X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাস ধ্বংসে সরকারি-বেসরকারি প্রতিযোগিতা!

মোস্তফা হোসেইন
০৩ মার্চ ২০১৭, ১২:১৮আপডেট : ০৩ মার্চ ২০১৭, ১২:২৬

মোস্তফা হোসেইন দ্বিজবংশী দাস মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করে ইতিহাসে স্থান করে নিলেন, তার কন্যাতো তেমনি হওয়ার কথা। চন্দ্রাবতীর কথা বলছি।  বাংলা সাহিত্যে বাঙালি প্রথম মহিলা কবি হিসেবে যিনি স্বীকৃত। সেই চন্দ্রাবতী কিনা আমাদের এই দেশেরই মেয়ে। গর্ব বোধ করাইতো স্বাভাবিক।  আর সেই গর্বকে তুলে ধরার জন্য যে ময়মনসিংহ গীতিকা উপহার দিলেন ড. দীনেশচন্দ্র সেন।  তিনিওতো সহযোগিতা নিলেন এই বাংলারই পল্লীকবি খ্যাত জসীমউদ্দীনের।  স্বীকার করতেই হয়- এই চন্দ্রাবতী, এই দ্বিজবংশী দাস আমাদের সাহিত্য ইতিহাসকে বিশ্বসমাজে সমাদৃত করতে বড় অবদান রেখেছেন।
সেই মনসামঙ্গলের কবিকন্যা চন্দ্রাবতী, যিনি বাবার পথ ধরে আমাদের উপহার দিলেন মলুয়া, দস্যু কেনারামের পালা আর একটি সংস্করণ রামায়ণও।  সেই চন্দ্রাবতীর জন্মভিটে পাতুয়াইরের কাছের জেলাশহর কিশোরগঞ্জে গিয়ে চন্দ্রাবতীর স্মৃতি দর্শন ছাড়া ফিরি কিভাবে।  সাহিত্যপ্রেমী ছড়াকার বিজন বনিককে বলা মাত্রই রাজী হয়ে গেলেন আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য।  মোটর সাইকেলে করে মিনিট পনের লাগে যেতে। চিরায়ত বাংলার সৌন্দর্যকে গ্রাস করে শহুরে ইট-পাথরের আগ্রাসী চিত্রকে পেছনে ঠেলে যখন চন্দ্রাবতীর পাতুয়াইর ( উইকিপিডিয়ায় পাটোয়ারী উল্লেখ করা হয়েছে) পৌঁছাই, উল্লসিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষার চুরমার হয়ে যায়।
দুর্বিসহ চিত্র পাতুয়াইরের।  কথিত উন্নয়নের যাঁতাকলে ইতিহাস বলি বলেই মনে হতে থাকে। সাহিত্যকে সমৃদ্ধকারী চন্দ্রাবতীর জন্মভিটের সে কী হাল! একদিকে দখলদারদের প্রতিযোগিতা অন্যদিকে ধ্বংসের প্রতিযোগিতা।  মূল বাড়ি দখল করে রেখেছে একটি মুসলিম পরিবার।  আরেক পাশে একটি হিন্দু পরিবার। দুই পরিবারই দখলের বৈধ দাবিদার।  জানা গেলো মামলা চলছে বেদখলের।  সুতরাং বৈধ দখল আর অবৈধ দখলের বিষয়টি আদালতের ঘরে রেখেই বলা যায়- এটা আমাদের ইতিহাসের ওপর নগ্ন আঘাত।  এ তো গেলো ব্যক্তি পর্যায়ে দখলের বিষয়। কিন্তু চন্দ্রাবতীর জন্মভিটে ও একইসঙ্গে কর্মভিটেও, সেখানে প্রবেশের মুখে হোচট খেতে হলো নতুন নতুন স্থাপনা দেখে।  প্রথমই দর্শনীয় স্থানে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছে একটা।  পথচারি সহজেই বুঝতে পারে এই স্থানের ঐতিহাসিক মর্যাদার বিষয়ে।  জানতে পারে এলাকাটা সংরক্ষিত। কতটা সংরক্ষিত? জবাব মেলে সাইনবোর্ড ঠেলে গড়ে ওঠা একটি ভবন দেখে।  মনে হয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে ভেংচি কাটছে ওই আধাপাকা ভবনটি।  রং চকচক করে পুরনোকে বদলে দিতে সচেষ্ট যেন।

এই ভবনটির সামনে দিয়ে চন্দ্রাবতী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আর চন্দ্রাবতীর বাড়ির মাঝখান দিয়ে রাস্তা তৈরি করছে সরকারের এলজিইডি বিভাগ।  মাটি সমান করে সেখানে সুরকি বিছানোর অপেক্ষায়।  রাস্তাটি এমনভাবে হচ্ছে যা দেখলে যে কেউ বলে দিতে পারে রাস্তাটি মানুষের ব্যবহারের জন্য নয়, এটা করা হচ্ছে চন্দ্রাবতী ও দ্বিজবংশী দাসের ইতিহাসকে গলাটিপে হত্যার উদ্দেশে। 

ইতিহাস ধ্বংসে সরকারি-বেসরকারি প্রতিযোগিতা! বাড়ির সম্মুখভাগে দুটি বড় বড় মঠ।  দুই মাঠের মাঝখান দিয়ে গেছে পাকারাস্তা।  পাকারাস্তার পাশে দোকান।  দর্শনার্থীদের জন্য তৈরি বসার জায়গা করেছে বোধ করি সরকারি কোনও প্রতিষ্ঠান । স্পষ্ট লক্ষণ আছে সেগুলোও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ঠ।  পুকুরপাড়ে লাগুয়া মঠটি বিপদের মুখে। মূল বেদীতে শাবল পড়েছে এলজিইডি’র।  বিশাল এই স্থাপনাটির বেদী ঘেরাও ছিল একসময় নিরাপত্তা বেষ্টনিতে।  এমনটা বোঝা যায়- রাস্তায় ভেঙে যাওয়া অংশ দেখে। ওখানেও অস্পষ্ট একটি সাইনবোর্ড টানানো আছএলজিইডি নির্মাণাধীন রাস্তাটি চন্দ্রাবতীর বাড়িকে আঘাত করেছে সীমানা প্রাচীরের কাছে এসে।  বাড়ির সামনে পুকুরপাড়ের মঠের মূল বেদী ভেঙে রাস্তাটি কিছুদূর এসে সীমানা প্রাচীর ঘেষে বেরিয়ে গেছে।  এমনভাবে মাটি কাটা হয়েছে, যা সীমানা প্রাচীরকে ভেঙে দেওয়ার আশঙ্কার কথাই মনে করিয়ে দেয়।  এমনিতেও প্রায় দুই ফুট চওড়া সীমানা প্রাচীরের চুন সুরখি খসে পড়ছে প্রায় ৫শ বছরের অত্যাচারে। এবার যদি এই রাস্তাটি শেষ হয় তাহলে বাকিটুকু এমনিতেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।  
চন্দ্রাবতীর দোতলা বাড়ির সামনে উঠানে গিয়ে দেখা গেলো ভেতরে থাকা পরিবারটি যথেচ্ছ ব্যবহার করছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটি।  পেছনে বাড়িও উঠিয়েছে তারা দিব্যি।  তাদের ভাষ্য অনুযায়ী তারা বাড়িটি কিনেছেন চন্দ্রাবতীর পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে।  কিন্তু যখন বুলডেজার দিয়ে মঠের বেদী ভাঙা হয় কিংবা সীমানা প্রাচীর ভাঙার অবস্থা তৈরি করা হয় তখন তাদের জবাব কী হবে?
ওই মুহূর্তে মানে আসে আগের দিন কিশোরগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনের কথা।  বক্তাদের মুখ থেকে কত সুন্দর কথা শুনেছি। যাদের মধ্যে জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে স্থানীয় সাহেব মাতবররাও ছিলেন। এমন সুন্দর আয়োজনের শেষটা আমাকে তাই বিষাদগ্রস্তই করে দিয়েছে এই বাড়িতে এসে।  যাওয়া হয়নি সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি।  ভাবলাম- জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে দাবি উঠেছিল মসুয়ায় যেন আগামী বছর জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন হয়।  এই উপমহাদেশে ক্রিকেটের জন্মস্থলও যে মসুয়ায়।  কিন্তু চন্দ্রাবতীর ইতিহাস ধ্বংসের এই প্রতিযোগিতা দেখে সত্যজিৎ রায়ের জন্মভিটায় যেতে আর মন চাইল না।  যদি তেমনি অত্যাচারচিত্র চোখে পড়ে সেখানেও?

কাদের কাছে দাবি করতে হবে, চন্দ্রাবতীর স্মৃতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য? সাধারণত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো রক্ষার দায়িত্ব যে বিভাগের তারা একটি সাইনবোর্ড লাগিয়েই ক্ষান্ত দিয়েছে।  মনে হচ্ছে না সংশ্লিষ্ট বিভাগ তাদের এই মৃত্যুদশা প্রত্যক্ষ করেছে।  যদি করতো তাইলে সরকারি আরেকটি প্রতিষ্ঠান কোনোভাবেই এত বড় ক্ষতিটা করতে পারতো না।  দয়া করে স্থানীয় প্রশাসন, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ইতিহাস ধ্বংস বন্ধ করুন।  বড় জরুরি এই নিদর্শন ধ্বংস করে কিন্তু বড় কোনও লাভ অর্জন হবে না।  সেটুকু বিবেচনা নিশ্চয়ই আপনাদের আছে।

আমার মনে হচ্ছে- যারা ভাস্কর্য শিল্পগুলো গুড়িয়ে দেওয়ার দাবি করে, যারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তককে সাম্প্রদায়িক করে দেয় তাদের কালোহাত সেখানেও সম্প্রসারিত হয়েছে কিনা।  যে কারণেই হোক- ধ্বংসকারীরাতো প্রকাশ্যেই আছে।  তাদের শাস্তির দাবিও করব না।  তার পরিবর্তে সরকারকেই জানাতে হবে চন্দ্রাবতী কে ছিলেন, তার প্রতি নাগরিক সমাজেরও দায় কী। আর অবশ্যই সরকারি আচরণও হতে হবে গঠনমূলক- ধ্বংসাত্মক নয়।

 লেখক- সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শাকিবের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গা অন্যরকম: চঞ্চল
শাকিবের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গা অন্যরকম: চঞ্চল
বর্জনকারীদের ‘অনুসারীরাও’ ভোটে, সহিংসতার শঙ্কা দেখছে না ইসি
বর্জনকারীদের ‘অনুসারীরাও’ ভোটে, সহিংসতার শঙ্কা দেখছে না ইসি
মাদক বহনের সময় দুর্ঘটনা, এরপর থেকে নষ্ট হচ্ছে জাবির ৬০ লাখ টাকার অ্যাম্বুলেন্সটি
মাদক বহনের সময় দুর্ঘটনা, এরপর থেকে নষ্ট হচ্ছে জাবির ৬০ লাখ টাকার অ্যাম্বুলেন্সটি
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ