X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ওহ কাদের, ডুব কাদের!

আহসান কবির
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৪:৫৭আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৫:০০

আহসান কবির লেখার শিরোনাম দেখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাহেব ঘাবড়ে যেতে পারেন। তাকে আনন্দের সঙ্গে জানানো যেতে পারে যে এই লেখায় তাকে নিয়ে কিছু বলা হচ্ছে না। তাকে আগেই জানিয়ে রাখার কারণ তিনি শুধু আদরই করেন না, চড়ও মারতে পারেন! ভয় কার না আছে? (তবে তাকে নিয়ে একবার প্রিয় ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন লিখেছিলেন- টাই পরি/ দেশ গড়ি! আওয়ামী লীগের বর্তমান আমলে অবশ্য তাকে খুব বেশি টাই পরতে দেখা যায়নি। কারো কারো অবশ্য একটা পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা ছবির কথা মনে পড়তে পারে। ওই ছবিতেও মারামারির ব্যাপারটা আছে এবং নায়ক মিঠুন চক্রবর্তীকে বলা হতো ফাটাকেস্টো! তার বিখ্যাত ডায়ালগ ছিল এমন- মারবো এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে! এতো কিছু শুরুতেই বলে নিচ্ছি একারণে যে আজকের লেখাটা কাদের এবং মারামারি বিষয়ক। তবে সেই মারাটা শুধু চড় মারাতেই সীমাবদ্ধ না, রীতিমতো খুন!)
আসলে সব কিছুতে মন খারাপ করতে নেই। যেমন অনেক বছর আগে একবার খবর বেরিয়েছিল এই শিরোনামে-‘রাজনীতিবিদ আবদুল্লাহ আল নোমান এখন থেকে দুই নম্বর!’ পুরো খবর পড়ে জানা গেল নোমান সাহেব আগে বিএনপির এক নম্বর যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন। তারেক রহমান আনুষ্ঠানিক ভাবে বিএনপিতে যোগদানের পর তিনি হয়ে গেলেন এক নম্বর যুগ্ম মহাসচিব আর নোমান সাহেব নেমে গেলেন দুই নম্বরে! ঠিক তেমনি কাদের নাম শুনে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিনগুলোতে যে কাদের  আলোচনায় চলে এসেছেন তিনি অন্য কাদের। এদেশের সন্ত্রাসীদের নামগুলো অন্যরকম হয়। আমরা প্রায় সবাই সেটা জানি। যেমন মুরগি মিলন (মুরগির ব্যবসা করতেন বলে এই নাম) কালা জাহাঙ্গীর ( গায়ের রং কালো বলে এমন নাম। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বোধ করি এই যে এই ক্রিম কালা জাহাঙ্গীরকে সাদা বা ধলা জাহাঙ্গীর বানাতে পারেনি) ডগ শিশির, চুই বাবু, জাপানি কিংবা প্যালেস্টাইন বাবু, গালকাটা কামাল অথবা ভেতো শাহীন! কাদের নামে এর আগে হয়তো অনেক সন্ত্রাসী ছিল কিন্তু দুই তিনজনের নাম এখনও অনেকে মনে করতে পারবেন। প্রথমজন কসাই কাদের ওরফে রাজাকার কাদের ওরফে কাদের মোল্লা (এই রাজাকারের ফাঁসি হয়েছে), একজনের নাম ছিল ল্যাংড়া কাদের। আরেকজন ছিল মাছের ব্যবসায়ী। মানুষ তাকে ডাকতো মাউচ্ছা কাদের বলে।

সে যাই হোক এবারে গত দশ পনের দিন ধরে আলোচিত কাদের সম্পর্কে আসা যাক। তিনি একটি খুন ও ফিল্মি ঘটনার জন্ম দিয়েছেন। তিনি ২০০৮ এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। গাইবান্ধা-১ আসনের এলাকার নাম আসলে সুন্দরগঞ্জ। তো আমাদের লেখার আলোচ্য কাদের সুন্দরগঞ্জের সবচেয়ে অসুন্দর ঘটনার জন্ম দিয়েছেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারির মহা নির্বাচনে(!) মনজুরুল ইসলাম লিটনের কাছে কাদের সাহেব হেরে গিয়েছিলেন। এই হেরে যাওয়াটা নাকি তিনি স্বভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারেননি। লিটনকে খুন করার পরিকল্পনা করে বসেন কাদের খান! (চিত্রনায়ক সোহেল রানা মনে করতে পারেন কিনা জানি না। তিনি নিজের নামে একটা ছবি করেছিলেন। সেই সোহেল রানা ছবির ভিলেনের নাম ছিল কাদের খান) আমাদের আলোচ্য কাদের সাহেবের আসল নাম কাদের খান। এমবিবিএস পাস করার পর তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং শেষমেষ কর্নেল পদে উন্নীত হতে পেরেছিলেন। কর্নেল (অব.) ডা. কাদের খান এরপর জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে যোগ দেন এবং জাতীয় পার্টির রংপুর জোয়ারের কারণে তিনি এমপি নির্বাচিত হন।

এমপি গিরির একেবারে শেষ পর্যায়ে এক কোটি টাকা বাজেটের একটি কাজ করে যেতে পারেননি। পরের বার নির্বাচনে হেরে এই টাকার অংশবিশেষ তোলার জন্য দরখাস্তও দিয়েছিলেন। এমপি লিটন সেটা মেনে নেননি এবং কাদের খান কোনও টাকা তুলতে পারেননি। এছাড়া লিটনের সাথে কাদেরের কোনও বিরোধ ছিল না। তিনি ছিলেন সকল ধরনের সন্দেহের বাইরে ডুব দিয়ে ছিলেন।

সুন্দরগঞ্জের সব কিছু হয়তো সুন্দর  না। এই এলাকায় যেমন কাদের খান আছেন তেমনি আছেন আবদুল আজিজ ওরফে ঘোড়ামারা আজিজ। ঘোড়ামারা আজিজ সুন্দরগঞ্জের সুন্দর(!) একজন রাজাকার ছিলেন। কথিত আছে একাত্তর সালের কোনও এক জোৎস্নার রাতে তার পালা ঘোড়া রাজাকার ক্যাম্পের পাশের জঙ্গলে ঘাস অথবা গাছ খাচ্ছিল। গাছের নড়াচড়া দেখে ভয় পেয়ে গেছিল রাজাকাররা। তাদের ভয়মুক্ত করতে ব্রাশ ফায়ার করেন আজিজ। গাছের নড়াচড়া থেমে যায়। পরে রাজাকাররা গাছের আড়ালে যেয়ে দেখতে পায় আজিজ রাজাকারের পোষা ঘোড়াটা মরে পড়ে আছে। সেই থেকে উনি হয়ে যান ঘোড়ামারা আজিজ। এই আজিজও সুন্দরগঞ্জের এমপি ছিলেন। যুদ্ধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে ঘোড়ামারা আজিজ পলাতক রয়েছেন।

যাই হোক আবারও কাদের খানের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে প্রায় বছর খানেক সময় ধরে তিনি এমপি লিটনকে হত্যার পরিকল্পনা করছিলেন। লিটনের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে তিনি এই কাজ করতে প্ররোচনা দিয়েছিলেন। যে তিনজন লিটন হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় তাদের তিনি সাত লাখ টাকা দিয়েছিন। কথা দিয়েছিলেন উপ-নির্বাচনে তিনি যদি আবারও এমপি হতে পারেন তাহলে খুনি ওই তিনজনকে তিনি একটা পেট্রোল পাম্প অর্থাৎ ফিলিং স্টেশন করে দেবেন। আগেই বলেছি লিটন হত্যায় কাদের খানকে কেউ সন্দেহ করেনি। কিন্তু তার সম্পৃক্ততার ঘটনা যেভাবে ধরা পড়েছিল সেটাও অভিনব। বলা যেতে পারে ফিল্মি।

তিনজনের একটি দল মোটর সাইকেল নিয়ে পিস্তল হাতে ছিনতাই করতে নেমেছিল। যার মোবাইলটা তারা নিয়ে গিয়েছিল সেটা ছিল একটা সূত্র। মোটর সাইকেলে করে চলে যাওয়ার সময় তারা পিস্তলের ম্যাগাজিনটা ভুলে ফেলে গিয়েছিল! যার মোবাইল ছিনতাই হয়েছে সে ম্যাগাজিনটা জমা দিয়েছিল পুলিশের কাছে। পুলিশ দেখল ম্যাগাজিনটা খানিক পুরনো এবং সেটা সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু পিস্তলের। বুলেটগুলো ঢাকার সমরাস্ত্র কারখানায় তৈরি যা একজন সামরিক বাহিনীর লোকের পক্ষেই কেবল সহজে সংগ্রহ করা সম্ভব! এরপর যার মোবাইল ছিনতাই হয়েছে তার কাছে থেকে মোবাইলের আইএমই  নম্বর নিয়ে পুলিশ সেই মোবাইলেরও সন্ধান পেয়ে যায়। মোবাইলের সূত্র ধরে গ্রেফতার হয় ছিনতাইকারী কাম খুনি সেই তিনজন। তাদের কল লিস্ট পরীক্ষা করার পর সবার সন্দেহের বাইরে একরকম ডুব দিয়ে থাকা (ডুব শব্দটা খুব সেনসেটিভ ইদানিং! এই ডুবের কারণেই এমপি লিটন হত্যাকারীরাও ডুব বিষয়ক শিরোনাম হয়েছে যা পরে বলছি) কাদের খান প্রথমে নজরবন্দী ও পরে গ্রেফতার হন। সেই তিন ছিনতাইকারি যারা পরে খুনে অংশ নিয়েছিল তারা এবং কাদের খান নিজেও আদালতে জবানবন্দী দিয়ে এমপি লিটন হত্যার সাথে সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করেন! কাদের খান স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেওয়ার পর ফেসবুকে একজন মন্তব্য করেন -সম্ভবত লিটনের ফ্লাটে যেতে চেয়েছিলেন কাদের খান!

এই লিটনের ফ্লাট জিনিসটা পরিচিতি পেয়েছে ব্যাচেলর ছবি থেকে। বন্ধুর ফাঁকা বাসায় বান্ধবীর সাথে ক্লোজডোর ডেটিং করাটাই লিটনের ফ্লাটের আসল মাজেজা। সম্ভবত ‘ডুব’ বিতর্ক থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই ফেসবুকে কেউ এমন মন্তব্য করেছেন! সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল লিটন হত্যাকাণ্ড জামাত শিবিরের কাজ। পুলিশ জঙ্গি সম্পৃক্ততাও খতিয়ে দেখছিল। এমন কী স্থানীয় আওয়ামী লীগ কিংবা এমপি লিটনের পরিবারের সদস্যদের কাউকে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল পুলিশ। এই সব কিছুর বাইরে একরকম ডুব দিয়ে ছিলেন কাদের খান। সব রহস্য উদঘাটনের পর কাদের খানকে এখন বাধ্য হয়েই জেলের ভেতরে ডুব দিয়ে থাকতে হবে!

বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই লেখার সাথে ‘ডুব’ ছবির কোনও সম্পর্ক নেই। তবে পুরনো একটা রাশান কৌতুক দিয়ে লেখাটা শেষ করা যেতে পারে। মেজর সাহেব সকালে ক্লাস নিতে এসে দেখলেন- ক্লাশের এক কোনে সিগারেটের শেষ অংশ জ্বলছে। তিনি  রেগে গেলেন। জানতে চাইলেন কে খেয়েছে সিগারেট? কার এতো বড় সাহস? ক্লাসে উপস্থিত সৈন্যরা কেউ কোনও কথা বললো না। পেছন থেকে এক সৈন্য মিনমিনে গলায় বললো- স্যার দাবিদার কেউ নাই। আপনি চাইলে শেষ সুখটানটা দিতে পারেন! মেজর সাহেব আরো রেগে গেলেন। ক্লাস না নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থাকে জানালেন। সন্ধ্যা নাগাদ গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন জানালো ক্লাসের সব সৈন্যকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। এর ভেতর এগার জন স্বীকার করেছে তারা প্রত্যেকে ওই সিগারেটটা খেয়েছিল!!

লিটন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এপর্যন্ত নাকি ১৫৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ভাগ্যিস তারা কেউ দায় স্বীকার করেনি! তাদের পরিণতি কী হবে অথবা তাদের এই হেনস্তার(?) দায় কে নেবে?

লেখক: রম্যলেখক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ক্যানসারে আক্রান্ত অভিনেতা রুমি, ভর্তি হাসপাতালে
ক্যানসারে আক্রান্ত অভিনেতা রুমি, ভর্তি হাসপাতালে
বুয়েটে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন শিক্ষার্থীদের
বুয়েটে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন শিক্ষার্থীদের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ