ইসলাম একটি ধর্ম। এটি হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, নূরুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম বা অন্য কোনও ইসলাম নামধারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জমিদারি নয়। ইসলাম একটা বিশ্বাস। সারা বিশ্বব্যাপী এ ধর্মের ১৫০ কোটি অনুসারী রয়েছে। এ ধর্মের অনুসারীরা ৪৫টি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বসবাস করে আসছে।
সারা বিশ্বে দুই শতাংশ লোক ধর্মহীন আছে কিনা সন্দেহ। বিশ্ব সভ্যতা ক্রমবিবর্তনে একবিংশ শতাব্দীতে এসে পৌঁছেছে। এতে নানা ধর্মের অবদান নগন্য নয়। আমাদের দেশে কিছু বুদ্ধিজীবী, কিছু কলাম লেখক ধর্মের কোনও বিষয় কোনোখানে দেখলে আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। কোনও নির্মম কাজ দেখলে ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’ বলে আখ্যায়িত করেন। এটা তাদের কু-অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
মধ্যযুগের বর্বরতা মানে তারা ইসলামের প্রারম্ভিক কালকে বুঝাতে চায়। এতে সাধারণ ধর্মকর্ম করা মুসলমানরা মনোবেদনায় ভুগেন। উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী আরও উগ্রতা প্রকাশ করে। এসব বিষয় মন্তব্যকারীরা বিবেচনা আনতে চান না।
পাঠ্যপুস্তকে সরকার ধর্ম সম্পর্কে কিছু কথাবার্তা লিখেছে। এক নামকরা কলাম লেখক ও অধ্যাপক একটি জাতীয় দৈনিকে ২১ মার্চ লেখা তার কলামে লিখেছেন, ‘সরকার সম্ভবত নিজ অভিলাষ চরিতার্থ করতে হেফাজতিদের জিতিয়ে দিল, কিন্তু বুঝতে পারলে সিন্দাবাদের বুড়োকে কাঁধে তুলে নেওয়া হলো। অদৃশ্য সুতায় গাটছাড়া বাঁধা তাই এর সূত্রধরে জঙ্গিরা আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল বলে’।
ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি আর কনফুরিয়াস সহ সব ধর্মের ঘটনাবৃত্তান্ত ইতিহাসের দুই তৃতীয়াংশ ব্যাপী লিখিত এবং এটা মানব সভ্যতার একটা জরুরি অংশ। তাকে বিস্মৃত হয়ে মানব সভ্যতার পক্ষে এগিয়ে যাওয়া কি সম্ভব? ইতিহাসের দুই তৃতীয়াংশ বাদ দিলে ইতিহাসের আর অবশিষ্ট থাকেই বা কী? এক সময় সমগ্র ইউরোপ খ্রিস্ট ধর্মের প্রভাবে ছিল। গির্জার কর্তৃত্বকে অস্বীকার করার উপায় ছিল না। যখন ক্যাথলিকদের প্রধান গির্জা ছিল ক্যানোসাতে তখন পোপ এর হুকুম পালন করতে গিয়ে সম্রাট নগ্নপায়ে হেঁটে ক্যানোসা গিয়েছিলেন। খ্রিস্টধর্ম অনুরূপ আনুগত্য কোনও শাসক থেকে প্রত্যাশা করে না। গির্জা তাদের কায়েমী স্বার্থ প্রতিষ্ঠায় সফল কাম হয়েছিল ইউরোপে। তাই তারা সম্রাটকে পর্যন্ত পরোয়া করতো না।
গির্জা ভূস্বামীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলো। অবশ্য তা করেছিলো ধর্মের নামে। যে কারণে কার্ল মার্কস ধর্মকে আফিম বলেছিলেন। এটিতো প্রকৃত খ্রিস্ট ধর্ম নয়। যে কারণে সে ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা পুরোহিতদের পক্ষে সম্ভবও হয়নি। হিন্দুদের মাঝেও ব্রাহ্মণদের কায়েমী স্বার্থ ধর্মকে বিভ্রান্ত করেছে। ইসলামের মাঝেও যে তেমন কিছু নেই তা নয়। পুরোহিত-মোল্লার আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ধর্মপরিত্যাগ করা তো কোনও সুবিবেচনার কাজ নয়। সুতরাং আমাদের সুধি সমাজ খুবই চিন্তাভাবনা করে অন্যের বিশ্বাস নিয়ে কথাবার্তা লেখা উচিৎ।
যারা বলছেন সরকার হেফাজতীদের জিতিয়ে দেওয়াতে নাকি বর্তমানে আবার ইসলামি জঙ্গিরা মাথাছাড়া দিয়ে উঠেছে তাদের মূল্যায়নটা সঠিক নয়।
কারণ আওয়ামী লীগ কখনও ধর্মীয় রাজনীতি করেনি। আবার ধর্মের বিরুদ্ধেও তারা কখনও অবস্থান নেয়নি। প্রতিটি নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ম্যানিফেস্টো ঘোষণা করে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান থেকে শেখ হাসিনা পর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে প্রত্যেক নির্বাচনেই তারা জাতির কাছে ম্যানিফেস্টো প্রদান করেছে। প্রত্যেক ম্যানোফেস্টোতে তারা জাতিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাশীন হলে কখনও কোরআন ও সুন্নার বিরুদ্ধে কোনও আইন প্রণয়ন করবে না এবং তা তারা কখনও করেনি।
আওয়ামী লীগ শিক্ষকতা করে না, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতি করে। ভোটে জিতে ক্ষমতায় যেতে হয়। সুতরাং আওয়ামী লীগ কখনও ভোটারদের পপুলার সেন্টিমেন্টের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে না। মনে রাখা প্রয়োজন এদেশের মানুষ সেক্যুলার শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকাটাকে পছন্দ করে। সে কারণে ধর্ম নিয়ে যারা রাজনীতি করে তারা তেমন কোনও সুবিধা করতে পারে না।
জামায়াত ইসলামী একবার এককভাবে তিনশত আসনে নির্বাচন করেছিলো। আসন পেয়েছিলো মাত্র ২টি। তাই বলে কিন্তু ধর্ম নিয়ে খেলতামাশা করাটাকে দেশের মানুষ পছন্দ করে না। আওয়ামী ঘরণার বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিক কর্মীদেরকে এ বিষয়টা উপলব্ধি করা জরুরি। দুই একটা ধর্মীয় নীতিকথা স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে থাকলে স্কুলগুলো মাদ্রাসা হয়ে যাবে না। উগ্রতা, ভ্রান্তি, পশ্চাৎপদতা কিছু থেকে গেলে আমরা সেটাকে বদলানোর পরামর্শ দিতে পারি। বদলানো উচিত। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য কর্মে শত শত গীতা-পুরানের শ্লোক উদ্ধৃত করা হয়েছে। এটি কোনও মুসলমান পড়লে তার গুণাহ হবে না, জাত যাবে না।
সমগ্র বিশ্বে একটা উগ্র জাগরণবাদে আক্রান্ত হয়েছে। ন্যাদারল্যান্ড এর নির্বাচনে সবাই মনে করেছিলো উগ্র ধারার দলটি নির্বাচনে জিতবে। তারা তাদের নির্বাচনি ম্যানিফেস্টোতে বলেছিলো ন্যাদারল্যান্ডের সব মসজিদ ভেঙে ফেলবে, মুসলমানদের বিতাড়িত করে দেবে, কোরআনকে বেআইনি গ্রন্থ বলে ঘোষণা করবে। এগুলো কখনও কোনও রাজনৈতিক দলের ম্যানিফেস্টো হতে পারে না? কিন্তু তাই তারা করেছিলো।
আমাদের দেশেও উদ্রবাদীরা তৎপর হয়েছে। এটা পাঠ্যপুস্তকে ধর্মের কয়টা কথা লিপিবদ্ধ করার কারণে নয়, এটা বিশ্ব জাগরণের অংশ হিসেবে দেখা দরকার। এটা এক ধরনের অসুস্থতা। আমাদের মাঝে আমরা যারা সুস্থ আছি তারা এমন কোনও কথা এমন কোনও কাজ করা উচিৎ নয় যাতে অসুস্থ মানুষগুলো ক্রোধান্বিত হয়ে সমাজের ওপর চড়াও হয়ে সমাজের ক্ষতিসাধন করে।
এক প্রফেসর সাহেব বলেছেন হেফাজতী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করায় সন্ত্রাসবাদীরা পুনরায় মাঠে নেমেছে। আবার কিছু মানুষ বলছে সুপ্রিম কোর্টের সামনে গ্রিক মূর্তি বসানোর কারণে নাকি জঙ্গিদের উসকানো হয়েছে। আমার মনে হয় কিছু সত্য যদি থাকে তবে সাধারণ মানুষের কথার মাঝেই রয়েছে। এ মূর্তি অথবা ভাস্কর্যটি বসানোর বিষয়ে সরকার কোনওভাবে কোনও কিছুই জানে না। মধ্যখানে টার্গেট হচ্ছে সরকার। টার্গেট হচ্ছে জনগণ।
শুনেছি সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ূন এ মূর্তি সরানোর ব্যাপারে মত দিয়েছেন। কিন্তু সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার খোকন নাকি সরানোর ব্যাপারে মত দিচ্ছেন না। সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষ এ মূর্তিটা বসিয়ে জাতিকে কী বার্তা দিতে চেয়েছেন জানি না। তবে অনেকেই মূর্তি বসানোর বিষয়টা নিয়ে দুঃখিত হয়েছে। আমরা যারা সাধারণ মানুষের কথা শুনি এবং সাধারণ মানুষের পক্ষে লেখার চেষ্টা করি তারা এ কথাটা উপলব্ধি করেছি। পূর্বেও বলেছি এখনও বলি -আনপ্রোডাক্টিভ একটা বিষয় নিয়ে জাতির মাঝে হানাহানি সৃষ্টি করে লাভ কী?
প্রগতিশীল গোষ্ঠী মনে করবে মূর্তি সরানো হলে হেফাজতীদের কাছে আত্মসমর্পন করার শামীল হবে। দেশের সাধারণ মানুষ মূর্তি সরানোর পক্ষে, এখানে হেফাজতীরা মূখ্য নয়। মূলত বিবেচনায় নিতে হবে সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্টকে। জনপ্রিয় দাবি মেনে নেওয়া সব সময় উত্তম। সে গোষ্ঠীই উত্তম শাসক যারা আনন্দের সঙ্গে সাধারণ মানুষের ইচ্ছার বাস্তবায়ন করে। কিছু পণ্ডিত সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এভাবে চললে নাকি ‘নৌকা আটকে যাবে চরে’। আমার মনে হয় তাদের কথা শুনলে ঘন ঘন চর সৃষ্টি হবে। তখন নৌকার পক্ষে আগানোই সম্ভব হবে না।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক