X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

লোক দেখানো অভিযান, মানুষের আরও দুর্ভোগ

গোলাম মোর্তোজা
০৮ মার্চ ২০১৭, ১৫:২০আপডেট : ০৮ মার্চ ২০১৭, ১৫:২৩

গোলাম মোর্তোজা প্রতিটি পদে পদে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জর্জরিত একটি প্রতিষ্ঠানের নাম বিআরটিএ। তাদের হিসাব অনুযায়ী ঢাকা শহরে বাস-মিনিবাসের সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। জাইকার হিসাব অনুযায়ী ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ২ কোটি ১৫ লাখ মানুষ বাসে যাতায়াত করেন। ৬ হাজার বাস-মিনিবাসে সোয়া দুই কোটি মানুষ যাতায়াত করেন? না, অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতো এক্ষেত্রেও আপনার হিসাব মিলবে না। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা কত, তার সঠিক সংখ্যা জানতে পারবেন না। ঢাকা শহরে কত বাস-মিনিবাস চলে তারও কোনও সঠিক সংখ্যা কেউ জানেন না। এটাই ঢাকা শহর। যে শহরের কোনও অভিভাবক নেই। একাধিক অভিভাবক নামে আছেন, যাদের কেউ ঢাকাকে সিঙ্গাপুর বানানো নিয়ে ব্যস্ত, কেউ স্বর্ণের খনির খনন করেন কিছুদিন পরপর। ৬ হাজার বাস-মিনিবাসের সংখ্যা বিআরটিএ বললেও, বাস্তবে সেই সংখ্যা হয়তো ২৫ বা ৩০ হাজার। যার কোনও বৈধ কাগজপত্র নেই। কিন্তু চলছে, এই রাজধানীতে চলছে। বৈধ অবৈধ গণপরিবহন নিয়ে মাঝেমধ্যে আলোচনা হয়। আলোচনা এখনও হচ্ছে। ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে ২০ বছরের পুরনো বাস-মিনিবাসের বিরুদ্ধে। এর আগে এমন ব্যবস্থা চার-পাঁচবার নেওয়া হয়েছে। কী ব্যবস্থা, কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে কী, পরবর্তীতে কী... এসব বিষয় নিয়ে কিছু কথা।
১. গণপরিবহন মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্যে, মানুষকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যে। ঢাকার গণপরিবহন মানুষকে পিছিয়ে দেওয়ার জন্যে, জীবনকে কঠিন করে দেওয়ার জন্যে। শাহাবাগ বা ফার্মগেটের দিকে একটু দৃষ্টি দেন। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত সবসময় কয়েক হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে থাকেন অপেক্ষায়, গণপরিবহনের অপেক্ষায়। এর মধ্যে নারী-শিশু সবাই আছেন। নেই শুধু গণপরিবহন। বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ২৫ বা ৩০ হাজার বাস-মিনিবাস, সোয়া দুই কোটি মানুষের সেবা নিশ্চিত করতে পারে না। পারছে না। বাংলাদেশের এত টাকা, ৩০০ কোটি টাকার কাজ ১৫০০ কোটি টাকায় করে। মানুষের জন্যে গণপরিবহন নিশ্চিত করতে পারে না।
২. পুরনো অবৈধ বাস-মিনিবাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সময়ে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়ে, এখন বেড়েছে। কিছু বাস-মিনিবাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, কিছু বাস মালিকরা রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়েছে। অভিজ্ঞতা বলে অভিযান শেষ হলেই সেগুলো আবার ফিরে আসবে। হয়তো একটু রঙ করা হবে।

এমনিতেই মানুষ দুর্ভোগে থাকে। ব্যবস্থা নেওয়াকালীন সেই দুর্ভোগ আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।

৩. তাহলে কী অবৈধ বাস-মিনিবাস বা পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন নেই? নিশ্চয়ই প্রয়োজন আছে। এত পুরনো, বৈধ কাগজপত্র ছাড়া বাস রাস্তায় চলতে পারে না, চলতে দেওয়া উচিত নয়। প্রশ্ন ব্যবস্থার ধরন নিয়ে।

ক. ২০ বছরের পুরনো একটি বাস যিনি চালাচ্ছেন, তার বৈধ লাইসেন্স নেই। গাড়ির ফিটনেস নেই, নেই রেজিস্ট্রেশন।

খ. লাইসেন্সবিহীন চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, জেল-জরিমানা হচ্ছে। লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে, তা হতেই পারে। দিন আনি দিন খাই, একজন চালক তিন মাস ছয় মাস জেলে থাকবেন, জরিমানা দিতে না পারলে জেলজীবন আর কিছুদিন বাড়বে।

গ. এর মাধ্যমে যদি গণপরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরে আসে, প্রশংসা করতেই হবে এই উদ্যোগের। কিন্তু বাস্তবতা কী তা বলে?

যে বাসের চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তার একজন মালিক আছেন। চালক কিন্তু মালিক নন। তিনি খুব সাধারণ বা মানবেতর জীবনযাপন করা একজন দরিদ্র মানুষ।

ব্যবস্থা নেওয়ার পুরো প্রক্রিয়ায় মালিক থাকে অন্তরালে। রাস্তায় অবৈধ গাড়ি চালানোর দায় চালকের, ঠিক আছে। চালককে যিনি চালাতে দিয়েছেন, চালকের থেকে যিনি প্রতিদিন ভাড়া নিচ্ছেন, তার দায় নেই? দায় কার বেশি, দিনমজুর চালকের, না বিত্তবান প্রভাবশালী মালিকের?

নিঃসন্দেহে মালিকের দায়ই বেশি হওয়ার কথা। মালিক বাস না দিলে, চালক চালাতে পারতেন না। বাস্তবে ব্যবস্থা নেয়াওয়ালারা বিত্তবান মালিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেন। নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ দেওয়ার জন্যে তারা ব্যবস্থা নেন দরিদ্র চালক-শ্রমিকদের বিরুদ্ধে। মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না, শুধু তাই নয় সুরক্ষা দেন নানা কৌশলে।

৪. যে চালকের লাইসেন্স বৈধ নয়, তিনি কী করে অবৈধ লাইসেন্স পেলেন? অনেক চালকের গাড়ি চালানোর সক্ষমতা নেই, অথচ বৈধ লাইসেন্স পেয়ে গেছেন। কী করে?

‘গরু-ছাগল চিনলেই লাইসেন্স দিতে হবে’- এ কথা কে বা কারা বলেন, তাও আমরা বিবেচনায় রাখি না। একজন মন্ত্রী শ্রমিক নেতা যখন এ কথা বলেন অদক্ষ চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, তখন মূল দায়টা কার?

চালক-শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসব বিবেচনায় রাখা হয় না। বাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, বাসের মালিকের বিরুদ্ধে নয়। চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, কারণ চালক প্রভাবশালী নয়। চালক-শ্রলিকদের ব্যবহার করে যারা প্রভাবশালী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবাও হয় না।
৫. সাম্প্রতিক সময়ের পরিবহন ধর্মঘটের বিষয়টি লক্ষ্য করেন। মন্ত্রীর বাসায় মিটিং করে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত দিলেন মালিক-শ্রমিক নেতারা। তারপরের ঘটনা কী ঘটল? একজন শ্রমিক নিহত হলেন। সাধারণ শ্রমিকদের নামে মামলা হয়েছে। গ্রেফতার হচ্ছে। নেতারা সম্পূর্ণ নিরাপদ।

সাধারণ মানুষের গণপরিবহনের জন্যে কেনা হয়েছিল ভলভো বাস। মেরামত না করে ফেলে রেখে ধ্বংস করে দেওয়া হলো। কেনা হলো প্লাস্টিক বডির নতুন বাস। তাও বিআরটিসিকে দিয়ে পরিচালনা না করে লিজ দিয়ে দিচ্ছি। লোকসান তো বটেই, নৈরাজ্যকর অবস্থার চূড়ান্ত চলছে।

সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশে গণপরিবহন বলতে কিছু নেই।

ঢাকার বাইরের নছিমন-করিমনের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার। দুর্ঘটনার জন্যে এগুলো অনেকটা দায়ী, তাও অসত্য নয়। কিন্তু নছিমন-করিমনের ওপর ভিত্তি করে যে স্থানীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা, পণ্য পরিবহন- সেটা কিভাবে চলবে যদি নছিমন-করিমন না থাকে? সরকারের তো গণপরিবহন ঢাকাতেও নেই, সারা দেশের কোথাও নেই।

ফলে ঢাকা শহরে অবৈধ গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, সাধারণভাবে ভালো উদ্যোগ মনে হলেও, তেমন কোনও সুফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। উল্টো মানুষের দুর্ভোগ আর একটু বাড়ল।

সামগ্রিক পরিকল্পনা ছাড়া গণপরিবহন গড়ে উঠবে না। আর সামগ্রিক পরিকল্পনার জন্যে দরকার স্বদিচ্ছা। যা আমাদের কারও মধ্যেই নেই, বিশেষ করে দেশ পরিচালনাকারী নীতিনির্ধারকদের মধ্যে তা সবচেয়ে কম।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
করোনার পরে মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পরে মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ