X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কেন আমাদের সাবমেরিন লাগবে?

আমীন আল রশীদ
১৩ মার্চ ২০১৭, ১৩:০৯আপডেট : ১৩ মার্চ ২০১৭, ১৬:১১

আমীন আল রশীদ বাংলাদেশের নৌ বাহিনীতে প্রথমবারের মতো দু‘টি সাবমেরিন যুক্ত হলো। এই নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করছেন, বাংলাদেশ সাবমেরিন দিয়ে কী করবে? এমন প্রশ্নও কোনও কোনও টেলিভিশনের টকশোতে দর্শকরা করেছেন, বাংলাদেশের মতো একটি ‘গরিব’ দেশকে কেন সাবমেরিন কিনতে হবে?
প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ যুদ্ধজাহাজ হোক আর একে ফোর্টি সেভেন রাইফেলই হোক- রাষ্ট্র সেগুলো কেনে জনগণের পয়সায়। সরকারের নিজের পয়সা বলে কিছু নেই। তাই রাষ্ট্রের যেকোনও নাগরিকেরই প্রশ্ন করার অধিকার রয়েছে যে, কেন তার টাকায় এই যুদ্ধজাহাজ বা এই অস্ত্র কেনা হলো?
মনে রাখা দরকার, আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে আমরাই, মানে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যে দেশকে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হতে হয়েছে। ফলে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বিশেষ গর্বের, অহঙ্কারের। এজন্য এটি অন্যদের কাছে ঈর্ষারও কারণ। যে রাষ্ট্র যুদ্ধ করে স্বাধীন হয় আর যে রাষ্ট্র বিনা রক্তপাতে কেবল মানচিত্রে দাগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে আলাদা হয়, সেই দুই রাষ্ট্রের চরিত্র বা সেই রাষ্ট্রগুলোর মানুষের চেতনা ও মানসিকতা অভিন্ন নয়। নয় বলেই বাংলাদেশকে তার জন্মের পর থেকেই অব্যাহতভাবে নানারকম বিপদ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। বিপদ এমনই যে, এই রাষ্ট্রের জন্মদাতাকেও সপরিবারে খুন হতে হয়। সুতরাং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির কালো অক্ষরে যতই লেখা থাকুক ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’, তবু আমাদের মানতে হয়, আমরা খুব নিরাপদ নই। শান্তিবাদী হলেও আমাদের ঘরের দরজায় ভালো করে খিল দেওয়া প্রয়োজন। সেই খিলে যুক্ত হওয়া নতুন অতিথি সাবমেরিন; যা আছে বিশ্বের আর মাত্র ৩৯টি দেশের হাতে। অর্থাৎ সাবমেরিন আছে এমন দেশের তালিকায় বাংলাদেশ এখন ৪০তম।
নাগরিক হিসেবে এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। সংখ্যায় মাত্র দু‘টি হলেও কিংবা এই সাবমেরিন দু’টির শক্তি আসলে কত, সেসবের পরীক্ষা দেওয়া যাবে কেবল যুদ্ধের সময়ই। কিন্তু কারো সঙ্গে যুদ্ধ না বাঁধলেও এই সাবমেরিন একটি প্রতীকী শক্তি। এটি একটি রাষ্ট্রের নৌ বাহিনীর সক্ষমতার উপমা।
বাংলাদেশ তিনদিক দিয়ে ভারতবেষ্টিত। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের থই থই জলরাশি। তার অদূরে মিয়ানমার। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে আমরা এটা ধরেই নিতে পারি কিংবা আমরা বিশ্বাস করতে চাই যে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি হবে না। কিন্তু মনে রাখা দরকার, মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের স্থলসীমান্তও রয়েছে; তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুব সুখকর নয়।

মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ আন্তর্জাতিক আদালতে ফয়সালা হয়েছে। কিন্তু প্রায়ই তাদের নৌবাহিনী বাংলাদেশের জেলেদের ধরে নিয়ে যায়। সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিরোধও মীমাংসা হয়েছে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত হত্যা, চোরাচালানসহ নানা ইস্যুতেই টানাপড়েন আছে। সেইসব টানাপড়েন কখনও যুদ্ধে রূপ নেবে, আমরা আশা করি না। কিন্তু আমাদের প্রস্তুত থাকার বিকল্প নেই। দুটি সাবমেরিনের কমিশনিং অনুষ্ঠানেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘কেউ আক্রমণ করলে যেন আমরা সমুচিত জবাব দিতে পারি, সেই প্রস্তুতি আমাদের থাকবে।’
বাংলাদেশ ছোট দেশ বলে তার সামরিক বাহিনী বা সামরিক সক্ষমতা দুর্বল থাকবে, এটি ভাবার কোনও কারণ নেই। ইসরায়েল অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি রাষ্ট্র। কিন্তু তার সামরিক সক্ষমতা পৃথিবীর বহু বড় দেশের চেয়ে বেশি। এমনকী তার পারমাণবিক অস্ত্রও রয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্র আমাদের দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে চীনের-যাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ সাবমেরিন দুটি কিনেছে। সুতরাং কূটনীতি আর সমরনীতির খেলায় একসময় বাংলাদেশকে আরও শক্তিশালী অস্ত্র কিনতে হবে।
সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ মীমাংসার ফলে বঙ্গোপসাগরে যে বিশাল এলাকার মালিকানা বাংলাদেশ অর্জন করেছে, ওই বিশাল এলাকায় যে ব্লু ইকোনমি বা নীল অর্থনীতির হাতছানি রয়েছে, তার সুরক্ষায় নৌবাহিনীকে অধিকতর শক্তিশালী করার কোনও বিকল্প নেই। বরং এরকম সাবমেরিনের সংখ্যা ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই বাড়াতে হবে।
কত দাম দিয়ে এই সাবমেরিন কেনা হলো? এই টাকা দিয়ে অনেকগুলো বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেত। এ রকম বিবিধ মতামত দেওয়া খুবই সহজ। কিন্তু মনে রাখা দরকার, কোনও উন্নয়ন প্রকল্প স্থগিত রেখে সাবমেরিন কেনা হয়নি; বরং নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতুর কাজ চলছে। গরিব বা পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিও চলছে। সেসব কর্মসূচি বাতিল করে সাবমেরিন কেনা হয়নি। সাবমেরিন কেনার পয়সা আছে বলেই বাংলাদেশ তা কিনেছে।
এছাড়া সব রাষ্ট্রেরই আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। কার আত্মরক্ষার কৌশল কেমন হবে, তা নির্ধারিত হয় তার প্রয়োজনের ওপরে। নরওয়ে বা সুইডেনের আত্মরক্ষার কৌশল আর প্যালেস্টাইনের কৌশল এক নয়। ভূটানের কৌশলের সঙ্গে বাংলাদেশের কৌশল মিলবে না। বরং ভূরাজনীতির কারণেই বাংলাদেশকে অনেক শক্তিশালী এবং দূরদর্শী কৌশল নিতে হয়। একজোড়া সাবমেরিন কেনা সেই কৌশলেরই অংশ এবং মনে রাখা দরকার সাবমেরিন দুটি কেনা হয়েছে চীনের কাছ থেকে; যে চীন আগামীতে বিশ্ব অর্থনীতির নেতৃত্ব দেওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। যে চীনের সঙ্গে ভারতের ‘সতর্ক সম্পর্ক’, যে চীনকে সমীহ করে খোদ যুক্তরাষ্ট্রও।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আর কোথাও পরমাণু বোমা ফেলা হয়নি। কিন্তু পরমাণু বোমার বিভীষকা সম্পর্কে বিশ্বাবাসী জানে। ফলে পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোকে অন্যেরা সমীহ করে, ভয় পায়। উত্তর কোরিয়ার মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশকেও যুক্তরাষ্ট্র হম্বিতম্বি দেখায়। দক্ষিণ কোরিয়াকে রক্ষার জন্য তার মার্কিন বন্ধু প্রতিনিয়তিই উত্তর কোরিয়াকে নানা হুঙ্কার দেয়। কিন্তু তারপরও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে শক্ত কোনও পদক্ষেপ নিতে ভয় পায়। এর একমাত্র কারণ উত্তর কোরিয়ার পরমাণু সক্ষমতা।
আপনার ঘরে একটা লাইসেন্স করা অস্ত্র আছে; এটা জানা থাকলে আপনার বাড়িতে চোর-ডাকাত ঢোকার আগে ছয়বার ভাববে। আপনার শত্রুপ্রতিবেশীও আপনার সঙ্গে সহজে লাগতে যাবে না। হয়তো ওই অস্ত্র আপনি পুরো জীবদ্দশায় একবারও ব্যবহার করেননি বা করতে হবে না, কিন্তু এই অস্ত্রটি আপনাকে ভরসা দেয়। আপনার সম্পদ পাহারা দেয়। একইভাবে একটি রাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা কতটুকু, তার ওপরে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষাভাবে নির্ভর করে তার সঙ্গে অন্য দেশের কূটনৈতিক দেনদরবার। সামরিক সক্ষতাসম্পন্ন একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রকে সমীহ করে কথা বলতে হয়। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকে না। কারও দয়াদাক্ষিণ্য কিংবা কৃপায় যে বাংলাদেশ এখন আর বসে নেই, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পদ্মা সেতু। অতএব সেই গর্বের তালিকায় এবার ‘জয়যাত্রা’ ও ‘নবযাত্রা’ নামে যে দু’টি সাবমেরিন যুক্ত হলো, তাকে স্বাগত জানানোই উচিত।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ