X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাসের পাতায় গণহত্যা

তুষার আবদুল্লাহ
২৫ মার্চ ২০১৭, ১৩:৪৬আপডেট : ২৫ মার্চ ২০১৭, ১৩:৫০

তুষার আবদুল্লাহ ইতিহাসে মানুষের অধিকার আছে। মানুষ ইতিহাসের কাছে দাবি জানাতে পারে। যেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মানুষ এগিয়ে যায়, সেই পরিভ্রমণ ইতিহাসে ঠাঁই পাবে, ইতিহাসের কাছে মানুষের এই দাবি নিরন্তর। পৃথিবীতে রাষ্ট্র-জাতি-গোষ্ঠীর যতো ইতিহাস লেখা হয়েছে, মানুষকে কোনও ইতিহাসই সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কোনও ইতিহাসই প্রশ্নের বাইরে নেই। ইতিহাস যতো প্রাচীন বা আনকোরাই হোক না কেন তাকে নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে, চলবেই। মানুষের যে আদি দাবি ইতিহাসের কাছে, নির্মোহ ইতিহাস লিখবার, সেই দাবিটি উচ্চারিত হয়েছে নানা প্রান্তে। ঐতিহাসিক কিংবা অভিজ্ঞতা থেকে যারা লিখেছেন সময়-কালকে তাদের দিক থেকেও নির্মোহ রচনার দাবিও আছে। কিন্তু পর্যালোচনায় বা কাল পরিক্রমায় সেই রচনার সাংর্ঘষিক বা তথ্য-উপাত্তের গড়মিলও মিলেছে নানা সময়ে। তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে সত্যের কাছাকাছি যাওয়ার প্রয়াস রাখার স্বাক্ষর রেখেছে কোন দলিল।
যদি যুদ্ধের ইতিহাসের কথা বলি। তাহলে যুদ্ধকে এক রৈখিকভাবে দেখে লেখা ইতিহাস কম নয়। যুদ্ধের পটভূমি, যেখান থেকে একটি জাতি বা জনপদ যুদ্ধের পথে যাত্রা করেছিল বা ক্রমশ যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠছিল সেই ঘটনা, উপাত্তকে যদি ইতিহাসে স্থান না দেওয়া হয়, তাহলে তো সেটি অপূর্ণতা এবং নির্মোহ নয় এমন অভিযোগে অভিযুক্ত হবেই। ইতিহাস নিয়ে ষড়যন্ত্রেও চলেছে পৃথিবীর সকল সভ্যতাতেই। এমন কোনও জনপদ, জাতি-গোষ্ঠী খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার ইতিহাস নিয়ে ষড়যন্ত্রের নকশা তৈরি হয়নি। কেবল নকশা তৈরিই নয়, সেই নকশা বাস্তবায়নেও তৎপর ছিল ইতিহাসের ভিলেন চরিত্রগুলো। বা প্রতিপক্ষ শক্তি। যে অনিবার্যতার মধ্য দিয়ে ইতিহাস তার মাইলফলকের দিকে এগিয়ে গেছে, সেখানে নানা রঙ ও উপকরণ দিয়ে সত্যকে আড়ালের একটি চেষ্টা বরাবরই প্রতিপক্ষের ছিল এবং আছে।
বাংলাদেশের যে মুক্তির ইতিহাস সেই মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু থেকেই ছিল। এখনও আছে। ষড়যন্ত্রের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ২৫ মার্চ রাত থেকে শুরু করে আত্মসমর্পণের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সারাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছিল, সেই সত্যকে আড়াল করা। পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস্য গণহত্যা চালানো হয়েছিল এই জনপদে। বাংলাদেশের জনপদ জুড়ে সেই গণহত্যার সাক্ষ্য বহণ করছে শত শত বধ্যভূমি। একাত্তর থেকে নিকট অতীত পর্যন্ত এক প্রকার ষড়যন্ত্র ছিল এই বধ্যভূমিগুলোকে লুকিয়ে রাখার। কিন্তু সেই ষড়যন্ত্রে তারা সফল হয়নি। সাধারণ মানুষই নিজ নিজ এলাকার লুকানো, নিখোঁজ বধ্যভূমিগুলোকে একের পর এক উদ্ধার করে চলেছে। প্রতিটি বধ্যভূমিতে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষকে কত নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার দুঃসহ স্মৃতি। সারাদেশের ৯৪৬টি বধ্যভূমির বেশিরভাগই অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কোন কোনটি দখলদারদের থাবার মুখে। প্রতিপক্ষের মতলব হচ্ছে, বধ্যভূমিগুলোকে যদি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যায়, তাহলে আগামী প্রজন্মের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সরিয়ে দেওয়া যাবে। গণহত্যার নৃশংসতার সত্যকেও মাটিচাপ দিয়ে দেওয়া যাবে। প্রতিপক্ষের এই মতলবকে পরাজিত করতে হলে বধ্যভূমি গুলোকে সংরক্ষণ করতে হবে। প্রতিটি বধ্যভূমির ইতিহাস আবিষ্কার করে নতুন প্রজন্মের কাছে মেলে ধরতে হবে ইতিহাসের নির্মোহ সত্যটি।

বাংলাদেশের ওপর অপারেশন সার্চ লাইটের নামে যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, সেই দৃশ্যপট আড়ালের চেষ্টা হিসেবে জাতিকে বিজয় উদযাপনে মাতিয়ে রাখার এক ষড়যন্ত্রও ছিল। আড়ালে রাখা হচ্ছিল এই বিজয় কিভাবে এসেছে, এই বিজয়ের লাল রঙের পেছনের কালো রঙকে। লাল মোড়কে ঢেকে রাখা হয়েছিল গণহত্যা নামক শব্দটিকে। জাতি হিসেবে আমরা স্বাধীন এবং বিজয় শব্দ নিয়ে মাতোয়ারা ছিলাম। ডুবে ছিলাম বিজয়ের ঢেউয়ে। ছিচল্লিশ বছরে আমরা গণহত্যার ইতিহাস পাঠের বদলে বিজয়ের গল্পই পাঠ করেছি বেশি। ফলে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বিজয় উদযাপনে গণহত্যার দীর্ঘশ্বাস, ক্রন্দনের কোনও স্মৃতি জড়িয়ে না থাকাতে, সেখানে স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন দেশের প্রতি আত্মত্যাগকারীদের প্রতি কোনও শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতাবোধের সৌরভ থাকে না। মুক্তিযুদ্ধ উত্তর প্রজন্মের কাছেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখনও অসম্পূর্ণভাবেই উপস্থাপিত হচ্ছে।

গণহত্যা দিবস পালনের অনিবার্যতা শুধু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের প্রয়াসের মধ্যেই সীমিত নয়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা যে বিশ্বের আলোচিত গণহত্যাগুলোর বিচারে কোনও অংশেই কম নির্মম, নিশৃংস ছিল না, তার একটা উপস্থাপনতো প্রয়োজন আছেই। সেখানে ঢাকাসহ সারাদেশে যে হত্যাযজ্ঞ চলেছে, সেই খবরটি ৪৬ বছর পরে হলেও বিশ্বের কাছে পৌঁছানো। এর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হচ্ছে ইতিহাসের অপ্রকাশিত পাতাটি উন্মোচিত করা নতুন প্রজন্মের কাছে। গণহত্যা দিবস ২৫ মার্চ পালনের মধ্য দিয়ে তারা ২৬ মার্চের স্বাধিনতা দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস উদযাপনের অহংবোধকে স্পর্শ করতে পারবে।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ