X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর প্রসঙ্গে

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৫ মার্চ ২০১৭, ১১:৫৮আপডেট : ১৫ মার্চ ২০১৭, ১২:০৭

একাত্তর টিভির পরিচালক (বার্তা) সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কেবল পররাষ্ট্র বিষয়ক নয়। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে এই সম্পর্ক। দুটি প্রতিবেশী দেশ যদি দ্রুত উন্নয়নশীল হয়, তবে তারা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটিকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে। ভারত এবং বাংলাদেশ, এই দেশ দুটি তাদের আর্থিক যোগাযোগকে নিবিড়তর করে তুলে বাজার, ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির বর্ধিত চাহিদার ফায়দা নিতে পারে।
গত কয়েক বছরে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রসঙ্গটি অত্যন্ত গুরুত্ব পেয়েছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে এবং তার পরের বছর উভয় পক্ষই আর্থিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে উদগ্রীব। পরবর্তিতে ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময়ও এই উষ্ণতা অনুভব করা গেছে। মোদির নেতৃত্বে পুরো ভারত এক হয়ে বাংলাদেশের স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশের প্রতি আস্থার প্রতিফলন ঘটিয়েছে।
শেখ হাসিনার জমানায় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যেভাবে এগিয়েছে সেটা ভারতের স্বীকার করতে হবে।  উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মাটিতে ভারত-বিরোধী জঙ্গি পরিকাঠামো ধ্বংস করা সব কিছুতেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে হাসিনা সরকার। বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও ঘরোয়া ঐকমত্যের অভাবে তিস্তা চুক্তি অথবা স্থলসীমান্ত চুক্তি ভারত সম্পন্ন করতে পারেনি। ২০১৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের সময় ভারত পাশে ছিল এবং পরবর্তীতেও ছিল। বুঝতে পারা যায় যে সাউথ ব্লক জোরের সঙ্গে বিশ্বাস করেছে যে, তাণ্ডবের আবহে সমাপ্ত হওয়া সেই নির্বাচনের মুখ্য বিষয়টি নিছকই ব্যালট-যুদ্ধ ছিল না, ছিল ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে ধর্মভিত্তিক জঙ্গি রাষ্ট্রগঠনের লড়াই।

ঠিক এমন এক প্রেক্ষাপটে প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার বহুল প্রত্যাশিত ভারত সফর আগামী মাসে। কিন্তু তার আগেই এই সফর নিয়ে বেশ কিছু প্রসঙ্গ উঠে আসছে নানা আলোচনায়। বিরোধী দল বিএনপি বরাবরের মতো ভারত বিরোধী কার্ড নতুন করে বাজারে ছাড়ার চেষ্টা করছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এর মধ্যেই বলেছেন যে, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ছাড়া অন্য কোনও চুক্তি দেখতে চান না তারা। সেই অন্য চুক্তি বলতে বুঝিয়েছেন প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রসঙ্গ। একথা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে যে, আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের সময় ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে চায়। এই চুক্তি হবে ২৫ বছরের। ভারত বেশকিছু সময় ধরে এই চুক্তির জন্য বাংলাদেশকে চাপ দিয়ে আসছে। তবে এই চুক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশ অতটা আগ্রহী নয়। এ মাসের গোড়ার দিকে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।

আর এখানেই এ সফরকে ঘিরে অন্দরে আর বাইরে অস্বস্তি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কারণ এ ধরনের প্রচারণার রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক। প্রচারণা আনুযায়ী দিল্লির প্রস্তাব হচ্ছে  ভারত - বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা, বাংলাদেশের কাছে সমরাস্ত্র বিক্রি ও সরবরাহ অন্তর্ভূক্ত থাকবে। একই সঙ্গে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সম্মিলিতভাবে অভিযান চালনার ব্যাপার থাকবে চুক্তিতে। ভারতের অস্ত্রের বড় বাজার নেই। বড় কোনও দেশে ভারতের অস্ত্র বিক্রি হয় না। ভারত নিজেই প্রতিবছর রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র কেনে। বাংলাদেশের মানুষের সেন্টিমেন্ট এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ আগ্রহী থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। মানুষের চাওয়া বহু অপেক্ষার তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিটি হোক।

ভারতের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি বাংলাদেশই বিবেচনা করবে, ভারত নয়। তাই এই চুক্তির চেয়ে সীমান্তে হত্যা, ফারাক্কা বাঁধ, গঙ্গার পানি বণ্টন, তিস্তার পানি বণ্টনের মতো বিষয়গুলোর গুরুত্ব অনেক বেশি বাংলাদেশের কাছে।

দুই দেশের বাণিজ্য বেড়েছে বহুগুণ, যদিও বাণিজ্যের পাল্লা ভারতের দিকেই অনেকখানি ঝুঁকে রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে আমদানির পরিমাণ বাড়লে এই বাণিজ্য অনেক বেশি সুস্থায়ী এবং ভারসম হবে। বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়লে এই প্রক্রিয়া গতি পাবে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্র প্রচুর বিদ্যুৎ, টেলিকম ইত্যাদির পরিকাঠামো নির্মাণ থেকে জাহাজ নির্মাণ, তথ্যপ্রযুক্তি, পর্যটন, স্বাস্থ্য সব ক্ষেত্রই ভারতীয় বিনিয়োগকে স্বাগত জানাতে তৈরি। শিক্ষা ক্ষেত্রেও বিনিয়োগের সম্ভাবনা প্রচুর কারিগরি শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ থেকে রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, সবজায়গাতেই বিনিয়োগ সম্ভব। পরিবেশের ক্ষেত্রেও ভালো সুযোগ রয়েছে। ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, জল পরিশোধন, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি, বায়ু দূষণ প্রতিরোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিনিয়োগের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে অনেক খামতি রয়েছে। বিদ্যুৎ, সড়ক, বন্দর, জলপথ, রেলপথ সব ক্ষেত্রেই ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের সুযোগ রয়েছে। এই ক্ষেত্রগুলোতে বাংলাদেশ সরকার ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ছাড়পত্র দিয়েছে।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সার্বিক কৃষি খাত তিস্তার পানিপ্রবাহের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ২০০ বছর আগে তিস্তা উত্তরাঞ্চলের বৃহৎতম নদী হিসেবে পরিচিত ছিল। করতোয়া, আত্রাই, যমুনেশ্বরী ইত্যাদি নদী তিস্তার বিপুল জলরাশি নিয়ে প্রবাহিত হতো। একসময়ের অনন্ত যৌবনা তিস্তা এখন অপমৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদী নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এবং মানবতার প্রতি বিদ্রুপ করে তিস্তার ভারতীয় অংশের গজলডোবায় সব কটি গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পানি সরিয়ে সেচ কাজ এবং বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে, হচ্ছে। তিস্তার ভারতীয় অংশে ব্যারেজ নির্মাণ করায় শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে পানির প্রবাহ ভীষণভাবে কমে গেছে। ফলে বাংলাদেশের ১২৫ কিলোমিটার তিস্তা অববাহিকায় সার্বিক কৃষি খাত ও জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। তাছাড়া শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীর পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় উত্তরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। সার্বিকভাবে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

তাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির বাস্তব প্রতিফলন দেখার আগ্রহে আমাদের মানুষ। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া বাংলাদেশের মানুষের, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্ন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরের আলোচ্যসূচিতে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি প্রাধান্য পাক।

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজধানীকে সুন্দর করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি: আইইবি
রাজধানীকে সুন্দর করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি: আইইবি
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ