X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

গণহত্যা দিবস এবং সামান্য ভুল

আনিস আলমগীর
১৪ মার্চ ২০১৭, ১১:৫৪আপডেট : ১৪ মার্চ ২০১৭, ১৫:৫৪

আনিস আলমগীর আমাদের ভুলের কারণে আমরা একটুর জন্য হাতছাড়া করে ফেলেছি দিবসটিকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালনের। ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস পালনের একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমাদের জাতীয় সংসদ ১১ মার্চ ২০১৭। অথচ ২০১৫ সালে ৯ ডিসেম্বরকে জাতিসংঘ গণহত্যা দিবস ঘোষণা করেছে। তারও অনেক আগে ১৯৪৮ সালে ৯ ডিসেম্বর গণহত্যা সংক্রান্ত কনভেনশনে গণহত্যা দিবস সংক্রান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিলো। এতোদিন কোন তারিখে দিবসটি পালন করা হবে তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা ছিল। বাংলাদেশ চেষ্টা করলে ২৫  মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে জাতিসংঘ থেকে স্বীকৃতি আদায় করতে পারতো, যেমনটা হয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারির ক্ষেত্রে।
যাহোক জাতিসংঘ গৃহীত পদক্ষেপ অনুসরণ করে বাংলাদেশও ২৫ শে মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের সংসদে এই দিবসটিকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যার ইতিহাসের সঙ্গে জাতির স্বাধীনতার ইতিহাস জড়াজড়ি করে গড়ে উঠেছে। ২১ ফেব্রুয়ারিকে আমরা ভুলিনি, সে দিনকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করেছি আমরা জাতিসংঘ থেকে। ২৫ শে মার্চকে আমরা ভুলিনি সত্য, কিন্তু বিস্মৃত হয়েছিলাম।
জাতি তার পুরনো গৌরবময় ইতিহাস মনে না রাখলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, হীনমন্যতায় ভোগে। বাঙালি জাতিকে ২৫ মার্চের রাতে ঘুমের ঘোরে আক্রমণ করে পাকিস্তানিরা শেষ করে দিতে চেয়েছিলো। বাঙালি লাখে লাখে মৃত্যুবরণ করেছে সত্য কিন্তু একাট্টা হয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে ইতিহাসের চেহারাও পরিবর্তন করে দিয়েছে। এ দিনটি গণহত্যা দিবস সত্য আবার বাঙালি জাতির সৌয্য বীর্য তেজ দেখানোর দিবসও। বঙ্কিম বাবু বলতেন, ‘বাঙালির ইতিহাস চাই, নইলে বাঙালি বাঁচিবে না'। তিনি দেখে যাননি, বেঁচে থাকলে দেখতেন বাঙালি বর্তমানে কত সৌর্য্য বীর্য আর গৌরবের ইতিহাস রচনা করেছে।

পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বর্বর গণহত্যা আরম্ভ করেছিলো। এ গণহত্যা অব্যাহত ছিল দীর্ঘ নয় মাস। সর্বমোট ৩০ লাখ লোক হত্যা করেছিল পাকিস্তানিরা। ৩ লাখ মা বোনের ইজ্জত হরণ করেছিলো। বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গণহত্যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গণহত্যা। সর্ববৃহৎ গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিলো কঙ্গোয়। বেলজিয়ামের রাজা কঙ্গো কিনে নিয়ে ছিল। রাজা লিওপোল্ডের সঙ্গে কঙ্গোর লোকের বিরোধ হয়েছিলো রাবার সংগ্রহের কাজ নিয়ে। বেলজিয়ামের রাজা ১ কোটি লোককে হত্যা করেছিলো।

দ্বিতীয় বৃহত্তম গণহত্যা করেছিলো জার্মানরা। হিটলারের ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কাস পার্টি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় গণহত্যা চালায়। তারা ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করে। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিলো। ১০ লাখ লোক নিহত হয়। বসনিয়ার গণহত্যা চালায় সার্বরা। গণহত্যা চালায় মুসলমানদের ওপর। ১৯৯২ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ১৯৯৫ সালের শেষ পর্যন্ত গণহত্যা চলেছিলো।

কম্বোডিয়ায় গণহত্যা চালায় লন লন সরকার। সেখানে ৭ লাখ মুসলিম ছিল। ৫ লাখ গণহত্যায় মারা যায়। কম্বোডিয়ার গণহত্যায় মোট দশ লাখ লোক মারা যায়। এ সবই হচ্ছে বিশ্বের মর্মান্তিক গণহত্যাগুলো।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা, পতাকা, জাতীয় সংগীত ইত্যাদিকে উপহাস করা লোকের সংখ্যা কম নয়। কম হলে পাকিস্তানি মনমানসিকতার লোক ২৭ বছর বাংলাদেশ শাসন করে কিভাবে! যে দল বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে সে দলের লোক মন্ত্রী হয় কিভাবে! যে শাহ আজিজ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে বক্তৃতা দিয়েছেন সে শাহ আজিজ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী হন কিভাবে? সুতরাং বাংলাদেশের অভ্যূদয় সংক্রান্ত কোন দিনকে দিবস হিসাবে পালন করা প্রয়োজন তা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে কমিটি করে নির্ধারণ করা প্রয়োজন এবং তা স্থির করে সংসদে বিল এনে পাস করে দেওয়া দরকার। সব দিবসগুলো যেন শৃঙ্খলার সঙ্গে জাতি পালন করতে পারে। তা না হলে পাকিস্তানি মানসিকতার লোকগুলো সুযোগ পেলেই দিবসগুলো নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চালাবে।

খোদ জিয়াউর রহমানই তো জাতীয় সংগীত বদল করে ফেলতে চেয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে। ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী ময়দানের যেখান থেকে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছিলেন এবং পাক বাহিনী যেখানে আত্মসমর্পণ করেছিল সে জায়গায় জিয়াউর রহমান শিশু পার্ক স্থাপন করে গেছেন।

ধারণা করা হয় জিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে এসব করেছিলেন। অনতিবিলম্বে শিশুপার্কটি সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা উচিৎ। এখানে উল্লেখ করতে হয় ১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে যে জায়গায় পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিলো ঠিক সেখানে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তান মনুমেন্ট তৈরি করা হয়েছে। আমার মনে হয় বর্তমান শিশু পার্কে বাংলাদেশ মনুমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবগুলো বিষয়কে সুনির্দিষ্ট করে ফেলা উচিৎ। কারণ এসব কিছুই ঐতিহাসিক বিষয়। ঐতিহাসিক বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করার অর্থ হলো ইতিহাসকে উপেক্ষা করা। দায়িত্বশীল রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অনুরূপ কিছু হওয়া উচিৎ নয়। অনেক বদ্ধভূমি বিস্মৃত হয়ে গেছে, নদীর ধারের অনেক বদ্ধভূমি নদী ভাঙনে বিলিন হয়ে গেছে। যেগুলো এখনও অবশিষ্ট আছে সেগুলোর পরিচর্যা করা দরকার। মোড়ে মোড়ে স্বাধীনতার ক্ষত চিহ্নকে দৃশ্যমান রেখে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতির আত্মত্যাগের চিহ্নগুলোকে সজিব রাখতে হবে- দৃশ্যমানভাবে যেন জাতি অনুপ্রেরণা পায়।

প্যারিসের এক মনুমেন্টের গোড়ায় লেখা আছে, ‘আমরা আমাদের আজকের দিনটা উৎসর্গ করে দিলাম তোমাদের আগামী দিনগুলোকে সৌন্দর্যময় করার জন্য’। এ লেখা তো অহেতুক নয়। দীর্ঘ দেড়শত বছর আগে স্থাপিত এ ফলকটি প্রতিদিন অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে ফরাসি জাতিকে। সুনির্দিষ্ট করার কথা বলছি এ জন্য যে ক্ষমতার ইঙ্গিত ফেলে আমরা মহাবীরও দালাল হয়ে যায়। শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন নামকরা সৈনিক। মন্ত্রী হওয়ার লোভে পরে তিনি একসময় বলে ফেললেন, ‘জিয়ার ঘোষণা শুনে আমি উজ্জীবিত হয়েছি, মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছি’। অথচ প্রত্যেক ৩ মার্চ শাজাহান সিরাজ ইশতেহার পাঠ এর অনুষ্ঠান উপলক্ষে ‘দিবস’ পালন করে থাকেন কারণ তিনিই ইশতেহার পাঠ করেছিলেন। আ স ম রব ২ মার্চ পতাকা উত্তোলন দিবস পালন করে থাকেন। কারণ তিনি ২ মার্চ পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। আর তিনি বলেছেন, ৭০ এর নির্বাচন ফেয়ার ছিল না, তিনি নিজে ১৭টি জালভোট দিয়েছেন।

কাদের সিদ্দিকী দীর্ঘ দিনব্যাপী আওয়ামী লীগের সঙ্গে নেই। নিজে নতুন দল গঠন করেছেন। হতাশায় ভুগে তিনি কোনদিন কী বলেন কী জানি!

কালীপদ চক্রবর্তী সূর্যসেনের সহকর্মী ছিলেন। ব্রিটিশ তাকে সারা জীবনের জন্য দীপান্তরে আন্দামানে পাঠিয়েছিলো। ১৯৪৭ সালে আন্দামান থেকে মুক্ত হয়ে নিজ জেলা চট্টগ্রামে ফিরে এসেছিলেন। দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন, ভারতেও যাননি। সাদামাটা জীবন যাপন করেছেন। আত্মত্যাগের জন্য কারো কাছ থেকে তিনি আদাব-সালামও প্রত্যাশা করতেন না। তেমন আত্মত্যাগী লোক তো এখন বিরল। বড় বড় আত্মত্যাগীরাই এখন থালা নিয়ে ঘুরে কিছু পাওয়ার আশায়। উল্টা সিধা কথা বলে। যেন তার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। যারা নিজেদের কর্ম দিয়ে ইতিহাসে স্থান সৃষ্টি করতে পেরেছে তাদের এ দৈন্যদশা দেখলে মর্মাহত হই।

শুনেছি শাজান সিরাজ দুরারোগ্য ক্যানসারে ভুগছেন। জানি না তার আর্থিক অবস্থা কেমন। তবে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রাখা শাজাহান সিরাজের যেন বিনা-চিকিৎসায় মৃত্যু না হয় সেদিকে যেন তিনি দৃষ্টি দিতে ভুল না করেন। শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শাহাজান সিরাজ- এসব ছাত্র নেতাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামে। তাদের মাঝে অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেকে এখনও জীবিত আছেন। যে যেই পথেই চলুক, রাষ্ট্র যেন তাদের প্রতি যত্নবান থাকে। রাষ্ট্রীয় উদারতা কোনও সংকীর্ণতার মাঝে আবদ্ধ থাকা উচিৎ নয়। ভাষাসৈনিক সুলতান সাহেব ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বারান্দায় মারা গিয়েছিলেন। তার বেদনা অনেকে এখন অনুভব করে। সে রকম কোনও কিছু স্বাধীনতার বীর সৈনিকদের ব্যাপারে যেন না হয়।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গরমে পুড়ছে খুলনা বিভাগ
গরমে পুড়ছে খুলনা বিভাগ
দোকান থেকেই বছরে ২ লাখ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় সম্ভব
দোকান থেকেই বছরে ২ লাখ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় সম্ভব
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অতীত ফিরিয়ে আনলেন শান্ত-রানারা
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অতীত ফিরিয়ে আনলেন শান্ত-রানারা
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয় ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ জেনে নিন
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয় ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ জেনে নিন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ