X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

হ্যাঁ ১৮, না ১৮

জোবাইদা নাসরীন
০৯ মার্চ ২০১৭, ১৪:১৩আপডেট : ০৯ মার্চ ২০১৭, ১৪:১৬

জোবাইদা নাসরীন এটি আর গোপনীয় কোনও তথ্য নয় যে বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে এশিয়ার দেশগুলোর বাংলাদেশের স্থান সবার আগে। এতোদিন ধরে বাংলাদেশে মেয়েদের বিয়ের বৈধ বয়স ছিল ১৮ বছর। যদিও গবেষণা রিপোর্ট বলছে ১৮ বছর আগেই বাংলাদেশে প্রায় ৭০% নারীর বিয়ে হয়। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি পাস হওয়া বিলেও নারীর বিয়ের বয়স ১৮ বছরই আছে। কিন্তু একটি বিশেষ বাক্য যুক্ত করে এর বাধ্যবাধকতা শিথিল করা হয়েছে।গত বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রথম বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন মন্ত্রিসভায় অনুমোদন লাভ করে। এর পর থেকেই তৈরি হয় এই আইন নিয়ে বিতর্ক। জোরালো আপত্তি ওঠেছিল বিভিন্ন ফোরাম থেকে। এই বিতর্কের মধ্যেই গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বাল্য বিবাহ নিরোধ বিল ২০১৭ সংসদে কণ্ঠভোটে পাস হয়। এই বিলে ছেলে এবং মেয়ের বিয়ের ন্যূনতম বয়স যথাক্রমে ২১ এবং ১৮ রাখা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো  'তবে' যুক্ত করে বিলটিতে একটি বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে। এই 'তবে' এর আওতায় আছে যে 'বিশেষ প্রেক্ষাপটে' ২১ এবং ১৮ এর কম বয়সেও বিয়ে দেওয়া যাবে।
এই বিশেষ প্রেক্ষাপটটি খোলাসা করা হয়নি এবং কত কম বয়সে বিয়ে দেওয়া হবে সেই বিষয়েও কোনও সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা নেই। এই আইনটি যখন মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছিল তখন বিভিন্নমুখী প্রশ্নের জবাবে এক পর্যায়ে আমাদের জানানো হয়েছিল এই 'বিশেষ প্রেক্ষাপট' এর বিষয়টি আদালত ঠিক করবে এবং পাসকৃত বিলে এটি বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে বলে জানানো হয়েছে। তবে পত্রিকাসূত্রে মতে, আইন পাসের পর প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকী বলেন, যে কেউ চাইলেই এই সুযোগ পাবেন না। তবে কারা পাবেন সেটিও স্পষ্ট আছে। তবে তিনি আরও জানান যে বাল্য বিয়ে ঠেকাতেই এই আইনটি করা হয়েছে। তবে ১৮ বছরে আগে বিয়ে একভাবে 'শিশু বিয়ে' বা 'বাল্য বিয়ে'কেই প্রতিষ্ঠিত করে কেননা শিশুর সংজ্ঞায়নে বলা হয় যে, ১৮ বছরের আগ পর্যন্ত একজন মানুষ শিশু থাকে। যদিও বলা হয়েছে এই নতুন আইনটি র মাধ্যমে 'চাইল্ড ম্যারেজ রেসট্রেইন্ট অ্যাক্ট -১৯২৯' বাতিল হলো।

এর আগে এই বিষয়ে অর্থাৎ ১৮ এর নিচে বিয়ের যৌক্তিকতা প্রশ্নে সরকারের দিক থেকে যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশের উদাহরণ সামনে আনা হয়। যুক্তরাজ্যে ১৬ বছরে বিয়ে করা যায় পিতা মাতা কিংবা কোর্টের অনুমতি সাপেক্ষে। তবে সেখানের প্রক্ষোপট ভিন্ন। সেখানে সিঙ্গেল মাদার আছেন, যেটি রাষ্ট্র দ্বারা স্বীকৃত। সেখানে হয়তো সন্তানের পিতামাতার দায় দায়িত্বের কথা ভেবে বিয়ের বয়স ১৬ রাখা হয়েছে।

বলা হচ্ছে মানবিক কারণে এই বিশেষ অংশটি যুক্ত করা হচ্ছে যেখানে ১৮ এর নিচেও বিয়ে দেওয়া যাবে। আইন পাসের দুইদিন পরই ২০৩০ সালে নারী পুরুষের সমতা অর্জন- ‘ট্রেড ইউনিয়নসহ সব ক্ষেত্রে এখনই এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক  এক মত বিনিময় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন- বাল্যবিবাহের মূল আইনে গুরুত্ব না দিয়ে সবাই বিশেষ ধারার প্রতি নজর দিচ্ছেন  এবং বলেন, একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর সে যদি অন্তঃসত্ত্বা হয় তখন মেয়েটি কী করবে? এই রকম ক্ষেত্রে আদালতের আদেশে দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়েই সমাধান (দৈনিক প্রথম আলো ৩ মার্চ, ২০১৭)। প্রশ্ন উঠেছে তাহলে কি ধর্ষণের শিকার একজন নারীর ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার প্রতিই মন্ত্রী ইঙ্গিত করছেন? এবং যদি এটিই হয় এই আইনের উদ্দেশ্য তাহলে এর মধ্যে দিয়ে ধর্ষণের মতো একটি যুদ্ধাপরাধকে যে বৈধ করা হবে সেই বিষয়টির প্রতিও  খেয়াল রাখতে হবে মাননীয় মন্ত্রীকে।

তবে সংসদে উপস্থাপিত বিলে বিশেষ বিধান সম্পর্কে বলা হয়েছে যে- ‘এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোনও বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোনও নারীর সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশনাক্রমে এবং মাতা- পিতার সম্মতিক্রমে বিধিদ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরনক্রমে বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না।’ আইনটির খসড়া পরিমার্জনের বা সংযোজনের জন্য সংসদীয় কমিটির কাছে গেলে তারা ‘কোনও নারীর’র জায়গায় ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ এবং পিতা-মাতার সঙ্গে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতি বিষয়টি যুক্ত করছেন। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এবং বিশেষ করে বিয়ের ক্ষেত্রে পিতার অভিভাবকত্বই সামনে আসে। সকল প্রত্যক্ষ উৎপাদকের মতো সন্তানের জন্ম দেওয়া মাও সন্তানের অভিভাবকত্ব থেকে প্রায়শই বঞ্চিত হন। এবং সন্তানের বিয়ের ক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে মতামত প্রধানের ক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে পিতার মতামতকেই প্রায়শই গুরুত্ব দেওয়া হয় বেশি। সেক্ষেত্রে কনে হিসেবে নারী এবং অভিভাবক মা হিসেবে নারী- এই দুই নারীই বিয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় বাদ থাকছে।

তবে কিছু একবারেই নির্দিষ্ট পরিসরে এটি হতে পারে, যেমন প্রতিবন্ধী নারীর ক্ষেত্রে, যেখানে তাকে দেখভাল করার মতো মানুষ নেই, কিংবা কোনও নারী শিশুর পিতা মাতার কেউই বেঁচে নেই এবং সে অন্যের আশ্রয়ে বড় হচ্ছে কিন্তু তারাও সেই দায়দায়িত্ব নিতে আর পারছেন না বা চাইছেন না সেক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে বিয়ে হতে পারে ১৮ বছরের নিচে।এগুলো একেবারেই নির্দিষ্ট এবং নির্ধারিত থাকা প্রয়োজন। তা না হলে এই আইনের অপব্যবহার দেশকে অনেক পিছিয়ে নিয়ে যাবে যেখানে ১৮ এর নিচে বয়সের কোনও র্নিধারিত বয়সসীমা নেই। বাংলাদেশে যেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিয়ের সঙ্গে সন্তান ধারনের ধারণা যুক্ত, তাই ১৮ এর আগে বিয়ে এবং মা হওয়া প্রচণ্ডভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

তাই অচিরেই 'বিশেষ প্রেক্ষাপট'টি স্পষ্ট করা উচিত এবং এই বিষয়ে যেন কোনও ধরনের সুযোগের সৃষ্টি না হতে পারে যেখানে নারীর স্বাস্থ্য ও সামাজিক ঝুঁকি তৈরি হতে না পারে সেই বিষয়ে সরকারকে আরও মতদর্শিকভাবে যত্নবান হওয়া দরকার।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected].

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নিউইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি যুবক নিহত, যা জানা গেলো
নিউইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি যুবক নিহত, যা জানা গেলো
চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাং গ্রুপের ৩৩ সদস্য আটক
চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাং গ্রুপের ৩৩ সদস্য আটক
বাংলাদেশি আমেরিকানদের প্রশংসা করলেন ডোনাল্ড লু
বাংলাদেশি আমেরিকানদের প্রশংসা করলেন ডোনাল্ড লু
মেটা-ডেমোক্র্যাসি ইন্টারন্যাশনালের ডিজিটাল সুরক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ
মেটা-ডেমোক্র্যাসি ইন্টারন্যাশনালের ডিজিটাল সুরক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ