নমানের রাস্তা-ফ্লাইওভার-ব্রিজ নির্মাণ হয়। সবচেয়ে নীতিবান গুণী মানুষদের সবচেয়ে বেশি অসম্মান করা হয়।

৩.

‘এগিয়ে যাওয়া’র গল্প সেই সমাজেই বেশি শোনা যায়, যে সমাজে আর্থিক অসততা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়ে যায়। একজন চোর-ডাকাত-লুটেরার বিপুল ব্যাংক ব্যালেন্স, বড় বাড়ি বড় গাড়ি  সমাজে সাফল্যের উদাহরণ হয়ে ওঠে। আদর্শ নিয়মনীতি, অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।

গৌরবের দিনগুলো পালিত হয় বটে, একটা শূন্যতাও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ‘একুশের সাজ’ আখ্যা দিয়ে অর্ধনগ্ন মডেলের ছবি ছাপা হয় পত্রিকায়! রসিকতা করা হয় একুশের খাবার নিয়ে। শহীদ দিবস, শোক দিবস, ভালোবাসা দিবস একাকার হয়ে যায়। শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়ার, সামনে থাকার রুচিহীন প্রতিযোগিতা লজ্জার কারণ হয় না!

এসব দেখে অনেককে বিস্মিত হতে দেখছি। বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। যে রাজনীতি দেশে চলছে, তাতে ‘৩০ লাখ শহীদের রক্তে একুশে ফেব্রুয়ারি’ দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই রাজনীতিতে এমনই হওয়ার কথা। দেশ পরিচালনাকারী রাজনীতিবিদরা যে সংস্কৃতি ধারণ করছেন, তা দেখে তরুণরা শিখছেন। ভালোবাসা দিবসের ফুল, শহীদ দিবসে খোঁপায় ঝোলাচ্ছেন। যেভাবে পুকুরহীন গুলশানের বাসিন্দা রাজনীতিবিদ মাছ চাষ করে কয়েক’শ কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন। বাংলাদেশে যে সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সেই সংস্কৃতি এসবই স্বাভাবিক। কোনোটাই বিচ্ছিন্ন নয়, একটার সঙ্গে আরেকটি সম্পৃক্ত।

অসততা যে সমাজে সাফল্যের মানদণ্ড, প্রশ্ন ফাঁস, উত্তর বলে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে পাসের বৃদ্ধি যে জাতির সাফল্য হিসেবে বিবেচিত, সে জাতি উন্নত মার্জিত সংস্কৃতি ধারণ করতে অক্ষম।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উপজেলা নির্বাচন: জেলা-উপজেলায় আ.লীগের সম্মেলন বন্ধ
উপজেলা নির্বাচন: জেলা-উপজেলায় আ.লীগের সম্মেলন বন্ধ
মিয়ানমার-থাই সীমান্তে আবারও বিদ্রোহীদের হামলা, থ্যাইল্যান্ডে পালাচ্ছে মানুষ
মিয়ানমার-থাই সীমান্তে আবারও বিদ্রোহীদের হামলা, থ্যাইল্যান্ডে পালাচ্ছে মানুষ
দেশের ৯ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি, পারদ উঠতে পারে আরও
দেশের ৯ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি, পারদ উঠতে পারে আরও
ভুয়া অবিবাহিত সনদের মেয়াদ বাড়াতে গিয়ে ধরা পড়লেন এক ব্যক্তি
ভুয়া অবিবাহিত সনদের মেয়াদ বাড়াতে গিয়ে ধরা পড়লেন এক ব্যক্তি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ