X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

পথে পথে খুন

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০১ মার্চ ২০১৭, ১২:৩৩আপডেট : ০১ মার্চ ২০১৭, ১৯:৫২

 

 সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা কে বলে ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হয় না? বাংলাদেশে চোখের সামনে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখছি। পরিবহন খাতের পেশিশক্তিসম্পন্ন মালিক-শ্রমিকরা আবার তাদের ক্ষমতা দেখাতে উদ্ধত। সমালোচনা বা বিরোধিতা নিয়ে তারা মোটেই চিন্তিত নন। তারা দাপট দেখিয়ে চলেছেন। এরশাদ জামানায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করে রাজপথে যেমন ইচ্ছা তেমন করার অধিকার আদায়ের পর এবার তারা লেগেছে আদালতের পেছনে। তারা রাস্তাঘাটে মানুষ খুন করবেন, কিন্তু তাদের জামাই আদরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে, এমন এক দাবিতে দেশের মানুষকে জিম্মি করেছেন এ খাত-সংশ্লিষ্টরা।
তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরকে বহনকারী মাইক্রোবাসকে চাপা দেওয়া বাসচালক জামির হোসেনের যাবজ্জীবন সাজার বিরুদ্ধে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলায়। সেই ধর্মঘটে কিছুটা শিথিলতা আসতে না আসতে মঙ্গলবার থেকে হঠাৎ করেই কর্মবিরতি শুরু করেছে পরিবহন শ্রমিকেরা। সাভারে ২০০৩ সালের ট্রাক চাপা দিয়ে খোদেজা বেগম নামের এক নারীকে হত্যা মামলায় চালকের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হওয়ায় এর প্রতিবাদে সারাদেশে পরিবহন শ্রমিকদের এই কর্মবিরতি। হত্যাকারী ট্রাক চালক মীর হোসেন এবং নিহত খাদেজা ছিলেন সাভারের ঝাউচর এলাকার বাসিন্দা। হত্যার দিন গ্রামের রাস্তা দিয়ে ট্রাক নিয়ে যাচ্ছিল মীর হোসেন। আর এতে বাধা দিয়েছিলেন খোদেজা এবং তার স্বামী। মীর হোসেন ইচ্ছা করে তাদের ট্রাক চাপা দেয়। এতে মারা যায় খোদেজা। খোদেজার স্বামী নূরু গাজী বাদী হয়ে মামলা করেন। আর রায়ের প্রতিবাদে সরাসরি এই খুনির পক্ষে সারাদেশে কর্মবিরতির ডাক দিলেন পরিবহন শ্রমিকরা।
দুটো ঘটনায় প্রমাণিত হলো, পরিবহন শ্রমিকরা খুনের অবাধ অধিকার চান। তাই তারা আদালতের রায়ের প্রতিবাদ করে বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে পাকাপোক্ত করতে চান এই খাতে। জনগণ অপেক্ষায় আছে আদালত কী করেন আদালত অবমাননার এমন ধৃষ্টতায়।
দুর্ঘটনায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। সড়ক যোগাযোগ থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই যে নৈরাজ্য চলছে, তাতে দুর্ঘটনাই হয়ে গেছে নিয়মিত বিষয়। স্বীকার উপায় নেই যে, সড়ক দুর্ঘটনা এবং তাতে হতাহতের বাস্তবতাই এখন স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হলো নিরাপদ ভ্রমণ। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুহীন একটি দিনও নেই এখন।
মহাসড়ক থেকে শুরু করে নগরের সড়কগুলো, বিশেষত ঢাকা মহানগরের সড়কের দিকে তাকালে মনে হয় না যে এখানে কোনও পরিকল্পনা কাজ করছে। সড়কের তুলনায় অতিরিক্ত যানবাহন, অনুপযোগী পথঘাট, আর দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা মিলিয়ে এক দুর্বিষহ অবস্থা। সরকারি হিসেবে বছরে প্রায় তিন হাজার লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তবে সব মৃত্যুর কারণ হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনা নিবন্ধিত না হওয়ায় প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। যানবাহনের তুলনায় বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার পৃথিবীর মধ্যে প্রায় শীর্ষে- প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে ৮৫টি মৃত্যু। পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় এ হার প্রায় ৫০ গুণ বেশি। ১০-১৪ বছর বয়সীদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ সড়ক দুর্ঘটনা। একদিকে গণদুর্ভোগ, অন্যদিকে গণমৃত্যু দিয়ে দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো পরিণত হয়েছে গণবিধ্বংসী অস্ত্রে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে জিডিপির অন্তত ২ শতাংশ হারিয়ে যায়।
ত্রুটিপূর্ণ সড়ক, যানবাহন, অদক্ষ চালকসহ অনেক কারণ আমরা জানি। কিছু হয়তো ব্যবস্থার কথাও সরকার ভাবছে। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের খুনি মানসিকতার প্রতিকার কী? আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে এদের অবস্থান প্রমাণ করে এরা বেপরোয়া, শুধু গাড়ি চালানোয় নয়, সর্বক্ষেত্রে। এ দেশের সবচেয়ে উচ্ছৃঙ্খল খাত পরিবহন খাত। কিছুই বলা যায় না এদের। এরা মানুষ মারবে, পুলিশ ধরলে ধর্মঘট ডাকবে। এরা বিচারের ঊর্ধ্বে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকুক, এ খাতের শ্রমিক ইউনিয়ন বা মালিক সমিতির কর্তারা থাকেন ক্ষমতার কেন্দ্রে। ক্ষমতায় এরা এমন অবস্থানে, যেকোনও দুর্ঘটনার এসব হত্যাকাণ্ডে শেষ পর্যন্ত ভিকটিমরাই আবারও ভিকটিম পরিণত হন। মানুষ নিরাপদ চলাচলের জন্য সড়কে নামে, কিন্তু তারা জানে না পথে পথে অপেক্ষা করছে খুনির দল।
সড়ক দুর্ঘটনার অধিকাংশের কোনও বিচার হয় না। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দরিদ্র মানুষই বেশি দুর্ঘটনার শিকার হন। যারা পরিবহন মালিক তাদের আর্থিক শক্তি আছে। যারা শ্রমিক, তাদের পেশিশক্তি প্রশ্নাতীত। আর দরিদ্র মানুষের মৃত্যু নিয়ে ভাববার সময় কোথায় আমাদের নীতি নির্ধারকদের? ফলে নৈরাজ্যই নিয়তি এই খাতে। প্রায় সব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের বেপরোয়া আচরণ। এই যে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নির্দিষ্ট গতিসীমা না মেনে গাড়ি চালানো, তার কারণ হলো, এই চালক মহাশয় জানে তার কিছুই হবে না। কারণ তাদের নেতারা সরকারে থাকে, বিরোধী দলেও থাকে। পরিবহনের মালিকানায় আছে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনও।
এত-এত গাড়ি বাণিজ্য হয়, কিন্তু ড্রাইভার প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের বড় অভাব। সরকারিভাবে অপ্রতুল। আর মানুষের রক্তচোষা লাভের টাকা ঘরে নিয়ে সম্পদের পাহার বানালেও, পরিবহন মালিকরা প্রশিক্ষিত দক্ষ চালক ও সহকারী তৈরির কোনও উদ্যোগ আজ পর্যন্ত নেয়নি। যোগাযোগব্যবস্থা মোটেও গণকেন্দ্রিক নয়। পুরো ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি। বাণিজ্যিক স্বার্থের কাছে জনগণের স্বার্থ পরাজিত।
তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরকে খুন করা সেই বাসচালক দোষী সাব্যস্ত হয়েই সাজা পেয়েছে। তারেক-মিশুককে বহনকারী মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দেওয়ার সময় সে ঘুমের ঝোঁকে ছিল, এমনকি তার বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্সও ছিল না। রাষ্ট্রের সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দেশের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ধর্মঘট করার স্পর্ধা তারা পেল কিভাবে?
মানুষের কথা বিবেচনা করে রাষ্ট্রের এখন কঠিন হওয়ার সময়। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠোর আইন প্রয়োজন। রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ধর্মঘটের মতো ভয়ঙ্কর আচরণের কারণে দায়ী পরিবহন শ্রমিক সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তাদের নিবন্ধন বাতিল করা না হলে যখন-তখন যাত্রীদের জিম্মি করে অবৈধ সুবিধা আদায়ের সংস্কৃতি চলতেই থাকবে। কোনও ধরনের অন্যায় চাপের কাছে মাথানত না করে আদালতের দেওয়া রায় দ্রুত কার্যকর করার উদ্যোগ নিতেই হবে।
দেশ নাকি উন্নয়নের পথে হাঁটছে? এই সেই উন্নয়ন যেখানে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দোষীরা এভাবে প্রতিবাদি হতে পারে, জনগণকে জিম্মি করতে পারে? শক্তহাতে তাদের এখনই দমন না করা গেলে সড়ক পথে এরা গণহত্যা চালিয়েই যাবে।

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি   

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
রবিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
রবিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
চুয়াডাঙ্গায় ৪২ পেরোলো তাপমাত্রা, জনজীবনে হাঁসফাঁস
চুয়াডাঙ্গায় ৪২ পেরোলো তাপমাত্রা, জনজীবনে হাঁসফাঁস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ