X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

পালন এবং উদযাপনের ভারসাম্যহীনতা

তুষার আবদুল্লাহ
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১২:৫৮আপডেট : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:০২

তুষার আবদুল্লাহ বাঙালি বিপদে পড়েছে। দুটি শব্দকে জীবনের অভিজ্ঞতার কোন পাত্রে রাখবে, তা ঠাওর করতে পারছে না। যাপিত জীবনের কোন উপলক্ষটি পালন করতে হয়, আর কোনটি উদযাপনের নিক্তি ধরে সেখানে ভারসাম্যতো রাখতে পারছেই না, উপরন্তু এই দুইয়ের অর্থের গভীরতায় প্রবেশের যোগ্যতাটুকুও হারিয়ে বসেছে বাঙালি। পালনের সঙ্গে স্মরণ এবং শ্রদ্ধা যুক্ত। উদযাপনের সঙ্গে অর্জন এবং উৎসব জড়িত। আমাদের জাতীয় জীবনে পালন ও উদযাপন যোগ্য দিনের কমতি নেই। কোন দিনটি পালনের এবং কোন লগ্নটি উদযাপনের এ নিয়ে বাঙালির মধ্যে নিকট অতীতেও দ্বীধা ছিল না। জানা ছিল বিজয় দিবস অর্জন উদযাপনের। বিজয়ের উল্লাসে মেতে ওঠাই সঙ্গত।
উৎসবের রঙে রাঙতেও বাধা নেই। তবে সেই উৎসবে মেতে ওঠা হতো বিজয়ের কারিগরদের শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে। সেখানে তাদের স্মরণের বিষয়টিও উপক্ষিত থাকতো না। এই উপকরণগুলো সঙ্গে নিয়েই বিজয়ের বাধ ভাঙা আনন্দে বাঙালি মেতে উঠতো। ধীরে ধীরে এই উদযাপন আর সাংস্কৃতিক আয়োজনের মধ্যে সীমিত থাকলো না। সেখানে ধীরে ধীরে পতাকার রঙের পোশাক চলে এলো। পোশাকের সঙ্গে অলংকার। এবং ব্যবহৃত আরও অনেক কিছুই লাল-সবুজের রঙ পেলো। বাঙালির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যুক্ত হলো বিজয়ের কনসার্ট। পাতে বিজয়ের বিশেষ খাবার উঠলো। শুরু হলো উপহার বিনিময়। বাজার অর্থনীতির সঙ্গে আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সম্পর্ক তৈরি হলো। আমরা দেখতে পেলাম বর্ষবরণের যে গ্রামীণ রীতি, আচার আছে তা ভেসে গেল শোভাযাত্রা, পান্তা ইলিশ এবং পোশাকের কাছে। এখানে ঋতু সংক্রান্তি, হালখাতা, কৃষক ও শ্রমজীবি মানুষের আচার তুচ্ছ। বাঙালির বর্ষবরণ উৎসবে পোশাক দিয়ে বাঙালিয়ানার আবরণ দেওয়াটাও শুদ্ধ হচ্ছে না। সেখানে বাঙালি বনিকের কাছে অসহায় ভোক্তা মাত্র।
বিজয় দিবসের ঢঙে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করা হলো। তবে আগের দিনের কালো রাত্রি পালিত না হয়ে উৎসব বা উদযাপনের ছোঁয়া ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। একুশে ফেব্রুয়ারিকে বাঙালি শহীদ দিবস হিসেবেই পালন করে আসছিল। বাড়ি থেকে নগ্ন পায়ে ফুল হাতে শহীদ মিনার পর্যন্ত হেঁটে যাওয়াতে হতো বিনম্র শ্রদ্ধায়। পোশাকে সাদা-কালো শোকের রঙ না থাকলেও হৃদয়ে ভাষা সংগ্রামী ও ও শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা থাকতো পুরো মাত্রায়। শহীদ দিবসের চেতনার প্রকাশ এবং তা পরম্পরায় পৌঁছে দিতে দেয়াল পত্রিকা, সংকলন থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকতো। এই শহীদ দিবস যখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেলো, তখন থেকেই যেন একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের উপলক্ষ হয়ে উঠলো। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মোড়কে যেন বন্দি হয়ে গেল শহীদ দিবস। বাঙালির উচ্চারণে, ভাবনা থেকে শহীদ দিবস নিখোঁজ হয়ে গেল বলা যায়।

বাঙালির যে শ্রেণিটি সংস্কৃতি বা ইতিহাসের পৃষ্ঠপোষক বা রক্ষকের দাবিদার, তারাও মেতে থাকলেন কেবল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়েই। উত্তর প্রজন্মের কাছে শহীদ দিবস অজানাই রয়ে গেল। ফলে শহীদ দিবসের ব্যানারে চলে আসে সাত বীরশ্রেষ্ঠ’র ছবি। তাকে কেউ কেউ স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবস বলে ভাবতে থাকে। কারো কারো ধারণা ‘ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়েই এসেছে ২১শে ফেব্রুয়ারি’। তাই উদযাপনে কালো পোশাকের রঙের গাঢ়ত্ব, আভিজাত্য লালকেও ছাড়িয়ে গেছে। উৎসবের আমেজে ঘরে ঘরে, রেস্টুরেন্টে কেবল উল্লাস ধ্বনি। ভাষা সংগ্রামীদের ত্যাগ উপেক্ষিত। তবে তাদের ব্যবহার করতে আবার পিছিয়ে থাকছে না বাজার। বিজ্ঞাপনেও আমরা দেখতে পাই কিভাবে ক্রেতাকে উসকে দেওয়া হচ্ছে এই দিবসের জন্য বিশেষ পোশাক কিনতে, পোশাক কেনার আলমারি কেনার জন্যও তাড়া দিচ্ছে, খাবারের দোকানে ভিড় করতে, একুশকে ব্যবহার করে পণ্যের বিপণন এবার প্রথমবারের মতো প্রকটভাবে দেখা গেল। একুশ বা শহীদ দিবসকে অবলম্বন করে গণমাধ্যমও নারীকে পণ্য করে উপস্থাপন করেছে। উৎসবের আমেজে কনসার্ট এবং ডিজে পার্টিও বাদ যায়নি। কোনও কোনও গণমাধ্যম একদিন ইংরেজি প্রীতি থেকে বাংলায় স্থানান্তর করলেও, পরদিনই আবার ফিরে গেছে ইংরেজির কাছেই। একুশে পালন করতে গিয়ে পাড়া মহল্লায় হিন্দি গান বেজেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানার হিড়িক স্পষ্ট করেছে, বাঙালি প্রকৃত অর্থেই শহীদ দিবস উদযাপন করছে।

শহীদ দিবস উদযাপনে রূপ নেওয়ার নকশা বাস্তবায়নের পাঁয়তারা তখন থেকেই শুরু হয়, যখন প্রথম প্রহর হিসেবে ইংরেজি রীতিকে অনুসরণ করা শুরু হয়। ভোরের প্রথম আলোকে প্রহর হিসেবে গ্রহণ করেই বাঙালি শহীদ দিবস পালন শুরু করেছিল। কিন্তু ইংরেজি নববর্ষ বা থার্টি ফাস্ট পালনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা বাঙালি এক সময় প্রথম প্রহর হিসেবে বাংলা রীতিকে সরিয়ে দিয়ে ইংরেজি রীতিরই আত্মীকরণ করে। এই আত্মীকরণের সূত্র ধরেই শিক্ষা থেকে শুরু করে সর্বস্তরে বাংলা উপেক্ষিত রইলো, ইংরেজির আদর বাড়লো এবং স্মরণ দিবসে আমরা বিজয় উদযাপনে মেতে উঠলাম। বাঙালি বুঝি এভাবেই বেছে নিল আত্মহননের পথ।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘রানা প্লাজার দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে কর্মক্ষেত্রকে নিরাপদ করতে হবে’
‘রানা প্লাজার দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে কর্মক্ষেত্রকে নিরাপদ করতে হবে’
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাকি দুই টি-টোয়েন্টিতে অনিশ্চিত রিজওয়ান
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাকি দুই টি-টোয়েন্টিতে অনিশ্চিত রিজওয়ান
প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে বিএনপি নেতা বললেন ‘রিজভী ভাই আমাকে ফোন করেছিলেন’
প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে বিএনপি নেতা বললেন ‘রিজভী ভাই আমাকে ফোন করেছিলেন’
‘যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে সামাজিক কুসংস্কার’
‘যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে সামাজিক কুসংস্কার’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ