X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুই মলাটের মধ্যে যারা বাঁচে

শান্তনু চৌধুরী
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৫:২৩আপডেট : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৫:২৬

শান্তনু চৌধুরী হঠাৎ এসে হাজির হন সিরাজ ভাই। বলেন, ‘পানি দাও, রাফি গলা শুকিয়ে গেছে।’ ঘটনা কী। রাফি মুচকি মুচকি হেসে পানি এনে দেয়। তারপর জিজ্ঞাসা করে, ‘বড় ভাই কী হয়েছে?’
‘তুমি ভাবতে পারো রাফি, মৌখিক পরীক্ষায় কেউ ফেল করে?’
‘ক্যান ভাই, কী বলছিলেন পরীক্ষায়?’
‘আর বলো না টাকলু মাথার এক এক্সটারনাল এসেছিলেন তিনিই মনে হয় এই আকামটা করেছেন। আমারে জিগাইলো, প্রমথ চৌধুরী’র একটা বইয়ের নাম। আমি কইলাম ‘রায়তের কথা।’
‘হুম, ঠিকইতো বলেছেন?’
সিরাজ ভাই তোতলাচ্ছেন। কথা বলতে পারছেন না।

‘ওই স্যার জানতে চান, ‘রায়তের কথা’ কী ? আমি বললাম, ‘ওই যে দিনের কথা আর রাইতের কথা।’ অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আমার লেখা উপন্যাস ‘অন্য সময়ের প্রেম’ এর অংশ বিশেষ। এটা কিন্তু সত্য ঘটনা থেকে নেয়া। তেমনি আরো একটি ঘটনা এমন, শিক্ষক এক ছাত্রের কাছে মৌখিক পরীক্ষায় জানতে চান, ‘কপালকুণ্ডলার সাথে নবকুমারের বিয়ে হয়েছিল কিনা? জবাব এলো ‘হ্যাঁ’। দেনমোহর কত ছিল? ‘এক লাখ টাকা।’ জবাব দিলেন ছাত্র।

এসব ঘটনা বলার কারণ হচ্ছে শিক্ষার খণ্ডিত চর্চা আমাদের যে অজানার গহ্বরে নিয়ে যাচ্ছে সেটা জানানো। এমনিতে শিক্ষা লেজেগোবরে অবস্থায় রয়েছে হেফাজতের চাপে। (নিউইয়র্ক টাইমস এ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে) এর মধ্যে এখন বেশিরভাগই পড়ছেন পরীক্ষা পাসের জন্য। জানার জন্য পড়ার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। জিপিএ ফাইভ পাওয়ার জন্য দৌড়াচ্ছে সবাই। সবাই নিজের ছেলে-মেয়েকে পড়াচ্ছেন সকাল-বিকাল কোচিংয়ে। ফলে মানবিক মানুষ গড়ে উঠছে না।

সবাই শুধু ভুল-শুদ্ধ গাদা গাদা পড়ালেখা করে বই পড়ে ‘বই’ হচ্ছে। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ভালো ছাত্র ছিলেন, গণিতে ভালো নম্বর পেতেন আবার এমনও হয়েছে অনেক বিষয়ে তাঁর থার্ড ক্লাসও রয়েছে। অথচ তিনি রাজরীতির পাশাপাশি মেধার ক্ষেত্রে উদাহরণও হয়ে আছেন। আবার অনেক সময় দেখা যায়, শুধুমাত্র পরীক্ষা পাস করার জন্য যতটুকু জানা দরকার সেটিই পড়ছে। শেক্সপিয়রের খণ্ডিত অংশ বা রবি ঠাকুর, বঙ্কিমের কোনও গল্প। কিন্তু কোনও সৃষ্টিশীল লেখকের পুরো সৃষ্টিকে সে জানছে না। তাই ‘রায়তের কথা’ হয়ে যাচ্ছে ‘রাতের কথা’ আর ‘নবকুমার কপালকু-লাকে বিয়ে করছেন এক লাখ টাকা দেনমোহরে।’ আগে বইয়ের নিচে লুকিয়ে বই পড়া হতো। আর এখন ফেসবুকে চ্যাট করা হয়। শিক্ষকরা আগে যখন পড়াতে যেতেন বগলের নিচে বই দাবা করে যেতেন, এখন তেমন দেখা যায় না। এখন শিক্ষার্থীরাও প্রশ্ন খুঁজেন। সাজেশন চান।

প্রায় দিন অমর একুশে গ্রন্থমেলায় যাই, কত ঘটনা যে ঘটে। একবার একজন আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে দেখা। তিনি প্রায় প্রতিদিন টকশো করেন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে। জানতে চাইলাম, ‘বইমেলাতে নিশ্চয় অনেক বই কিনছেন, যেগুলো আপনার রেফারেন্স হিসেবে কাজে লাগবে?’ উনি আমাকে উত্তর দিলেন, ‘বই পড়ার মতো সময় কই।’ প্রতিদিন এতো এতো লোক বইমেলায় যান কিন্তু বের হওয়ার গেইট দিয়ে দেখি কারো হাতে তেমন বই নেই। তবে ২০ ফ্রেব্রুয়ারির পর চিত্র কিছুটা পাল্টেছে। বই কিনছেন এক শ্রেণির পাঠক আবার কেউ বা ব্যস্ত সেলফি তোলা আর ফেসবুকে আপলোড করা নিয়ে।  

একটি ভালো বই বদলে দিতে পারে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। বইমেলায় গেলে দেখা হয়ে যায় কত বড় বড় মানুষের সাথে। নিজেকে ধন্য মনে হয়। আবার অনেকে হয়তো স্বশরীরে সেখানে উপস্থিত নেই। কিন্তু তার সৃষ্টি দিয়ে তিনি স্পর্শ করে যান পাঠককে। তবে পঠনের দৈন্যও চোখে পড়ে। দেখা গেছে সেবা প্রকাশনী ছাড়া অন্য কোথাও অনুবাদ সাহিত্য ও সাহিত্যিকের সংখ্যা অনেক কম। অথচ এসব বিষয়ে পাঠকের আগ্রহ রয়েছে। অনেক বই হয়তো আছে কিন্তু প্রকাশকরা বিদেশি লেখকদের বই প্রকাশের অনুমতি পাওয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনুবাদ সাহিত্য প্রকাশে আগ্রহী হন না। আবার অনুবাদ বিষয়টা এমন অনেকে। পাঠকদের অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষায় অনূদিত বইয়ে সাহিত্যরস পাওয়াই যায় না। তেমনি অনেকটাই উপেক্ষিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বই। তবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে কোনও উপন্যাস বা সত্য ঘটনা নিয়ে লেখা উপন্যাসগুলো পাঠক টানছে। চাহিদা নেই জীবনী গ্রন্থের। একেবারে হাতেগোনা ভ্রমণ বিষয়ক সাহিত্যেও। তবে মানসম্পন্ন ভ্রমণ বিষয় লেখকের অভাব রয়েছে বলে জানালেন প্রকাশকরা। কবিতা, গল্প আর উপন্যাসের প্রতি পাঠকদের আগ্রহ বেশি থাকলেও প্রবন্ধ গ্রন্থের প্রতি তেমন আগ্রহ নেই।

বই মেলাতে প্রায় ৫০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয় প্রতি বছর। এটা গেলো বছরের হিসাব অনুযায়ী। অথচ প্রকাশকরা বলেন, বিক্রি নেই। তাহলে প্রতি বছর কেন বাড়ছে প্রকাশকের সংখ্যা। বাংলা ট্রিবিউনের বৈঠকি আয়োজন ‘হরেক রকম বই, হরেক রকম মেলা’তে লেখক আনিসুল হক বলেছেন, দেশে আটশো প্রকাশক রয়েছেন। পৃথিবীর কোনও দেশে এতো প্রকাশক নেই।

সে আলোচনায় আরো উঠে আসে, একটি বই প্রকাশের পেছনে লেখকের যে অক্লান্ত পরিশ্রম সেটিকে গুরুত্ব না দিয়ে তাকে কোনও সম্মানি না দিয়ে বই নেওয়ার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে সেটি পরিবর্তন জরুরি। আমাদের প্রকাশনার বাস্তবতা হচ্ছে তাই। বেশিরভাগ প্রকাশকই লেখকের সঙ্গে চুক্তি করেন না। ফলে দেখা যায়, মেলা শেষে বা পরে প্রতিষ্ঠিত লেখক না হলে বলে দেন ‘বই বিক্রি হয়নি’। আবার অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকও চুক্তি করেন না সম্পর্ক নষ্ট হবে বলে। নির্বিচারে বই বের হচ্ছে, অথচ লেখকের সাথে চুক্তি নেই। বড়ই আশ্চর্যের কথা। এক্ষেত্রে প্রকাশকদের কাছে যেন জিম্মি লেখক। তাদের অজুহাতের শেষ নেই। অবশ্য প্রকাশকরা বলেন, বইতো বিভিন্ন জায়গায় নিতে পারছেন না আবার নিলেও টাকা পাচ্ছে না।

এরপরও একদিন হয়তো নবজাগরণ ঘটবে। একসময় যেমন বিয়েতে বই উপহার দেওয়া হতো তেমনি বইকে ‘ছোট জিনিস’ না ভেবে আবারও উপহারের তালিকায় উঠে আসবে বই। যেটি পাল্টে দিতে পারে একজন মানুষকে। কালজয়ী কথাসাহিত্যিক সমারসেট মমের ছোট গল্প ‘বুক ব্যাগ’ এর নায়কের মতো হয়ে উঠবো আমরা। যে নায়কের একটাই নেশা বই পড়া। সেটি ছাড়া সে থাকতে পারে না। 

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
খিলগাঁওয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
খিলগাঁওয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
এই জন্মদিনে আরেক সিনেমার ঘোষণা
এই জন্মদিনে আরেক সিনেমার ঘোষণা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
স্থায়ী সংঘাতে পরিণত হচ্ছে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা: তুরস্ক
স্থায়ী সংঘাতে পরিণত হচ্ছে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা: তুরস্ক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ