X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘করপোরেট’ ট্রাম্প বনাম করপোরেট মিডিয়া

ইকরাম কবীর
০৫ মার্চ ২০১৭, ১৪:৩৪আপডেট : ০৫ মার্চ ২০১৭, ১৫:১৬

ইকরাম কবীর বোঝাই যাচ্ছে সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের ওপর তিনি অনেক রেগে আছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর প্রথম দিনই ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, “সাংবাদিকরা পৃথিবীর সবচেয়ে ‘অসৎ মানুষদের’ শ্রেণিভুক্ত”। শুধু তিনিই নন, হোয়াইট হাউসের প্রথম প্রেস ব্রিফিংয়ে ঢালাওভাবে সাংবাদিকদের দোষ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেছেন সংবাদপত্রের সঙ্গে তার বৈরিতার সম্পর্ক। তিনি অভিযোগ করেছেন, তার শপথ নেওয়ার দিন ওয়াশিংটনে যোগ দেওয়া লোকসংখ্যা নিয়ে ভুল তথ্য দিয়েছে সব সংবাদমাধ্যম। শুধু শপথ নেওয়ার পর নয়, তিনি নির্বাচনের আগেও বলেছিলেন; সিএনএন’কে ‘ফেইক নিউজ’ বা ‘মিথ্যুক’ বলে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রায় গালিই দিয়েছিলেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর কথাও তিনি বলেছেন যে নিউ ইয়র্ক টাইমসেরও সিএনএন’এর মতো অবস্থা। তিনি বলেছেন, ‘এরা বেশিদিন ব্যবসা করতে পারবে না। দেখেছেন তারা কিভাবে হারছে?’
তবে এনওয়াইটি’র মার্ক থম্পসন বলছেন, ‘হারাতো দূরের কথা, নির্বাচনের পর থেকে আমাদের গ্রাহকের সংখ্যা এখন আকাশছোঁয়া হয়েছে।’
নির্বাচনের আগে ট্রাম্পকে ‘মিথ্যুক’ বলে সংবাদমাধ্যমে অনেক কথা হয়েছে। তারপরও ভোটাররা তাকেই বেছে নিয়েছেন। ৪৯ শতাংশ ভোটার বলেছিলেন- ট্রাম্প সত্য বলছেন অন্যদিকে ৩৯ শতাংশ বলেছিলেন- সাংবাদিকরা সত্য বলছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস্ অনেকবার তাকে ‘মিথ্যুক’ বলেছে যা ইন্টারনেটে সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। হাফিংটন পোস্ট’ও অনেকবার বলেছে।
যদিও ট্রাম্প মনে করেন গণমাধ্যম তার প্রতি ‘বেশি কঠোর’ হয়েছে, তারপরও সাংবাদিকরা ট্রাম্পের আফগানিস্তান নিয়ে ধোঁয়াশা মতবাদ নিয়ে কোনও প্রতিবেদন করেনি। ইরান, কিউবা এবং ভেনিজুয়েলা নিয়ে তার মতামতের প্রতিবাদ সাংবাদিকেরা করেননি। কেন? আমেরিকার এই সংবাদমাধ্যম কি এই মতামতগুলোকে সমর্থন করে? তিনি এই দেশগুলকে তাদের ‘শত্রু’ বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা আমেরিকার বিশেষ বাহিনীকে তিনি ‘নায়ক’ বলেছেন। তখন কিন্তু সংবাদমাধ্যম তাকে চ্যালেঞ্জ করেনি। কিছু প্রগতিশীল সংবাদ সংস্থা ছাড়া আর কেউ আমেরিকার কালো মানুষদের প্রতি ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন করেননি।
ট্রাম্প নিজের কথা বলেই থেমে থাকেননি। প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন, অ্যান্ড্রু জ্যাকসন এবং আব্রাহাম লিঙ্কনের কথাও তিনি বলেছেন। তারা সংবাদমাধ্যমকে কী মনে করতেন তারও উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন যে আমেরিকার এই বিখ্যাত প্রেসিডেন্টরাও সাংবাদিকদের ‘মিথ্যুক’ বলেছেন।
তিনি দাবি করেছেন থমাস জেফারসন জন নরভেল্ নামে এক সম্পাদককে লিখেছিলেন, ‘খবরের কাগজের কিছুই বিশ্বাস করা যায় না; এই বাহনে চড়লে সত্য দূষিত হয়ে যায়’।  জেফারসনের চিঠিতে আসলেই এ’কথা লেখা ছিল। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় সে আমলেও সাংবাদিকরা দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন। তারা নিজেদের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলেন। জন অ্যাডামস ও জেফারসন তারা গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে যুদ্ধ করেছিলেন এবং সাংবাদিকরাও সে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। আব্রাহাম লিঙ্কনের প্রসঙ্গে টেনে ট্রাম্প দাবি করেছেন যে লিঙ্কন, তার রাজনৈতিক জীবনে, তারই মতো এক জঙ্গি সংবাদমাধ্যমের মোকাবিলা করেছিলেন। তবে ট্রাম্প বলেছেন, লিঙ্কন সংবাদমাধ্যমকে তার পক্ষে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন।

একদিকে ট্রাম্প-মিডিয়া বৈরিতা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টাও। ট্রাম্প সমর্থকেরা এবং আমেরিকার করপোরেট মিডিয়া, দু’পক্ষ থেকেই সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সিবিএস টেলিভিশনকে দেওয়া ট্রাম্পের এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ ধরে বিভিন্ন বিশ্লেষকরা বলেছেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গগুলো এড়িয়ে গেছেন প্রশ্নকর্তা। ট্রাম্পের বিরুদ্ধের যৌন নিপীড়নের অভিযোগ কিংবা নারীর প্রতি অবমাননাকর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি তাকে। আমেরিকার সাংবাদিকরা ইতিমধ্যেই জনগণকে সাথে নিয়ে ‘আমরা শত্রু নই’ বলে একটি প্রচারণা শুরু করেছেন।

একটা যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব! ব্যাপারটা যাচ্ছে কোথায়। হোয়াইট হাউস এবং আমেরিকার গণমাধ্যমের মধ্যে একটা যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব। ব্যাপারটা আসলেই যাচ্ছে কোন দিকে? কার লাভ হচ্ছে? আমেরিকার জনগণের? ট্রাম্প কাকে হারাতে চাইছেন? মিডিয়াই বা কী চাইছে ট্রাম্পের কাছে? অনেকে বলছেন এটা ব্যবসায়ী ট্রাম্প এবং আমেরিকান মিডিয়ার মালিক-ব্যবসায়ীদের একটি সংঘাত হতে পারে। কোথাও না কোথাও তাদের মতের মিল হচ্ছে না যে ব্যাপারটি জন-মানুষের সামনে আসছে না; জনগণ শুধু যুদ্ধটাই দেখছে।

বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে আমেরিকায়, ‘করপোরেট মিডিয়া’ বলে একটি কথা চালু আছে। করপোরেট মিডিয়া করপোরেশনের সিইও দ্বারা পরিচালিত এবং তারা মিডিয়াতে কনটেন্ট কী হবে, কাদের কাছে বিক্রি হবে এবং কত অর্থ সেখান থেকে আসবে তা নির্ধারণ করেন। করপোরেট মিডিয়া এবং মূলধারার মিডিয়ার সঙ্গে সংঘাত অনেকদিনের। মার্কিন মিডিয়া মালিকদের একটি বিবরণ দেখলেই বোঝা যাবে তাদের সংবাদমাধ্যমের অবস্থাটি আসলে কোথায়।
কমকাস্ট, এনবিসি, উনিভার্সাল পিকচার্স ও ফোকাস ফিচার্স’এর মালিক জেনারেল ইলেকট্রিক; নিউজকর্পের মালিকানাধীন আছে ফক্স, ওয়াল স্ট্রিট জর্নাল এবং নিউ ইয়র্ক পোস্ট; এবিসি, ইএসপিএন, মিরাম্যাক্স ও মার্ভেল স্টুডিওজের মালিক ডিজনি; এমটিভি, নিক জেআর, বিইটি, সিএমটি ও প্যারামাউন্ট পিকচার্সের মালিক ভিরাকম; টাইম ওয়ার্নারের মালিকানাধীন আছে সিএনএন, এইচবিও, টাইম ম্যাগাজিন ও ওয়ার্নার ব্রাদার্স; এবং শেষে শো’টাইম, স্মিথসোনিয়ান চ্যানেল, এনএফএল ডট কম, জেওপার্ডি ও সিক্সটি মিনিট্’সের মালিক সিবিএস। এই ছয় করপোরেশন আমেরিকার নব্বই শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে।
এখন কার সঙ্গে যুদ্ধ করবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প? আমেরিকার মানুষ সবচেয়ে বেশি যে টিভি চ্যানেলটি দেখে তা হলো এনবিসি। এই এনবিসির মালিক হচ্ছে জেনারেল ইলেকট্রিক। জেনারেল ইলেকট্রিক হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যারা তাদের পারমাণবিক দিকটি কারো কাছে প্রকাশ করতে চায় না। পশ্চিমারা যতই তাদের সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীন বলুক না কেন, এমন একটি পারমানবিক অস্ত্র উৎপাদনকারী কোম্পানির টিভি চ্যানেল কতটা স্বাধীন হতে পারে তা আলোচনা সাপেক্ষ। অনেকে বলতে পারেন, হ্যাঁ তারা সরকারের হস্তক্ষেপ থেকে স্বাধীন। দেখা যায়, আমেরিকায় এবং সারা বিশ্বে সবচেয়ে পরিচিত সংবাদমাধ্যমগুলোর মালিক বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মানুষেরা।
নাকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের’ও এদের সঙ্গে যুদ্ধ করার কোনও কারণ আছে? প্রশ্ন করেছিলাম কয়েকজন আমেরিকা প্রবাসী বাঙালিদের। তাদের মতে ট্রাম্প আসলে সেই মাধ্যমগুলোকে ধুয়ে দিচ্ছেন যারা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কথা বলছে। তাদের মতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাকি একজন চরমপন্থী-নার্সিসিস্ট। তিনি চান তাকে নিয়ে ভালো-ভালো কথা বলতে হবে এবং তখনই তিনি ভাববেন যে সংবাদমাধ্যম সৎ।
নিউজউইক পত্রিকা বলছে, ট্রাম্প মিডিয়াকে নিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন এবং মিডিয়াও তাকে নিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এবং এই আচ্ছন্নতা কারও জন্যেই ভালো কিছু বয়ে আনবে না। এমনটি একবার হয়েছিল প্রেসিডেন্টে নিক্সনের সময় এর চেয়েও ঢের বেশি অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছিল এবং সংবাদমাধ্যম জয়ী হয়েছিল বলে নিউজউইক দাবি করেছে।
বর্তমানে দু’পক্ষই মনে করছে যে কেউ একজন যুদ্ধ থামাবে। কিন্তু দিনদিন আরো তিক্ততা বাড়ছে। মিডিয়া এমনও বলছে যে প্রেসিডেন্ট নিজেকে নিজের কাছ থেকে বাঁচাতে চাইছেন এবং সে কারণেই সংবাদমাধ্যমের ওপর প্রতিনিয়ত হামলা করে যাচ্ছেন। মিডিয়া বিশ্লেষকরা বলছেন গণমাধ্যমেরই লাভ হচ্ছে। আজ থেকে দশ বছর পর গণমাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিয়ে কি আলোচনা হতে পারে? তার জন্য খুব সুখকর হবে না।
আমরা ‘শ্রোতা, দর্শক ও পাঠক’ - যারা এই যুদ্ধ দেখছি তারা আশা করছি যুদ্ধটি যেন তাড়াতাড়ি শেষ হয়; কারণ আমাদের মনের মধ্যেও একধরনের অবিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে। রাষ্ট্রনায়ক এবং সংবাদমাধ্যম এ দু’য়ের প্রতিই। রাষ্ট্রনায়ক ট্রাম্প বৈরিতা আরো বাড়িয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র চালানোর পথে খুব স্বস্তি পাবেন না। ওদিকে সংবাদমাধ্যমেরও উচিৎ তাদের নিজেদের অবস্থানের দিকে তাকানো। যদি তাদের বিশ্বাসযোগ্যতায় জনমনে চিড় ধরে, তাহলে তা হবে সারা বিশ্বের জন্য আরো ক্ষতিকর।

লেখক: গল্পকার।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বদলাতে চান ম্রুনাল
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বদলাতে চান ম্রুনাল
পিএসজির অপেক্ষা বাড়িয়ে দিলো মোনাকো
পিএসজির অপেক্ষা বাড়িয়ে দিলো মোনাকো
অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে আটকা পড়েছে শতাধিক পাইলট তিমি
অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে আটকা পড়েছে শতাধিক পাইলট তিমি
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ