X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

অর্ধেক আকাশ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০৮ মার্চ ২০১৭, ০১:৪১আপডেট : ০৮ মার্চ ২০১৭, ১৮:১৪



সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা If Men Could Menstruate—সত্তর দশকে মার্কিন লেখিকা গ্লোরিয়া স্টেইনেমের বিখ্যাত লেখা। যদি পুরুষেরও রজঃস্রাব হতো, তাহলে সে কী করতো? নিশ্চয়ই মাসের সে কয়টি দিন লজ্জা বা কুণ্ঠায় লুকিয়ে থাকতো না। উচ্চকণ্ঠে প্রকাশ করতো এর জয়গান। নারীর ক্ষমতায়নকে বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখেছেন গ্লোরিয়া।
নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা বলি অনেক, গলাও ফাটানো হয় রাষ্ট্রের নানা স্তরে। কিন্তু বিষয়টা আসলে কী? বলা যেতে পারে নারী-পুরুষের মধ্যে পূর্ণ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্য। প্রত্যেকের বেঁচে থাকার সমান অধিকার, জীবনের সমান মান। নারী-পুরুষ সবাইকে নিয়েই মানুষের সভ্যতা। কিন্তু লিঙ্গ-রাজনীতি তাকে খর্ব করে রেখেছে।
গত বছর বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন বিশ্ব ব্যাংক প্রধান জিম ইয়ং কিম। তার অনেক পর্যবেক্ষণের মধ্যে একটি ছিল বাংলাদেশের নারীদের নিয়ে। তার মতে, বাংলাদেশের দারিদ্র্য কমাতে বড় ভূমিকা রেখেছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক হারে নারীর অংশগ্রহণ।
কিছু একটা করতে হবে, কিছু হতে হবে, এই প্রেরণা পুরুষের পক্ষে বহুকালের। সভ্যতা অনাদি অতীত থেকে এই চেতনারই সঞ্চার করেছে, পুরুষকে হতে হবে সফল ও কর্মঠ। নারীকেও হতে হয় সফল ও কর্মঠ, কিন্তু তার ঠিকানা ছিল ঘরবন্দিপুর। তবে নারী তার ঠিকানা বদলাচ্ছে, ব্যাপক হারে বদলাচ্ছে। কিন্তু তার পরও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যের কারণে আমাদের দেশে সংগঠিত ক্ষেত্রে মেয়েদের ভূমিকা ছেলেদের পাশে নয়, অনেক পেছনে। সফল ও স্বাধীন নারীর নামের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আলোর নিচে অন্ধকারের মতোই নারীর প্রতি সূক্ষ্ম কিংবা প্রকট বৈষম্য আছে প্রায় সব ক্ষেত্রে। বলতে গেলে সাফল্য বা সন্মান পাওয়া নারীও কতটা আরেক নারীকে সন্মান দিচ্ছে তা নিয়েও বিতর্ক সম্ভব।
সমস্যাটি মনোজগতের। পরিবারে, রাষ্ট্রে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমনকী কর্মক্ষেত্রে সামন্ত সংস্কৃতির মাঝে বিচরণ করা পুরুষ, ক্ষেত্র বিশেষে নারীও চায় না যে, নারী শক্তিশালী হয়ে উন্নততর সমাজ গঠন করে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করুক, বৃহত্তর কর্মযজ্ঞে স্বমহিমায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করুক। নারীপ্রগতির ক্ষমতাবানদের আসর সরগরম করার একটা সামাজিক চতুরতা বা রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজি কিংবা বাণিজ্য জগতের মুনাফা লোটার প্রচেষ্টা অবশ্য কম নেই।
আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক দুই অর্থনৈতিক পরিসরেই নারীর উপস্থিতি ব্যাপক, তার উৎপাদশীলতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু তার অবস্থান কতটা পাকাপোক্ত? অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে নারীর অবস্থা শোচনীয়। বেতন-বৈষম্য, ন্যূনতম মজুরি না-দেওয়া, মজুরিতে তারতম্য ঘটানো, চাকরিক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা, শ্রম ও স্বাস্থ্য বিষয়ক বিধি কার্যকর না-করা, এমনকি সরকারি নীতি অগ্রাহ্য করা খুব স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু এই বাস্তবতা কি শুধুই অসংগঠিত ক্ষেত্রে নয়। করপোরেট বলে খ্যাত বহু প্রতিষ্ঠানে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া হয় না, দিলেও তা হয় বেতনহীন ছুটি।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীদের এগিয়ে নিতে, তাদের গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল পদে যোগ্য নারীদের বিবেচনা করছেন নানাভাবে। কিন্তু তার সরকারই যখন আবার বিশেষ বিধান রেখে অপ্রাপ্ত বয়সের মেয়েকে বিয়ে দিতে আইন করে তখন বুঝতে হয়, নারীর জীবন মান নিয়ে ধারণাগত অসঙ্গতি সমাজে কতটা শক্তিশালী। এ বিতর্ক থাক। বলতে দ্বিধা নেই, বঞ্চনা, বৈষম্য, আবহেলা, অশ্রদ্ধায় বহু নারী ব্যক্তিত্ব, কুশলতা ও সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ঘটাতে ব্যর্থ হয়ে পড়ছে তার পরিসংখ্যান জানা নেই এই সমাজের।
বিশ্ব ব্যাংক প্রধান, কিংবা আন্তর্জাতিক আরও ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের নারীদের প্রশংসা, ক্ষমতাসীনদের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কর্মক্ষেত্রে একজন মেয়েকে একটি ছেলের সঙ্গে অসম পাঞ্জা কষতে বাধ্য হতে হয়। সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ও পশ্চাদপদ অংশের আর্থিক বঞ্চনা অবসানের জন্য একান্ত আবশ্যক- নারী-পুরুষ সমানুপাতিক হারে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব যেন বিকাশমান বেসরকারি খাতও এর বাইরে ভাবতে না পারে।
আধুনিক ও প্রগতিশীল বিবর্তন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকেই সর্বোত্তম স্বাধীনতা বলে মনে করে। প্রকৃত শিক্ষা ও চেতনার বিকাশ শুধু স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠাই শেখায় না, পারস্পরিক সত্তাকে সম্মান জানায়। এমতাবস্থায় একজন স্বাধীনচিত্ত নারী সামাজিক শৃঙ্খলাগুলোর অর্থহীনতা বর্জন করতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সব উৎপাদনে বাংলাদেশের উন্নয়নের নারীরাই মূল চাবিকাঠি। গার্মেন্টস শিল্প, কৃষি ও গৃহস্থালি কাজে নারীদের অবদান ঐতিহাসিক। রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক বিভাজনের বাইরে গিয়ে নারী হিসেবে একটি বৃহৎ ঐক্য তৈরি করে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইনসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বিদ্যমান বৈষম্যগুলোর বিরুদ্ধে একটি গণআন্দোলন সৃষ্টি করতে হবে। নারী ব্যবসায়ী, নারী আইনজীবী, নারী পেশাজীবী-ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক, শ্রমিক ও অন্যান্য, নারী উন্নয়ন কর্মী সবারই নারীস্বার্থকে ভিত্তি করে একটি সমন্বিত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে হবে যাতে নারীর অবদানগুলো মূল্যায়িত হয় এবং নারীর মানবাধিকার ও ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সফল হতে পারে। অফিসের কাজের সঙ্গে পারিবারিক দায়দায়িত্ব সমান ভাবে পালন করতে হয় বলে অনুকূল অবস্থা সৃষ্টির জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ জরুরি। এসব হলো মাতৃত্বকালীন ছুটি মঞ্জুর করতে অযথা টালবাহানা বন্ধ করা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার পর্যাপ্ত আয়োজন রাখা, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের একই জায়গায় বদলির বন্দোবস্ত করা এবং বড় শহরে সুলভ ও কার্যকর পরিবহণ ব্যবস্থা চালু করা।
আর্থিক নিরাপত্তা দিয়ে গতিশীল করতে সুসভ্য পরিবেশ তৈরির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বিজ্ঞানভিত্তিক নারীকল্যাণমুখী সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ না-করলে চিরন্তন দুঃস্বপ্ন ভেঙে সমতাভিত্তিক সমাজ গড়া সহজ হবে না।
২০১৩ সালের ৮ মার্চ সে সময়ের মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির একটি বার্তা বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়েছিল। সেখান থেকে কিছুটা নিয়ে মেষ করব, এই লেখা। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের অঙ্গীকার করতে হবে, অসাম্য, বিশ্বের সমস্ত কোণে অগ্রগতিকে থমকে দিচ্ছে, তার অবসান আমরা করবই। এই শপথ আমাদের নিতেই হবে, যাতে আমাদের কন্যারা নির্ভয়ে বাসে করে স্কুলে যেতে পারে, আমাদের বোনেরা তাদের বিপুল সম্ভাবনা পূরণ করতে পারে এবং প্রতিটি নারী ও বালিকা তার মধ্যে নিহিত শক্তির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারে।’
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ