X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশিদের দূরে রাখুন

আনিস আলমগীর
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:৩৯আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:৪৩

আনিস আলমগীর সাধারণ নির্বাচনের সময় এখনও কাছে আসেনি। শুনছি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন। এখনও প্রায় দু’বছর সময় বাকি। কিন্তু লক্ষ্য করছি বিদেশি দূতাবাসগুলো এখন থেকেই চঞ্চল হয়ে উঠেছে। নির্বাচন কমিশন নিয়োগ নিয়ে যখন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে ব্যস্ত তখনও একদল বিদেশি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কমিশনের নিয়োগ নিয়ে কথা বলার জন্য দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সময় বিদেশি গ্রুপটি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেনি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তখন বলেছিলেন- বিদেশিদের এ বিষয়ে মাথা ঘামানো উচিৎ নয়।
আমাদের রাজনীতিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়েও বিরোধীদল বিএনপি বিদেশি-দূতাবাসগুলোতে অভিযোগ উত্থাপনের জন্য দল বেধে যাওয়ার এক সংস্কৃতি দীর্ঘ সময়ব্যাপী লালন করছে। বিএনপির এ ধরনের সংস্কৃতি চর্চার ফলে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার এক কুঅভ্যাসে পেয়ে বসেছে বিদেশি দূতদের। এ বিনাশী ধারাটি টেনে এনেছে কিন্তু এককভাবে বিএনপি। আওয়ামী লীগ যে একেবারেই ধোয়া তুলসী পাতা, বিদেশি দূতাবাসে যায়নি তাও বলা যায় না। এক এগারো সময়কালে তারাও দূতদের যথেষ্ট পাত্তা দিয়েছে।
এখন আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি তার কূটনৈতিক কোর কমিটি পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হয়তো কিছুদিনের মাঝে দেখা যাবে মঈন খান, রিয়াজ রহমান তাদের বাসায় বিদেশি দূতদের খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে ডেকে এনে পুরনো ধারায় নির্বাচন, নির্বাচনকালীন সরকার ইত্যাদি বিষয়ে হাজারো-একটা অভিযোগ উত্থাপনের কাজটা শুরু করে দিয়েছেন। মিডিয়াও এই নিয়ে 'নাচানাচি' করছে।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট গুলশানের বিএনপি অফিসে গিয়ে দীর্ঘ দু’ঘণ্টা বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে এসেছেন। বার্নিকাট নাকি ৪০ মিনিট বেগম জিয়ার সঙ্গে একান্ত আলাপ করেছেন। একান্ত আলাপের মাজেজা রহস্যাবৃত থাকে। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও তার একান্ত আলাপ হয়েছিলো। নির্বাচন আর রাজনীতেই সে আলাপে স্থান পেয়েছে বলে খবর বেরিয়েছিল।

বেগম জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের আগে বার্নিকাট সচিবালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। বৈঠক শেষে তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে তার কূটনৈতিক জীবনের দীর্ঘ ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতায় তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির মতো এতো জটিল বিন্যাস কখনও কোনওখানে দেখেননি। আসলে প্রত্যেক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সেই রাষ্ট্রের একটি সংবিধান থাকে। যে জাতি তার সংবিধানকে উপেক্ষা করে চলার চেষ্টা করে, তাদের সহজ জিনিসও জটিল রূপ ধারণ করে।

বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে কোনও দলকে এক তরফাভাবে জিতিয়ে দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রও সুন্দর সহজভাবে লিখিত। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যদি শাসনতন্ত্রকে মান্য করে চলতো তবে কখনও নির্বাচন নিয়ে এতো জটিলতা সৃষ্টি হত না। বিএনপি যখন ১৯৯১ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসে তখন মাগুরার উপ-নির্বাচনে উলঙ্গভাবে ভোট কারচুপি করে জিতেছিল। একই কাণ্ড করেছে ঢাকার তেজগাঁও আসনে। তখনই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তোলে সব বিরোধীদল, এমনকি জামায়াত ইসলামীও। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের পর বাধ্য হয়ে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলো।

আবার নবম সংসদের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করে ফেলে। অনদিকে সুপ্রিম কোর্টও রায় প্রদান করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করে দেয়। ২০০৮ সালের দশম সংসদের নির্বাচনে জিতে এসে আওয়ামী লীগ শাসনতন্ত্র থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে রহিত করে দেয় এবং অন্তবর্তী সরকার ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে সংযোজন করে। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য বিএনপি জামায়াত তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর- এই চার মাস আন্দোলন করে তারা ৩১৯ জন মানুষ হত্যা করে। হাজার হাজার যানবাহন জ্বালিয়ে দেয়, রাস্তার পাশ্বের হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচন প্রতিহত করার চেষ্টা করে দেড় শতাধিক কেন্দ্রে আগুন দেয়, প্রিসাইডিং অফিসার হত্যা করে, পুলিশ হত্যা করে। বিএনপি জামায়াতের সন্ত্রাসের মাঝেই দশম সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সন্ত্রাসের কারণে ভোট বাধাগ্রস্থ হলেও শেষ পর্যন্ত দশম সংসদ গঠিত হয়েছিলো। বেগম জিয়ার পক্ষ অবলম্বন করে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত দিল্লির দরবার পর্যন্ত গিয়েছিলো নির্বাচন স্থগিত করার জন্য। আমেরিকা আর ভারত সম্মিলিতভাবে বললে হয়তো শেখ হাসিনাকে নির্বাচন স্থগিত করতে বাধ্য করা যেত কিন্তু ভারত তাতে সম্মত হয়নি। নির্বাচনও স্থগিত হয়নি।

একাদশ সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০১৯ সালে। বিএনপি নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবি তুললেও অনির্বাচিত কারো হাতে ক্ষমতা প্রদান এখন আর সম্ভব নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিরপেক্ষ হলেও এটা অনির্বাচিত এ অজুহাতে সুপ্রিম কোর্ট সে ব্যবস্থা রহিত করেছেন। সুতরাং সে ব্যবস্থায় আর ফিরে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। বর্তমান ব্যবস্থার মাঝে থেকেই নির্বাচন করতে হবে। রাষ্ট্রদূতেরা দেশের সংবিধান লঙ্ঘন করার কোনও পরামর্শ দেবেন বলেও মনে হয় না। এখন বিএনপির উচিৎ নির্বাচন নিয়ে কোনও অজুহাত সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকা। নির্বাচন থেকে আবারও মুখ ফিরিয়ে না রাখা।

অনেকে মনে করছেন, বিএনপি আসলে নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলে তাদের নেত্রীর মামলা স্থগিত করতে চাচ্ছে। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী এরই মাঝে এ বিষয়ে কিছু কথাও বলেছেন। এখন নির্বাচন বিএনপির জন্য বড় সমস্যা নয়। তার জন্য বড় সমস্যা হচ্ছে বেগম জিয়ার বিচার এবং বিচারে যদি তার জেল হয়- তার পরবর্তীতে যে সংকট সৃষ্টি হবে তা মোকাবিলার ঝুঁকি। নেতৃত্ব শূন্যতা থেকে রক্ষা পাওয়া।

ভারতের বহু মূখ্যমন্ত্রীর দুর্নীতি মামলায় শাস্তি হয়েছে। লালু প্রসাদ যাদব নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি। তামিলনাডুর মূখ্যমন্ত্রীকে মূখ্যমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। কিন্তু তারা রাষ্ট্রীয় জনতা দল বা আন্না ডিএমকের পদ থেকে অবসরে যাননি। লালু প্রসাদের দল বিহারের গত বিধানসভার নির্বাচনে নীতিশ কুমারের জনতা দল (সেক্যুলার) এবং কংগ্রেসের সঙ্গে ফ্রন্ট করে নির্বাচন করেছে। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে বিহারে রাজ্য সরকারও গঠন করেছে। লালুর ছেলে ডেপুটি চিফ মিনিস্টার হয়েছে। লালু সারা রাজ্যে দাপিয়ে জনসভা করেছেন।

সুতরাং যদি বেগম জিয়ার শাস্তিও হয় সে কারণে তো তাকে দল থেকে অবসরে যেতে হবে না। তিনি তার দল নিয়ে নির্বাচন করতে পারবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলে সরকারও গঠন করতে পারবেন। হয়তো তিনি বা তার ছেলে তারেক জিয়া প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। তারেকের স্ত্রী বা আর দলের অন্য কোনও নেতা প্রধানমন্ত্রীও হতে পারবেন। বঙ্গোপসাগরের সব পানি সরবত হলে আমার কী- আমি যদি পান করতে না পারি। নিশ্চয়ই বেগম খালেদা জিয়া এমন কোনও মনোভাব পোষণ করেন না।

বেগম জিয়া রাজনীতিতে যোগদানের পর দুই দুই বার পরিপূর্ণ মেয়াদের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন আর অন্য একবার ৪২ দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। জাতি তাকে অনেক কিছু দিয়েছে। সুতরাং রাজনীতিতে কোনও সংঘাত সৃষ্টি না করে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন করাই হবে যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। কানাডার ফেডারেল কোর্ট বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলেছে। ২০১৪ সালের দশম সংসদের নির্বাচনের পূর্বে দীর্ঘ চার মাসব্যাপী যে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিলো, যা দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রচার পেয়েছিলো। সম্ভবতো তারাও মিডিয়ার বদৌলতে তা অবগত আছেন। যে কারণে আদালত অনুরূপ অবজারভেশন দিয়েছেন। এরূপ একটা বিদেশি ফেডারেল কোর্টের অবজারভেশন দলের মূলে প্রচণ্ড এক আঘাত করেছে। সুতরাং বেগম জিয়া এখন বাড়াবাড়ি না করে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন করাও উত্তম হবে। আর দেশের রাজনীতির জন্য উত্তম হবে বিদেশিদের না জড়ানো। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরকারি দল, বিরোধীদল যত বেশি বিদেশি দূতদের দূরে রাখবেন জাতি হিসেবে আমাদের মর্যাদা তত বাড়বে।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ