X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি কি ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’?

চিররঞ্জন সরকার
০৩ মার্চ ২০১৭, ১২:০৬আপডেট : ০৩ মার্চ ২০১৭, ১২:১৪

চিররঞ্জন সরকার অতীতের ‘পাপ’ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিকে সারাক্ষণ যেন তাড়া করে ফিরছে।  দলটি কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না।  সম্প্রতি কানাডার ফেডারেল আদালত দলটিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে অভিহিত করেছে।  বিএনপির সদস্য হওয়ার কারণে একজন বাংলাদেশি নাগরিকের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন নাকচ করে দেওয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা জুডিশিয়াল রিভিউয়ের আবেদন নিষ্পত্তি করতে গিয়ে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার সিদ্ধান্তকে বহাল রেখে কানাডার ফেডারেল আদালতের বিচারক এই মন্তব্য করেন।
প্রসঙ্গত মোহাম্মাদ জুয়েল হোসেন গাজী নামে ঢাকার মিরপুরের এক ব্যক্তি বিএনপির সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মীর পরিচয় দিয়ে ক্যানাডা সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন।  তার স্থায়ীভাবে কানাডায় বসবাসের আবেদন ২০১৫ সালে প্রাথমিক অনুমোদন পেলেও গত বছরের ১৬ মে তাকে ‘কানাডায় প্রবেশের অযোগ্য ঘোষণা’ করেন দেশটির অভিবাসন কর্মকর্তা।  ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কানাডার ফেডারেল আদালতে বিচারিক পর্যালোচনার আবেদন গত ২৫ জানুয়ারি খারিজ করে রায় দেন বিচারক হেনরি এস ব্রাউন।  অভিবাসন কর্মকর্তা তার সিদ্ধান্তে বলেছিলেন, আবেদনকারী জুয়েল হোসেন গাজী এমন একটি সংগঠনের সদস্য, যে দল ‘সন্ত্রাসে যুক্ত বলে মনে করার যৌক্তিক কারণ আছে’।  সুতরাং কানাডার ইমিগ্রেশন অ্যান্ড রিফিউজি প্রোটেকশন অ্যাক্ট (আইআরপিএ)-র ৩৪(১)-এর এফ ও সি ধারা অনুযায়ী তিনি সুরক্ষা পাওয়ার জন্য ক্যানাডায় বসবাসের স্থায়ী অনুমতি পাওয়ার যোগ্য নন।
কানাডার আইনের ওই ধারায় বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি যদি এমন কোনও দলের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, যে সংগঠন সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত ছিল, আছে বা ভবিষ্যতে থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ আছে, তাহলে তিনি নিরাপত্তাজনিত কারণে ক্যানাডায় প্রবেশের অনুমতি পাবেন না।  সিদ্ধান্ত পর্যালোচনার আবেদনে জুয়েল গাজী দাবি করেছিলেন, বিএনপি সন্ত্রাসকে ‘প্রশ্রয় দেয় না’ এবং দলের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করায় কর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ারও নজির রয়েছে।  কিন্তু অভিবাসন কর্মকর্তার তুলে ধরা লাগাতার হরতাল ও সহিংসতার বিবরণ তুলে ধরে রায়ে বলা হয়েছে, তার সঙ্গে তুলনা করলে আবেদনকারীর যুক্তি ‘হারিয়ে যায়’।
আদালত সরকার পক্ষের আইনজীবীর বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, সরকার পক্ষ সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য দিয়েছেন যে, বিএনপি নেতৃত্ব একবারই সন্ত্রাসের নিন্দা করেছেন যখন বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানোর দায়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।  বিএনপি তার কর্মীদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের নিন্দা করেছে তার কোনও প্রমাণ এই আদালতের সামনে নেই।
কানাডার আদালত যে রায় দিয়েছে তা যথারীতি ‘সরকারের সাজানো নাটকের অংশ’ বলে দাবি করে বিএনপি বলছে, নির্বাচনের আগে জনগণের মুখে ধোঁয়াশা সৃষ্টির জন্য সরকার এ ধরনের পরিকল্পিত ঘটনা তৈরি করছে।  বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ বলেন, এটি সম্পূর্ণ বানোয়াট, সাজানো।  ক্ষমতাসীনদের দ্বারা পরিচালিত মিডিয়াগুলোতে এটি প্রচারের ধুম পড়ে গেছে।

প্রশ্ন হলো, রায়টি কি আসলেই বানানো, সরকারি দলের লোকজনদের দ্বারা প্রভাবিত? এই রায়ের পুরো বিবরণ কিন্তু কানাডার ফেডারেল কোর্টের ওয়েবসাইটে আছে।  আর কানাডার আদালত কি এ দেশের ‘গ্রাম্য সালিশ’ যে, ইচ্ছে করলেই রায় প্রভাবিত করা যায়? বিএনপির গত কয়েক বছরের কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরে যারা সন্ত্রাস সংঘটনে ইন্ধন দিয়েছে, সক্রিয়ভাবে নাশকতায় জড়িত থেকেছে এবং সহিংসতাকে রাজনীতির অন্যতম অনুষঙ্গে পরিণত করেছে তারা ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে কানাডার আদালতের তকমাকে খণ্ডাবে কিভাবে?

সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনও ভয়ে গা শিউরে ওঠে।  শেখ হাসিনার সরকারকে হঠানোর জন্য ৯২ দিন ধরে বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান এবং ৮৯ দিন ধরে চলা নেতিবাচক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট।  এ কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা পেট্রোলবোমাসহ বিভিন্নভাবে নাশকতা চালিয়ে প্রায় দেড়’শ মানুষ হত্যা করেছে।  শুধু পেট্রোলবোমার আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছে ৭০ জন। পেট্রোলবোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রায় এক হাজার নিরীহ মানুষ সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন।  এ কর্মসূচি চলাকালে সহস্রাধিক যানবাহন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।  ভাংচুর করা হয় কয়েক হাজার যানবাহন। আন্দোলনের নামে চলন্ত যানবাহনে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ, রেলে আগুন দেওয়া, রেললাইন উপড়ে ফেলা- যেসব নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড তারা চালিয়েছেন তাতে সাধারণ মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।  এ সব কারণে সাধারণ মানুষ বিএনপি-জামায়াতের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছে।

আওয়ামী লীগ একটি ‘ভোটারবিহীন নির্বাচন’ করেও বৈধতা পেয়েছে বিএনপি-জামায়াতের এই নজিরবিহীন সন্ত্রাসের কারণে।  এসব সন্ত্রাসের কাহিনি সব আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেই ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে।  কাজেই কানাডার ফেডারেল আদালতে উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্তকে ‘মিথ্যে’ বলার কোনও সুযোগ নেই।

বিদেশি একটি আদালত যখন সরাসরি বিএনপিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে, তখনও দলের নেতারা আত্মবিশ্লেষণ বা না করে মিথ্যে সাফাই গাইছেন।  তারা বিদেশি আদালতকেই ভুয়া বানানোর চেষ্টা করছেন।  কিন্তু ‘মিথ্যে’ বললেই কি আর সব কিছু মিথ্যে হয়ে যায়?

বিএনপির আচরণে দলের নেতাকর্মীদের অনেকে হতাশা প্রকাশ করছেন।  বিব্রত হচ্ছেন।  অনুতপ্তও হচ্ছেন কেউ কেউ। কানাডার ফেডারেল আদালত বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করার পর জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সাহাবুদ্দিন লাল্টু ফেসবুক লিখেছেন, ‘আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা থাকার পরও একটি দল যে যারপর নাই দুর্ভোগের সীমাহীন শিকারে পরিণত হতে পারে, তার প্রমাণ বিএনপি নামের একটি দল। …স্বাধীনতাবিরোধী একটি দলের সাথে জোট বাঁধার কারণে দলটি আজ শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও সর্বশান্ত হওয়ার পথে। সন্ত্রাসী দল না হয়েও শুধুমাত্র অপপ্রচারের কাছে পরাস্ত হয়ে কানাডার মতো একটি দেশের ফেডারেল আদালতের চোখে সন্ত্রাসী দল হিসেবে পরিগণিত হওয়া কিছুতেই চাট্টিখানি কথা নয়।’

লাল্টুর মতে, ‘কোনও অপপ্রচারেই এমন বড় একটি অপবাদ বিএনপির মতো দলটিকে নিতে হতো না, যদি তারা স্বাধীনতাবিরোধী ওই দলটির সাথে কোনও প্রকারের রাজনৈতিক জোট না বাঁধতো।’

ছাত্রদলের সাবেক প্রধান বর্তমানে কানাডা প্রবাসী লাল্টু যে কথাগুলো বলেছেন, তা কি একেবারেই উড়িয়ে দেওয়ার মতো, গুরুত্বহীন? লাল্টুর এই বক্তব্যের সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন।  জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির গাঁটছড়া বাধা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে ঘিরে পরিচালিত সহিংস আন্দোলন বিএনপির রাজনীতিকে সীমাহীন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।  গত প্রায় এক দশক ধরে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে শুধু জোটবদ্ধ রাজনীতি করছে না, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা নিয়ে জামায়াত যে অপরাধ করেছে, তার দায়ও বিএনপি তাদের কাঁধে নিচ্ছে। অথচ একাত্তরের কোনও দায় বহনের যৌক্তিক কারণ বিএনপির নেই।  একাত্তরে বিএনপি নামক দলটির অস্তিত্বই ছিল না।  তাছাড়া বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই পরিচিত।  মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকারই জিয়াকে বীর উত্তম উপাধি দিয়েছে।  কাজেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে এখন বিএনপি যে রাজনীতি করছে সেটা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত ছিল না।  বিশেষ করে দীর্ঘ সময় পরে হলেও একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সংশ্লিষ্টদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর বিএনপি এই প্রক্রিয়াকে স্বাগত না জানিয়ে যেভাবে কৌশলের আশ্রয় নিয়ে প্রকারান্তরে বিরোধিতা করেছে, সেটা বিএনপির রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থানকে দেশের মানুষের সামনে দুর্বল করে তুলেছে।  মানুষ মনে করছে, বিএনপি নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে দাবি করলেও কার্যত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতের পক্ষ অবলম্বন করে রাজনৈতিক অসততার পরিচয়ই দিয়েছে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন সময়ে যে সহিংস কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল বিএনপি তারও বিরোধিতা করেনি। বরং জোট সঙ্গী হিসেবে জামাতের কর্মসুচির প্রতি বিএনপির এক ধরনের নৈতিক সমর্থন ছিল বলেই মানুষের কাছে মনে হয়েছে।  বিএনপি কখনোই নিজেদের জামায়াতের থেকে আলাদা করতে চায়নি।

শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর জামায়াত এখন অনেকটাই ‘বিধ্বস্ত’ একটা দলে পরিণত হয়েছে।  এই ‘ধসে যাওয়া’ জামায়াতের ওপর বিএনপির নির্ভরতা যে দলটিকে ক্রমেই দুর্বল করে ফেলছে এটা যদি এখনও উপলব্ধিতে না আনা হয় তাহলে বলতে হবে দলটির জন্য কোনও সুসংবাদ সহসাই অপেক্ষা করছে না!

লেখক: কলামিস্ট

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে বাস উঠে পড়লো রেললাইনে, ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের উদ্ধার
ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে বাস উঠে পড়লো রেললাইনে, ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের উদ্ধার
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
চুরি করা গরুসহ ট্রাক থামিয়ে পালিয়ে যায় চোরেরা, আগুন ধরিয়ে দিলো জনতা
চুরি করা গরুসহ ট্রাক থামিয়ে পালিয়ে যায় চোরেরা, আগুন ধরিয়ে দিলো জনতা
বাংলাদেশ সফরের জিম্বাবুয়ে দলে অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলের ছেলে
বাংলাদেশ সফরের জিম্বাবুয়ে দলে অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলের ছেলে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ