X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গিবাদ বাংলাদেশের পিছু ছাড়লো না

আনিস আলমগীর
২১ মার্চ ২০১৭, ১২:১৯আপডেট : ২১ মার্চ ২০১৭, ১২:২৮

আনিস আলমগীর বেশ কিছুদিন আমরা আত্মতৃপ্তিতে ছিলাম যে জঙ্গি কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কিন্তু সেসব ভুল প্রমাণ করে হঠাৎ জঙ্গিরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে সারাদেশে। র‌্যাবসহ প্রশাসনের ওপর আত্মঘাতি হামলা চালাচ্ছে তারা। অবশ্য জঙ্গিবাদ নতুন কিছু নয়, তার প্রয়োগ আর নেতৃত্বে পরিবর্তনটাই নতুন।
জন্মের পর থেকে জঙ্গিবাদ বাংলাদেশের পিছু ছাড়েনি। কখনও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নামে কখনও সর্বহারার বিপ্লবের নামে আবার এখন চলছে ইসলামি বিপ্লবের নামে। সিরাজ শিকদার আর জিয়া উদ্দীন বিপ্লব ফেরী করেছিলেন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর পর। সিরাজ শিকদার পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। বড় চাকরি করে ব্যক্তি জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারতেন। তা না করে সর্বহারাকে সুসংগঠিত করে বিপ্লব করতে চেয়েছিলেন। নিশ্চয়ই মানব প্রেমিক ছিলেন। না হয় নিজের ব্যক্তি জীবনের সুখের তালাশ না করে সর্বহারাদের সুখের কথা চিন্তা করে চঞ্চল হলেন কেন?
খুব গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেছি কিছু যুবককে নিজের মতাদর্শে হাত করে তারা যে সময় প্রাথমিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছিল সে সময় থেকেই তারা বিরাট একটা প্রতিষ্ঠিত সরকারকেই নিজের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করিয়ে ফেলেছিলো। অথচ এ প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায় তাদের না ছিল কোনও লোকবল, না ছিল অস্ত্র বল আর না ছিল জনসমর্থন। যে সর্বহারাদের জন্য তারা আত্মত্যাগ করতে বের হয়েছিলো সে সর্বহারাদের কাজেই তারা ছিল অপরিচিত। যাদের জন্য তারা কাজ করেছিলেন তারাই জানতো না তাদের পরিচয়।

সুতরাং নেতৃত্ব যখন আক্রান্ত হয়েছে প্রতিপক্ষ যখন নেতৃত্বকে নির্মূল করতে বদ্ধপরিকর তখন প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি তারা কোনোখানে কোনোভাবে। কারণ যে সর্বহারা প্রতিরোধ গড়বে তারা তো অসংগঠিত এমনকি যে নেতৃবৃন্দ সর্বহারাদের মঙ্গলের জন্য বিপ্লব করতে নেমেছে তারাই সর্বহারাদের কাছে ছিল সম্পূর্ণ অপরিজ্ঞাত। অথচ দুনিয়ায় যে বিপ্লবগুলো সফল হয়েছে শুনেছি পঙ্গপালের মতো তার লোকগুলো তাকে অনুসরণ করেছে লং মার্চ সফল না হওয়া পর্যন্ত। ক্ষুধার জ্বালায় নাকি কোমরের বেল্ট চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়েছে। অথচ বাংলাদেশের প্রারম্ভিককালে বিপ্লবীরা কিছু মানুষ হত্যা করেছে বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক ক্ষীণ কণ্ঠে স্লোগান তুলেছে আর বিপ্লব ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই নিজেরা নির্মূল হয়ে গেছেন। ভবিষ্যতের জন্য কোনও ইতিহাসও সৃষ্টি করতে পারেননি। মুখরোচক কিছু সত্য মিথ্যা গল্পের খোরাক জুগিয়ে নিজেরা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিলেন।

আলাউদ্দীন, মতিন, তোয়াহা, আব্দুল হক, দেবেন বশর, অহিদুর রহমান, টিপু বিশ্বাস এরাও কিন্তু বিপ্লবী দীক্ষায় দীক্ষিত লোক। বৃহত্তম যশোর ও খুলনা এলাকায় আব্দুল হক সাহেবের কিছু কর্মকাণ্ড ছিল। ১৫/২০ বিঘার জমির মালিককে জোরদার বলে আখ্যায়িত করে তাদের গলা কেটে বিপ্লবের মহড়াও দিয়েছিলেন। আত্রাইয়ে আলাউদ্দীন, মতিন, অহিদুর, টিপু বিশ্বাস এরাও বিপ্লব শুরু করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সফলকাম হননি।

ভুট্টোর জীবনী লেখককে ভুট্টো তার জীবনীগ্রন্থ প্রণয়নে সহায়তা করতে গিয়ে অনেক দলিল দস্তাবেজ, চিঠিপত্র দিয়ে সহায়তা করেছিলেন। উক্ত লেখক ঐসব চিঠিতে কমরেড আব্দুল হক সাহেবের কয়েকখানা চিঠি পেয়েছেন। তাতে দেখা যায় যে তিনি ভুট্টোর কাছে অস্ত্র-সস্ত্রও টাকা পয়সা চেয়েছিলেন। পাকিস্তান কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ছিল না ভুট্টোও সমাজতন্ত্রী ছিলেন না। আব্দুল হক সাহেব ভুট্টোর সহায়তা চেয়েছিলেন কেন বোধগম্য নয়। সম্ভবতো শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু এ ভিত্তিতেই  আব্দুল হক সাহেব তার দ্বারস্ত হয়েছিলেন। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করলে মুজিবের অবসানের পালা ত্বরান্বিত হলে ভুট্টোতো-পুলকিত হবেনই। সুতরাং ভুট্টো আব্দুল হক সাহেবকে সাহায্য করতে সম্মত হওয়া তো বিচিত্র কিছু নয়।

আব্দুল হক সাহেবের উপলব্ধি সঠিক ছিল। কানু সন্ধ্যাল, চারু মজুমদারেরা অবশ্য সাহায্যের জন্য গোপনে প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে ছিলেন চীনে। বাংলাদেশে কেউ সফল হননি। বৃহত্তম যশোর ও খুলনা এলাকায় হক সাহেবের ক্যাডারেরা তার মৃত্যুর পর বহুদাবিভক্ত হয়ে চাঁদাবাজিতে আত্মনিয়োগ করেছিলো। মাছের ঘের দখলের কাজেও ভাড়াটিয়া হিসেবে কাজ করতেন। আবার নির্বাচনের সময়ও ভাড়াটিয়া হিসেবে তারা কাজ করতে দেখেছি। জামাতের গোলাম পরওয়ারকে তো তারাই জিতিয়ে দিয়েছিলো।

পশ্চিম বাংলার বিপ্লবীরা কলকাতা শহরে মোড়ে মোড়ে স্থাপিত কিছু মূর্তির মাথা ফেলে দিয়ে কনিস্কের মূর্তি বানিয়ে দিয়ে ছিলো। আর কলকাতা শহরের কলেজগুলোর মেধাবী ছাত্রগুলোকে বিপ্লবের ক্যাডার বানিয়ে সম্পূর্ণ একটা প্রজন্ম হতে মেধাবী লোক পাওয়া থেকে জাতিকে বঞ্চিত করে জাতির অপূরণীয় অমঙ্গল করেছেন। এটাই হচ্ছে উভয় বাংলার প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রাপ্ত ফলাফল।

১৯৭২ সালের ৩১ শে অক্টোবর এক সভায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল নামে নতুন একটা রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়। তার নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহাম্মদ, মেজর জলিল, আসম রব, মনিরুল ইসলাম, শাহাজান সিরাজ, বিধানকৃষ্ণ সেন, নূরে আলম জিকু, মোশারফ হোসেন খন্দকার  আব্দুল মালেক, সুলতানা উদ্দীন আহাম্মদ, এম.এ. আউয়াল, রহমত আলী, শরিফ নূরুল আম্বিয়া ও হাসানুল হক ইনু। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার ৯ মাস ২০ দিনের মাথায় আওয়ামী লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এরা দল গঠন করেছিলেন। দল গঠনের অধিকার সবারই থাকে। তারাও দল গঠন করেছিলেন কিন্তু গণ-বাহিনী গঠন করে এমপি হত্যা করে, পাটের গুদামে অহরহ আগুন দিয়ে যে ক্ষতি তারা সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত একটা জাতির করেছিলেন তার নজীর বিশ্ব ইতিহাসে বিরল।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের জন্য মূলত তারাও দায়ী। তারা রাজনৈতিক হত্যকাণ্ডের হাট বসিয়ে ছিলো। নির্মোহ ইতিহাস যে দিন রচিত হবে সেদিনে তাদের ভূমিকা পলাশীর দলত্যাগী সেনাবাহিনীর চেয়ে অধিক উজ্জ্বল হবে বলে মনে হয় না। দলটা এখনও জীবিত তবে বহুদা বিভক্ত হয়ে এখনও তারা জড়াজীর্ণ অবস্থায় টিকে আছে। তবে তাদের রাজনীতির আর কোনও আবেদন নেই। জাতির তারা অপূরণীয় ক্ষতি করেছিলো।
২০০৫ সাল থেকে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমের জন্য কিছু সংখ্যক লোক সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছেন। শায়েখ আব্দুর রহমান আর সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই তাদের মাঝে অগ্রগণ্য। তারা একই সাথে সমগ্র বাংলাদেশে একই সময়ে বোমা ফাটিয়ে তাদের অস্থিত্ব জানান দিয়েছিলো। সে থেকে ইসলামপন্থীদের সন্ত্রাস অব্যাহত রয়েছে। তাদের মাঝে এখনও পর্যন্ত কোনও জ্ঞানীগুণী আলেমের সংশ্রব পাওয়া যাইনি। শুধু কিছু অর্ধশিক্ষিত যুবকেই ধর্মের নামে উত্তেজিত করে তারা মাঠে ছেড়েছে আর তারাই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে।

কিছুদিন তারা ব্লগার হত্যা করেছে। কিছুদিন তারা উলঙ্গ ফকির হত্যা করেছে, লালনপন্থী সাধুও হত্যা করেছে। সন্ত্রাসের ধরন দেখে বোঝা যায় না তারা কী খাঁটি ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে না রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম কায়েমের চেষ্টা করছে। আবার দেখা গেছে তারা গুলশানের রেস্তোরায় ১৭ জন বিদেশিকে খুবই নির্মমভাবে গলা কেটে হত্যা করেছে। সিলেটে মুফতি হান্নানের দল ব্রিটিশ হাই কমিশনারকে গ্রেনেড মেরে হত্যার চেষ্টা করেছিলো। গুলশানে এক ইতালিয়ান নাগরিককে আর রংপুরে এক জাপানি নাগরিককে তারা গুলি করে হত্যা করেছে। হত্যার ধরন দেখে বোঝা যায় যে কোনও জ্ঞানী আলেম এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে নেই। কোনও তত্ত্বজ্ঞানী আলেম কখনও নির্বিচারে মানুষ হত্যার হুকুম দিতে পারে না।

যেখানে খোদাতালা মানবতাকে মানুষের শ্রেষ্ঠগুণ বলেছেন সেখানে কোনও হক্কানি আলেম তো অমানুষ হওয়ার পরামর্শ কাউকেও নিশ্চয়ই দেবেন না। সন্ত্রাসীরা বিদেশি হত্যা করে অন্যধর্মের পুরোহিত হত্যা করে মুসলিম উম্মাকে বিদেশিদের কাছে ঘৃণার পাত্র করে তুলছে। আর যে সব দেশে মুসলমান সংখ্যালঘু সে সবদেশে মুসলমানের জান-মাল নিরাপত্তাহীন করে তুলছে। মুসলিম উম্মা বিরান হয়ে গেলে ধর্ম টিকে থাকবে কাকে নিয়ে।

মধ্যপ্রাচ্যে বাগদাদী খেলাফতের ঘোষণা দিয়েছে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে। ষড়যন্ত্র হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে বিধ্বস্ত করে ইসরায়েলকে শক্তিশালী করার ষড়যন্ত্র। ইসরায়েল বলে ভূমধ্যসাগর থেকে প্যালেস্টাইন হয়ে সম্পূর্ণ সিরিয়া ও জর্দান হচ্ছে প্রমিজড ল্যান্ড। এ সম্পূর্ণ ভূখণ্ডটি প্রদানের জন্য আল্লাহ নাকি ইহুদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এখন তারা সে প্রতিশ্রুত ভূখণ্ডটি লাভ করার জন্য মুসলমানদের মাঝে আত্ম-কলহ সৃষ্টি করে দিয়েছে যাতে মুসলিম শক্তি দুর্বল হয়ে যায়। এখন তো ইহুদিরা মহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় আছে। এখন সব মুসলমান যুবকেরা আবেগে তাড়িত না হয়ে সম্পূর্ণ পরিস্থিতিটা উপলব্ধি করে পুনঃসিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। মুসলমানদের হুস ফিরে না আসলে বহু লাঞ্ছনা তাদের জন্য অপেক্ষা করবে।

রসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন- ‘খেলাফত ত্রিশ বছর’। হযরত আবু বক্কর ছিদ্দিক (রা.) থেকে হযরত আলী (রা.) হয়ে হযরত হাসানের (রা.) খেলাফতের দাবি ত্যাগের দিন পর্যন্ত ত্রিশ বছর হয়ে যায়। বাগদাদীর খেলাফত তো ইসলামের খেলাফত নয়। ইসলামের খেলাফত পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হবে হযরত ঈসার আবির্ভাবের পর। সুতরাং বলা যায় বাগদাদীর খেলাফতের বৈধতা নেই। সুতরাং বিপদগামী যুবকদেরকে আহ্বান জানাবো তারা যেন ইসলাম সম্পর্কে সঠিক লেখাপড়া করে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ত্যাগ করে।

লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ