X
বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভাস্কর্য ভাঙতে হবে কেন

তসলিমা নাসরিন
০৫ মার্চ ২০১৭, ১৬:৩৫আপডেট : ০৫ মার্চ ২০১৭, ১৭:০৮

তসলিমা নাসরিন কোনও ভালো কাজে কোনওদিনও মৌলবাদীদের পথে নামতে দেখিনি। দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য, সবার জন্য শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের জন্য, নারী নির্যাতন বন্ধের জন্য, ধর্ষণ আর খুনোখুনি বন্ধের জন্য কখনও কি ওরা পথে নামে, আন্দোলন করে? না করে না। ওরা পথে নামে এটা ভেঙে দিতে, ওটা গুঁড়িয়ে দিতে। ওরা ধ্বংস করতে পথে নামে। একে ফাঁসি দিতে, ওকে নিষিদ্ধ করতে। এ-ই ওদের কাজ। বাংলাদেশের অনেক ভাস্কর্যই এ যাবৎ ওরা ভেঙেছে, আরও ভাঙার পরিকল্পনা করেছে। করেছে কারণ ওদের পরিকল্পনায় কেউ বাধা দেয় না। মানুষ ওদের ভয় পায়। ওরা ধর্মের নামে দেশজুড়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে।  
ওরা এখন পড়েছে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনের ন্যায়ের প্রতীকটি নিয়ে। এটি গ্রীক দেবীর মূর্তি, মূর্তি ইসলামে নিষিদ্ধ, এটি  মুসলমানের দেশে রাখা চলবে না। এই হলো ওদের দাবি। দাবি না মানলে নাকি দেশের সর্বনাশ করবে। সর্বনাশ করতে বাকি রেখেছে কী! ওই অন্যায়কারীদের সরকার সবসময় ক্ষমা করে দেয়। ধর্মের নামে যে অন্যায় তারা করে তার জন্য ওদের কখনও বিচার হয়েছে বলে শুনিনি। 
বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি হতদরিদ্র দেশ। এই দেশের অনেকেই কামলা খাটতে মধ্যপ্রাচ্যে যায়, আরব মুসলমানের কাছে  মিশকিন বলে গালি খায় আর খুন খারাবি করে শিরোচ্ছেদের শাস্তি পায়। অনেকেই স্বপ্ন দেখে গ্রীস, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ের মতো সভ্য দেশে গিয়ে বাস করার। যারা যায় তাদের বেশির ভাগই গলা কাটা পাসপোর্ট বানিয়ে সেসব দেশে ঢুকে গিয়ে সেসব দেশের সুবিধে নেওয়ার জন্য হেন মিথ্যেচার নেই যে করে না। সভ্যতা নেই, সংস্কৃতি নেই – এমন অনেক লোক চিৎকার করছে ন্যায়ের প্রতীকের বিরুদ্ধে, গ্রীক ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে। এই ন্যায়ের প্রতীক পৃথিবীর সব সভ্য দেশেই আদালতের ভেতরে বাইরে শোভা পায়। আদালতকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা দেয় এই প্রতীক।

বাংলাদেশের  কূপমণ্ডূকরা মনে করে তাদের দেশ আরব দেশগুলোর অংশ। তারা জানে না যে বাংলাদেশ এই পৃথিবীর অংশ। আরব দেশগুলো বরাবরই বর্বর ছিল। যতটুকু সভ্য হয়েছে, তা সভ্য দেশগুলো থেকে শিখেই হয়েছে। আমরা পরস্পরের কাছ থেকে শিখি। মানব সভ্যতার নিয়মই এই। গ্রীস এই পৃথিবীকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। যেমন গণতন্ত্র। আর এই গণতন্ত্রের কারণেই অনেকে  আজ ভাস্কর্য ভাঙার দাবি করতে পারছে। ওদের গায়ে কোনও টোকা পড়ছে না। যদি গ্রীসের গণতন্ত্রকে গ্রহণ না করতো বাংলাদেশ, যদি আরব দেশগুলো শিখিয়ে যেত আরবীয় বর্বরতা, তা হলে তেড়িবেড়ি করলে সরকারি জল্লাদ এসে এক কোপে ওদের কল্লাটা কেটে ফেলে দিত রাস্তায়। বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে বলেই ওদের অধিকার আছে মত প্রকাশ করার। গ্রীসের কাছে তো ওদের কৃতজ্ঞ থাকার কথা।

প্রাচীন গ্রীস গোটা পৃথিবীকে অনেক কিছু দিয়েছে। গণতন্ত্রের ধারণা তো দিয়েছেই।  প্রথম ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসকে দিয়েছে। হেরোডোটাস পৃথিবীর মানুষকে ইতিহাস লিখতে শিখিয়েছে। গ্রীস আমাদের প্রথম গণিতজ্ঞ দিয়েছে। থালিস, পিথাগোরাস। প্রথম দার্শনিক দিয়েছে। সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল। প্রথম চিকিৎসাবিদ হিপোক্রেটকে দিয়েছে।  জুরির শুনানি দিয়েছে। প্রথম থিয়েটার দিয়েছে। অলিম্পিক গেইম দিয়েছে। মেকানিক্যাল অডোমিটার দিয়েছে। স্থাপত্য দিয়েছে। গ্রীক পুরাণের গল্প দিয়েছে। আরও কত কিছু দিয়েছে।

মানবাধিকার, নারীর অধিকার, শিশুর অধিকার, শ্রমিকের অধিকার, কথা বলার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার – এসব অধিকার প্রতিষ্ঠা করার উৎসাহ আমরা কোনও ধর্ম থেকে পাইনি, পেয়েছি শিক্ষিত সচেতন মানুষের তৈরি সভ্যতা থেকে।   

ন্যায়ের ভাস্কর্য ভেঙে ইসলাম  ধর্মকে সম্মান জানাতে চায় মৌলবাদীরা। ওরা কি মনে করে ন্যায়ের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক থাকতে পারে না? ওরা বলছে ইসলাম মূর্তি মানে না। আসলে ইসলাম মূর্তি-পুজো মানে না, এক কালে কাবার ৩৬০টা ভগবানের মুর্তি ভেঙে ফেলে দিয়েছিলো ইসলামের নেতারা। কিন্তু থেমিস বা জাস্টিশিয়াকে তো কেউ পুজো  করছে না বাংলাদেশে! সুপ্রিম কোর্টের সামনে রাখা ভাস্কর্যটিকে প্রদক্ষিণ করতে কেউ বলেনি, একে  চুমু খেতেও কেউ বলেনি। এই ভাস্কর্য যেমন দাঁড়িয়ে আছে, তেমন দাঁড়িয়ে থাকবে। হাতে ধরে থাকবে দাঁড়িপাল্লা, চোখে বাঁধা থাকবে কাপড়। স্বজনপ্রীতি না করার জন্য, সবাইকে সমান ভাবে দেখার জন্য এর চেয়ে চমৎকার প্রতীক আর কী হতে পারে!  এই প্রতীকটি সর্বোচ্চ আদালতের উচ্চতা, সত্যি বলতে কী, আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।   

গ্রীসের পুরাণ থেকে আমরা শিখেছি অনেক। গ্রীসের চিকিৎসা-দেবতা এস্ক্লেপিওসের লাঠিতে  সাপ পেঁচিয়ে আছে- চিকিৎসাবিজ্ঞান বোঝাতে এই  প্রতীকই তো ব্যবহার করছে সারা বিশ্ব। উৎস যেহেতু গ্রীস, তাই  গ্রীসের পুরাণ আসে। চিকিৎসাবিদ্যা পড়তে গিয়ে আমি কিছু গ্রীক পুরাণ শিখেছিলাম।
ন্যায়ের এই ভাস্কর্য আমাদের, এই ভাস্কর্যকে শাড়ি পরিয়ে একে বাঙালি বানানো হয়েছে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী বলে এ কথা তো অস্বীকার করা যায় না বাংলাদেশ সত্তর বছর আগেও ছিল ভারতের ভেতর,  দিশি মুসলমানের পূর্বপুরুষ ছিল হিন্দু বা বৌদ্ধ। বাংলাদেশে ইসলামতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা পশ্চিমা দেশ থেকে আসা গণতন্ত্র, যা আমরা মানতে চাই তা পশ্চিমা দেশ থেকে আসা মানবাধিকার। মৌলবাদীরা অসুস্থ হলে কোরআন- পড়া পানি খেয়ে অসুখ সারাতে রাজি হবে না, ঝাড় ফুক দিয়েও নয়, তারা আধুনিক হাসপাতালে যাবে অসুখ সারাতে। আধুনিক হাসপাতালের আধুনিক চিকিৎসা পাশ্চাত্য থেকে আসা। সুতরাং পাশ্চাত্যকে হঠিয়ে দিলে আমদের কিচ্ছু থাকে না। ন্যায় বিচার বলেও কিছু থাকে না। সৌদি আরবে ইসলামি আইনে বিচার হয়। ইসলামি আইন এলে এই মৌলবাদীদের অনেকেই হয়তো শিরোচ্ছেদের শাস্তি পাবে। গণতন্ত্র বলেই যা ইচ্ছে তাই করে পার পেয়ে যাচ্ছে।

মুসলিম দেশ মিশরের যত প্রাক ইসলাম যুগের ভাস্কর্য, ইন্দোনেশিয়ার যত হিন্দু দেব দেবীর মূর্তি – সব যদি সরিয়ে দেওয়া হয় তবে ইতিহাস মুছে যায়। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করতে হলে ইতিহাস ভুলতে হবে, বা ইতিহাসকে অস্বীকার করতে হবে কেন? ইসলামে বিশ্বাস করলে গ্রীক দেবী থেমিসকে চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দিতে হবে কেন? এত কেন অসহিষ্ণুতা। মুসলমানদের এত অসহিষ্ণুতার কারণেই সারা বিশ্বে মুসলমান আজ একটি আতঙ্কের জাতিতে পরিণত হয়েছে। নিজেকে সহিষ্ণু করার সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। 

লেখক: কলামিস্ট

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাজীপুরে ব্যাটারি কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে চীনা প্রকৌশলীর মৃত্যু, অগ্নিদগ্ধ ৬
গাজীপুরে ব্যাটারি কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে চীনা প্রকৌশলীর মৃত্যু, অগ্নিদগ্ধ ৬
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ