X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুখের অসুখ

শান্তনু চৌধুরী
২৪ মার্চ ২০১৭, ১১:৩২আপডেট : ২৪ মার্চ ২০১৭, ১৩:১০

শান্তনু চৌধুরী ইউটিউবে রুনা লায়লার কণ্ঠে পুরনো দিনের গান শুনছিলাম। ‘সুখ তুমি কী বড় জানতে ইচ্ছে করে, আমার জানতে ইচ্ছে করে, কিশোরীর মিষ্টি আশা নাকি ষোড়শীর ভালোবাসা?’ গানের মাঝখানে ছেদ পড়লো। একজন ফেসবুকের ইনবক্সে নিউজ লিংক পাঠিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সুখী দেশ নাকি পাকিস্তান! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা কম। তাই অনলাইনগুলো দেখলাম। না! আমার চোখও ঠিক আছে, নিউজও ঠিক আছে। জাতিসংঘ ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক সুখ দিবস উপলক্ষে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। রিপোর্টটিতে জাতিসংঘ বলছে, নরওয়ে এখন বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ। তালিকার শেষ ১৫৫তম স্থানে, অর্থাৎ বিশ্বের সবচেয়ে অসুখী দেশ হচ্ছে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক। এই রিপোর্ট অনুযায়ী, নরওয়ের সঙ্গে ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও ফিনল্যান্ড তালিকার প্রথম পাঁচটি স্থানে রয়েছে।
এবার আসা যাক আমাদের এলাকা দক্ষিণ এশিয়ায়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ৮০তম স্থানে থেকে সবচেয়ে সুখী। বাংলাদেশ ১১০ ও ভারত যথাক্রমে ১২২তম স্থানে। সবচেয়ে অসুখী ১৪১তম স্থানে থাকা আফগানিস্তান। বাংলাদেশ রয়েছে আগের অবস্থানে। জানা গেছে, এই বিশ্লেষণ দেশের অর্থনৈতিক শক্তি, সামাজিক নিরাপত্তা, গড় আয়ু, ব্যক্তি স্বাধীনতা, দুর্নীতি নিয়ে ধারণা থেকে পাওয়া। জাতিসংঘ এই রিপোর্ট পাঁচ বছর ধরে প্রকাশ করে আসছে। প্রতি বছরই উত্তর ইউরোপের নরডিক দেশগুলো শীর্ষ অবস্থানগুলো দখল করেছে। জাতিসংঘের বিশ্ব সুখ রিপোর্ট ‘আপেক্ষিক সুখ’ মেপে থাকে। মানুষ কত সুখে আছে ও কেন। আমার ধারণা, আমার মতো অনেকে এই রিপোর্টটি সেদিন অনলাইনে বা পরদিন পত্রিকার পাতায় বারবার পড়েছেন। পড়ে বিশ্বাস করতে চেয়েছেন এই জরিপ ঠিক কিনা। যারা পাকিস্তান নামক একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্রকে যুগযুগ ধরে চেনেন তাদের ক্ষেত্রে সেটি আরও বেশি প্রযোজ্য। যারা ক্রমাগত মিথ্যকথা বলার লোক, যারা এদেশের গণহত্যা স্বাধীনতা নিয়ে মিথ্যাচার করে, এখনও এদেশের রাজাকারদের জন্য চোখের পানি ফেলে একই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয় তেমনি একটি দেশ সুখের তালিকায় এক নম্বরে থাকবে, সেটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। এবং সত্যিকার অর্থে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই নিয়ে তুলোধুনো চলছে। যদিও পাকিস্তানপন্থীরা এটির পক্ষে অবস্থান নিয়ে পোস্ট দিচ্ছে ফেসবুকে, টুইটও করছে। কিন্তু প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমগুলোর আন্তর্জাতিক খবরে পাকিস্তানের সন্ত্রাস যে পরিমাণ জায়গা দখল করে থাকে অন্য কোনও দেশ তেমন নয়। এমনও হয়েছে, প্রতিদিন দশ-বিশ জন মারা যাওয়ার ঘটনা পাকিস্তানের পত্রিকা ছাড়া আর কোথাও স্থান পাচ্ছে না। কাজেই দু’নম্বরিতে সেরা পাকিস্তান জাতিসংঘের এই রিপোর্টের পেছনে কোনও দু’নম্বরি করেছে কিনা, সেই প্রশ্নও ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
সাম্প্রতিক খবরগুলোর বিশ্লেষণের দিকে গেলেও বোঝা যায়, দেশটি কতটা নাজুক অবস্থায় রয়েছে। পাকিস্তানে একটি মাজারে জঙ্গি হামলায় সম্প্রতি নিহত হয় অন্তত আশি জন। আবার এই হামলার জবাবে চালানো অভিযানে নিহত হয় আরও ৩৫ জন। জঙ্গি সংগঠন ইসলামি স্টেট বলেছে সিন্ধু প্রদেশের ওই মাজারে তারাই হামলা চালিয়েছে। এটা বড় ধরনের হামলা হলেও প্রতিদিন কোনও না কোনও মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে জুম্মাবার। একমাসের মধ্যে যেসব উল্লেখযোগ্য হামলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে, লাহোরে বিক্ষোভ সমাবেশ লক্ষ করে আত্মঘাতী হামলা, কোয়েটাতে বোমা নিক্ষেপ, মহমান্দতে সরকারি কার্যালয়ে আত্মঘাতী হামলা, পেশোয়ারে সাইকেল আরোহী বোমারুর সরকারি গাড়িতে ধাক্কা, সেহওয়ানে সুফি মাজারে হামলা, আওয়ারানে সামরিক যানবাহনের ওপর বিস্ফোরক হামলা।
যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ ডেটাবেইস (জিটিডি) যে তথ্য দিয়েছে তা প্রকাশ করেছে পাকিস্তানের পত্রিকা ডন। এতে দেখা যায়, পাকিস্তানের পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ। তাদের মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলায় প্রাণহানির সংখ্যা বিবেচনা করলে বিশ্বে পাকিস্তানের অবস্থান এক নম্বরে। একইসঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলার সংখ্যা বিবেচনায় নিলেও পাকিস্তান সবার ওপরে। জিটিডি থেকে গত চার দশকে দক্ষিণ এশিয়ার পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিলে আরেকটি আতঙ্কজনক চিত্র পাওয়া যায়। এই সময়ে এ অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এক হাজার ৪৩৬টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশই ঘটেছে পাকিস্তানে। এসব পরিসংখ্যানই বলে দেয়, পাকিস্তানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তার অবস্থা কতটা নাজুক। তারা আবার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সুযোগ পেলেই বিষোদগার করে।
এদিকে, গেলো সপ্তাহে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ধর্মীয় নেতাদের সহযোগিতা চেয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। ইসলামের অপব্যাখ্যা দেয় এবং সহিংসতায় উস্কানি তৈরি করে এমন যেকোনও ধরনের উগ্রপন্থী ফতোয়া বর্জনের জন্য আলেমদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এছাড়া চলতি সপ্তাহের শুরুতেই নওয়াজ শরিফ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মনিন্দা বন্ধে তার সমর্থনের কথা জানান। তিনি টুইট করেন, ‘ধর্মনিন্দা একটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।’ এবং এ ব্যাপারে ফেসবুক কর্তৃপক্ষেরও সহায়তা চাওয়া হয়েছে। অবশ্য আমরাও চেয়ে থাকি বিভিন্ন সময়ে। যদিও ফেসবুক তাদের নীতিমালা অনুযায়ী সেসব আমলে নেন না। সম্প্রতি পাকিস্তানের পাঁচজন মুক্তমনা ব্লগার এবং চরমপন্থী গায়েব হন। তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ধর্মনিন্দা প্রচারের অভিযোগ রয়েছে বলে জানানো হয়।
কিছুদিন আগে আরও একটি বিষয়ে পাকিস্তান প্রথম স্থান অধিকার করেছে। গুগলের তথ্য-উপাত্তে বেরিয়ে এসেছে পর্নো সার্চের তালিকায় সবচেয়ে উপরের ৮টি দেশের ৬টিই মুসলিম রাষ্ট্র। তালিকায় যে ৬টি মুসলিম দেশ রয়েছে, তাদের মাঝে প্রথম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান। আর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মিসর। এরপর একে একে ইরান, মরক্কো, সৌদি আরব ও তুরস্কের অবস্থান। আর এরপর আছে সিরিয়া, ইরাক ও লেবানন। এদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে কোন শব্দ সার্চ দিয়ে সবচেয়ে বেশি পর্নো খোঁজা হয়, সেটাও প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে পাকিস্তান থেকে সবচেয়ে বেশি যেসব পর্নো সার্চ করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে, কুকুর, গাধা, বিড়াল ও সাপের সেক্স!
এই হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সুখী দেশ পাকিস্তানের চরিত্র। দশ বছর ধরে সেখানে কোনও দেশ ভয়ে ক্রিকেট খেলতে যায় না, তাও সে দেশ নাকি সুখী দেশ! নিরাপত্তার জন্য সার্কসহ বড় ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয় না, তাও সে দেশ সুখী! প্রতি জুম্মাবারে মসজিদে বোমা হামলা হয়। হাসপাতালে, স্কুলে, বাজারে বোমা হামলায় নিয়মিত শত শত মানুষ মারা যায়, তাও তারা সুখী। বিশ্বের প্রধান জঙ্গি সংগঠন আল কায়দার আস্তানা সেখানে, তাও সেটি সুখী দেশ। সেজন্যই দুশ্চিন্তা হয়, তারা কি নিজের দেশের অন্যায় অবিচার আর অনাচারকে জীবনের অংশ নিয়ে সুখী ভেবে বসে আছে। ‘সুখী’ কথাটা মনে হতেই শেলফে থাকা বাট্রান্ড রাসেলের ‘সুখ’ বইটার অনুবাদ টেনে নিলাম। প্রায় তিনশো পৃষ্টার সেই বইয়ে লেখা রয়েছে, ‘সুখ দু’প্রকার, শারীরিক ও মানসিক সুখ। শারীরিক সুখের অংশীদার সবাই হতে পারে, কিন্তু মানসিক সুখের অংশীদার হতে পারে কেবল শিক্ষিত সম্প্রদায়। সুখের সাধনা অনেক কঠিন। সবকিছু পেতে চাইলে সুখ পাওয়া যায় না। সুখ পেতে হলে সবকিছু কুকুরের মতো কামড়াকামড়ি করে নয়, কাকের মতো সবাই মিলে চাইলে পাওয়া যায়।’ পাকিস্তানিরা কি সবাই মিলে এই সন্ত্রাস চালাচ্ছে দেশটাতে। সে কারণে তারা সুখে আছে। নাকি ওই যে পর্নো ব্রাউজিং থেকেই আসে সব সুখ।
ইউটিউব চলছিল, সাউন্ড মিউট করা। আমি আবার শব্দ হলে লিখে সুখ পাই না। দেখলাম রুনা লায়লার গান পেরিয়ে মান্না দে’র গান শুরু হয়েছে। ‘সবাইতো সুখী হতে চায়, কেউ সুখী হয়, কেউ হয় না।’ এর পরের দু’টি লাইন প্যারোডি করে বলা যায়, ‘জানি না লোকে যা বলে সত্যি কিনা, জাতিসংঘের রিপোর্টটি ভুয়া আর গাঁজাখোরি কিনা!’

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিএনপির ‘ইন্ডিয়া-আউট’ ক্যাম্পেইন: বাস্তবতা ও সম্ভাব্য ফলাফল
বিএনপির ‘ইন্ডিয়া-আউট’ ক্যাম্পেইন: বাস্তবতা ও সম্ভাব্য ফলাফল
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র আধুনিকায়নে কাজ করবে জাইকা ও বিএফডিসি
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র আধুনিকায়নে কাজ করবে জাইকা ও বিএফডিসি
ট্রেনের ৪৫ হাজার টিকিট কিনতে দেড় কোটির বেশি হিট
ট্রেনের ৪৫ হাজার টিকিট কিনতে দেড় কোটির বেশি হিট
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ