X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের এক রাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গে

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৬:৪৯আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৬:৫০

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী গত ১৫ ফেব্রুয়ারি (২০১৭) ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতা নিয়াহুর সঙ্গে হোয়াইট হাউসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠকের পর ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমি দুই রাষ্ট্র ও এক রাষ্ট্রের প্রস্তাব বিবেচনায় রাখছি। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন যে প্রস্তাবে খুশি, আমি তাকেই সমর্থন করব।’
দুই রাষ্ট্রনীতির ধারণা দীর্ঘদিনব্যাপী একটি লালিত ধারণা। আমেরিকা, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ এই ধারণার ওপর ভিত্তি করেই এতদিন ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কারও সঙ্গে পরামর্শ না করেই ট্রাম্প এককভাবে এমন একটি কথা বললেন, যেন ২০০৩ সাল থেকে দুই রাষ্ট্রের যে ধারণা লালন করে আসছে তাতে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।
দুই রাষ্ট্রের ধারণার ওপর এতদিন ধরে কিছু কাজ-কর্মও হয়েছে। গাজা সম্পূর্ণভাবে ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণে এবং গাজায় কোনও ইহুদি বসবাস করে না। সম্ভবত ট্রাম্প মিত্রদের সঙ্গে কোনও পরামর্শ না করে নিজের একটা ধারণার কথা নতুনভাবে পেশ করলেন। আসলে আমেরিকা কি দুই রাষ্ট্রনীতি পরিত্যাগ করতে উদ্যোগ নিচ্ছেন? ট্রাম্পের কথা কি তার সূচনা? এ যদি অবস্থা হয় তা হলে ফিলিস্তিনিদের অবস্থান এক রাষ্ট্রের মধ্যে কী হবে?

ট্রাম্পের এ বক্তব্যের পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জাতিসংঘে আমেরিকার স্থায়ী প্রতিনিধি ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। স্থায়ী প্রতিনিধি নিকি হেইলি বলেছেন, 'যুক্তরাষ্ট্র দুই রাষ্ট্রনীতির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। যারা মনে করেন, আমরা এ নীতি সমর্থন করি না, তারা ভুল ভাবেন না'। হোয়াইট হাউসের সংবাদ সম্মেলনে নেতানিহু উপস্থিত ছিলেন, তিনি ট্রাম্পের কথা নিয়ে কোনও কথা বলেননি। এ সম্পর্কে কোনও প্রশ্নেরও সরাসরি উত্তর দেননি। তিনি শুধু ইসরায়েল রাষ্ট্রকে একটি ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

জাতিসংঘ, আমেরিকা, রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন- এ চারপক্ষকে নিয়ে গঠিত কোয়াট্রেট। কোয়াট্রেট-এর সিদ্ধান্ত ছিল পূর্ব জেরুজালেমে নতুন কোনও ইহুদি বসতি হবে না। কিন্তু সম্প্রতি ইসরায়েল সরকার পূর্ব জেরুজালেমে বাড়ি নির্মাণের কাজের অনুমতি দিয়েছে এবং ইহুদিরা বসতি নির্মাণের কাজও আরম্ভ করেছে। নিরাপত্তা পরিষদ বসতি নির্মাণের উদ্যোগের নিন্দা জানিয়েছে এবং কাজ স্থগিত করার আহ্বানও জানিয়েছেন। ট্রাম্প কিন্তু এ সম্পর্কে কোনও কিছুই বলেননি। বরং ট্রাম্পের শপথ নেওয়ার পূর্বে উত্থাপিত মিসরের এ প্রস্তাবটা প্রত্যাহারের জন্য ট্রাম্প মিশরের প্রেসিডেন্ট জেনারেল শিশরকে অনুরোধ করেছিলেন। আবার বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ওবামা তার বিদায়ের প্রাক্কালে যে ২২১ মিলিয়ন ডলার অনুদানের অর্থ ফিলিস্তিনিদের জন্য অবমুক্ত করেছিলেন; ট্রাম্প শপথ নেওয়ার পর তা স্থগিত করে দিয়েছেন। এত ডিগ্রি বিরোধী অবস্থানে থাকার পর হঠাৎ করে নেতানিহুর সঙ্গে আলোচনার পর ট্রাম্প ঘুরে দাঁড়ালেন কেন আর মিষ্টি মিষ্টি করে উভয়ের সম্মতিতে এক বা দুই রাষ্ট্রের পক্ষে তার অবস্থানের কথা জানালেন কেন? কী অভিসন্ধি নেতানিহু আর ট্রাম্প আলোচনায় স্থির করতে পারেন তা নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। এক রাষ্ট্রনীতি ও ইহুদি রাষ্ট্রের ধারণা যে, একসঙ্গে চলতে পারে না সে কথা ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট গত সোমবার ১৩ ফেব্রুয়ারি বিস্তারিতভাবে এক সম্মেলনে বলেছেন। প্রেসিডেন্ট রুভেন রিভলিন বলেছেন এক রাষ্ট্রগঠিত হলে ফিলিস্তিনিদের পূর্ণ নাগরিকত্ব দিতে হবে। একই রাষ্ট্রে ইহুদিদের জন্য একরকম আর অন্যদের জন্য ভিন্ন ধরনের কোনও আইনি ব্যবস্থা হতে পারে না।

ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল রাষ্ট্রের মাঝে এখন ইহুদি ও ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা প্রায় সমান-সমান। আশেপাশের রাষ্ট্রগুলোয় আরও ৩০ লাখ ফিলিস্তিনি রয়েছে, তারা ফিলিস্তিনে ফেরত গেলে ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা হয়ত বা কিছু বেশিও হতে পারে। এখনও ইসরায়েলের রাষ্ট্র সীমানার ভেতরে বহু ফিলিস্তিনি বসবাস করে। বহু শহরের নির্বাচিত মেয়র ফিলিস্তিনি। তবে প্রশ্ন হলো, ইসরায়েল পরিপূর্ণভাবে একটি ইহুদি রাষ্ট্র। ধর্মীয় কাঠামোর মাঝে তো দুই ধর্মাবলম্বী লোকের বসবাস কখনও সম্ভব নয়। এ কথাটা ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট রুভেন রিভলিন উপলব্ধি করেছেন।

ইসরায়েলের গোঁড়া ইহুদিবাদীরা কখনও ধর্মীয় কাঠামো পরিবর্তনে সম্মত হবে বলে মনে হয় না। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং সব নাগরিকের সমান অধিকার ছাড়া-তো দুই বৈরি সম্প্রদায় এক রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারে না। জুইশ হোম পার্টির প্রধান নাফতালি বেনেট এতই উগ্রপন্থী যে, তিনি ফিলিস্তিনিদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার পক্ষে। নেতানিহু ওয়াশিংটনে সফরে যাওয়ার আগে বেনেট হুঁশিয়ার করে বলেছেন, দুই রাষ্ট্রের প্রশ্নে নেতানিহু যেন কোনও আলোচনার প্রশ্রয় না দেন। অবশ্য নেতানিহু ইশারা-ইঙ্গিতে ওয়াশিংটনে এ কথাটাই বলতে চেয়েছেন যে, তারা ইহুদি রাষ্ট্রে কাঠামোর মাঝে একটা স্বায়ত্তশাসিত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র কায়েমের পক্ষে।

২০১১ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্ত আরম্ভ হয়েছে। হিলারি ক্লিনটন তখন আমেরিকার পররাষ্ট্র সচিব। তিনিই হচ্ছেন আরব বসন্তের উদঘাতা। আরব বসন্ত দিয়ে তিনি সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতি অবস্থা ছারখার করে দিয়েছেন। খুব সফলতার সঙ্গে মধ্য-প্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোয় গৃহযুদ্ধ উস্কে দিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টায় হিলারি সফল হয়েছেন। অনুরূপ অবস্থায় ফিলস্তিনিদের আন্দোলন এখন মৃত প্রায়। ইসরায়েল সম্ভবব এখন চেষ্টা করছে, এ অবস্থায় দুই রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিত্যাগ করে এক রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে। যেখানে ফিলিস্তিনিদের আবাসের জন্য একটা স্বায়ত্তশাসিত এলাকাও থাকবে।

মধ্যপ্রাচ্যে শেখ শাসিত রাষ্ট্রগুলো ও সৌদি আরব আমেরিকার স্যাটেলাইট রাষ্ট্রের মতো। তারা ইরানের উত্থানে দুশ্চিন্তায় পড়েছে। কারণ ইরান-শেখতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। সৌদি আরব এখন ইসরায়েলেরও অঘোষিত বন্ধু। ইসরায়েল সম্ভবত ফিলিস্তিন সমস্যাটা তাদের সুবিধা মতো করে একটা সমাধানের পরিকল্পনা করছে, যেন মুসলিম দেশগুলো আর আমেরিকা ইসরায়েলকে সহায়তা দেবে বলে মনে হচ্ছে।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্পের সঙ্গে নেতানিহুর বৈঠক সম্ভবত সে বিষয়ের আলোচনাই উপজীব্য ছিল। ট্রাম্প আর নেতানিহুর কথাবার্তায় তাই অনুমান করা যায়। ইহুদিরা অদ্ভুত এক জাতি। প্রাচীন ইতিহাস পড়লে দেখা যায়, তারা কখনও কোনও জাতির বন্ধু ছিল না। বেথেলহেমে যখন যিশুর আবির্ভাব হয়েছিল এবং যিশু ধর্মপ্রচারে মনোনিবেশ করেছিলেন, তখন তার ধর্মের কথা শুনে মনে হয়েছিল, এটি ইহুদি ধর্মের বর্ধিত সংস্করণ। এজন্য পণ্ডিতেরা যিশুর ধর্মমতকে জুড়িও-খ্রিস্টানিটি বলেছিলেন। কিন্তু ইহুদিরা যিশুকেই সহ্য করেনি। আগাগোড়া ষড়যন্ত্র করে যিশুকেই ক্রশবিদ্ধ করেছিল।

যিশু যখন ধর্মপ্রচার করেছিলেন, তখন ফিলিস্তিন রোমানদের অধীনে। রোমানেরা মূর্তিপূজারি ছিল। পরবর্তী সময়ে কিন্তু তারা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিল। ইহুদিরা তাদের নেতা সায়মন কোখবার নেতৃত্বে রোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। স্থানীয় রোমান প্রশাসনকে তারা পরাজিতও করেছিল কিন্তু রোমান সম্রাট পরাজয়ের কথা শুনে ব্রিটেন থেকে তার শ্রেষ্ঠ জেনারেল জুলিয়াস সার্ভিবাসকে ১২ লিজিয়ন সেনাসহ ফিলিস্তিনে পাঠিয়ে ছিলেন। ১৩৫ খ্রিস্টাব্দে রোমান বাহিনীর কাছে সায়মন কোখরার বাহিনী পরাজিত হয়। রোমান ইতিহাসবিদ ক্যাসিয়াস ডাইও লিখেছেন রোমানেরা তখন নাকি পাঁচ লাখ আশি হাজার ইহুদীকে হত্যা করেছিলেন।

আর জেরুজালেমের পতনের পর জেরুজালেমে নাকি রোমানেরা নাঙল চালিয়ে জমি চাষ করেছিলেন। তখনই ইহুদিরা বিশ্বের সর্বত্র পালিয়ে যায়। তাদের প্রধান ধর্ম মন্দির দু-দু-বার রোমানদের হাতে ধ্বংস হয়েছিল। ইহুদিরা কখনও কোথাও রাষ্ট্র গঠন করেনি। তারা আর্থিকভাবে সব সময় সমৃদ্ধ ছিল। কোনও ঔপনিবেশিক শক্তির কাছ থেকে কোনও জায়গা কিনে তারা রাষ্ট্র গঠন করতে পারতো। কিন্তু তারা তা করেনি। তারা তাদের ঈশ্বরের কাছে তাদের মাতৃভূমি ফিলিস্তিন ফেরৎ চেয়ে রোদন করেছে শত শত বছর। ১৮১৩ বছর পর ১৯৪৮ সালে তারা ব্রিটেনের সহায়তায় ফিলিস্তিনে ফেরৎ আসে এবং ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল গঠন করে। ফিলিস্তিনিরাও কোনও বাহিরাগত নয়, তারা বৃহত্তম কেনানেরই ভূমিপুত্র। তারা পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের পর মুসলমান হয়েছিল। তাদের মাঝে অনেক ইহুদিও ছিল। রক্তের দিক থেকে ইহুদি আর ফিলিস্তিনিরা এক ও অভিন্ন। শুধু  ধর্ম তাদের পৃথক করেছে।

আমি ওপরে ইহুদিদের সম্পর্কে লম্বা কাহিনির অবতারণা করেছি, এজন্য যে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের পেছনে ইহুদিদের আবেগ আর ধৈর্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়ার জন্য। ফিলিস্তিনিরাও গত ৭০ বছরব্যাপী নিজের অস্থিত্বের অন্য লড়াই করছে ইহুদিদের সঙ্গে।

এখন দুই রাষ্ট্রের ধারণায় ফিলিস্তিনিদের জন্য যে রাষ্ট্রটির পরিকল্পনা করা হয়েছে, তার একাংশ আকাবা সাগরের কাছে গাজায় আর অন্য অংশ জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে। মধ্যখানে ইসরাইল রাষ্ট্র। তারা যদি করিডোর না দেয় তবে উভয় অংশের সঙ্গে সংযোগের আকাশপথ ছাড়া কোনও উপায় নেই। পোকা খাওয়া এরূপ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ফিলিস্তিনিদের যেকোনও উপকারে আসবে তা নয় বরং যুগ-যুগব্যাপী ইহুদিদের সঙ্গে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মাঝে সময় কাটাতে হবে। এর চেয়ে শাসনতান্ত্রিক রক্ষাকবচসহ সম-অধিকারের ভিত্তিতে উভয় জাতি এক রাষ্ট্র কাঠামোতে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারলেই সম্ভবত উত্তম হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ