X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিভীষিকাময় রাত ২৫ মার্চ: গণহত্যা দিবস ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

তৌহীদ রেজা নূর
২৫ মার্চ ২০১৭, ১৪:৪১আপডেট : ২৫ মার্চ ২০১৭, ১৪:৪৬

তৌহীদ রেজা নূর এ বছরের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ নামের ছোট্ট দেশটির বয়স হবে ৪৬ বছর। সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে এ বছর থেকে ২৫ মার্চ তারিখটি গণহত্যা দিবস হিসেবে জাতীয়ভাবে পালিত হবে। আমরা স্বাধীনতা লাভ করার প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে এ ধরনের একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এলো। এই ঘোষণা শুধু বাংলাদেশের নাগরিকের জন্য নয়, বিশ্ব মানবতার জন্য গুরুত্ব বহন করে।
পৃথিবীর কোলে এই দেশের স্থান করে নিতে অপরিমেয় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে পুরো জাতিকে। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের তিক্ততম, বর্বরতম অধ্যায় ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। এক বিশাল, সার্বভৌম দেশ ভারতকে মাঝে রেখে পাকিস্তানের দুই অংশ (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান)-এর অবস্থান ছিল ভৌগলিকভাবে বাস্তবতা-বিবর্জিত। তবে এর চাইতেও বড় অন্তরায় ছিল শাসক শ্রেণির সাম্প্রদায়িক, বর্বর মানসিকতা। পাকিস্তান সৃষ্টির সময় বাঙালি নেতৃত্ব ও জনগোষ্ঠীর ইতিবাচক ভূমিকা থাকা স্বত্ত্বেও এই নতুন রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি (অবাঙালি) শাসকবর্গের মানসিকতায় ভয়ানক বাঙালি-বিদ্বেষ কার্যকর ছিল। ফলে, নতুন রাষ্ট্র জন্মের অব্যবহিত পর থেকেই বাঙালি-বিরোধী নানা তৎপরতা তদানীন্তন পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ক্রমশই অস্থির থেকে অস্থিরতর করে তুলেছে। শাসক শ্রেণির বাঙালি-বিরোধী মানসিকতা এত তীব্র ছিল যে ‘বাঙালি’ নামের জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্র তৈরির শুরু থেকেই নানা ছলে বঞ্চিত করেছে। শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিকভাবেও বঞ্চিত করেছে। প্রকৃতপক্ষে, তারা আমাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় মেনে নিতে পারেনি। বাঙালি জাতির আচার-আচরণ-ভাষা-সংস্কৃতি সব কিছুতেই তারা ‘হিন্দুয়ানি’র ছোঁয়া খুঁজে পেয়েছে, এবং ‘বাঙালিত্ব’ আর ‘হিন্দুত্ব’ সমার্থক জ্ঞান করে নিজেদের খাঁটি (‘সাচ্চা’) মুসলমান হিসেবে ভাবতে চেয়েছে। ‘কুজাত’ বাঙালিদের ক্ষমতায়ন হবে তা তারা কখনও কল্পনায়ও আনেনি, বরং যারপরনাই ঘৃণা ভরে উর্দি শাসনের আওতায় তারা সময়ের সাথে সাথে একের পর এক ‘ব্যবস্থা’ আরোপ করেছে যেন এই ‘কুলাঙ্গার’ জাতি কোনভাবেই মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।
কিন্তু ওদের অপশাসনের বাঁধন যতই শক্ত হয়েছে, ততই এ অঞ্চলের মানুষ একাট্টা হয়েছে সে নিগড় ছিন্ন করতে। এবং পশ্চিম পাকিস্তানি শাসককূল ও এই অঞ্চলে তাদের তাবেদাররা যতই সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে কলূষিত করতে চেয়েছে আমাদের সহজ বিকাশের সামগ্রিক পরিবেশ, ততই এ অঞ্চলের মানুষেরা তাদের ধর্ম পরিচয় দূরে সরিয়ে পরিচয় খুঁজেছে বাঙালিত্বে। বাঙালির এই ক্রম জাগরণ শহর থেকে ক্রমশই গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, এবং এই জাগৃতি এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয় যে  ছাত্র-জনতা ১৯৬৯ সালে ভিসুভিয়াসের মতো ফুঁসে ওঠে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অন্তরীণ শেখ মুজিবকে জেল থেকে মুক্ত করে আনে। মাত্রাতিরিক্ত ভাবাবেগের বশবর্তী হয়ে গণ মানুষ শেখ মুজিবের প্রতি এই ভালোবাসা দেখায়নি, বরং অসম সাহসিকতা, জনগণের প্রতি অসীম দরদী ও গণ মানুষের অধিকারের প্রশ্নে আপোসহীন নেতা শেখ মুজিব জয় করেছিলেন মুক্তিকামী সকল মানুষের হৃদয়, আর তারই প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করেছে জনতা। তাই তো ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে শহর-বন্দর-নগর-গ্রামের গণ মানুষ তাঁদের প্রত্যক্ষ ভোটে ভূমি-ধস জয় এনে দেয় আওয়ামী লীগের ঘরে, আর জাতির ত্রাতা হিসেবে নির্বাচিত করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে। অবাঙালি শাসকগোষ্ঠীর মন নির্বাচনের এই ফলাফলের জন্য তৈরি ছিল না মোটেই। বাঙালি নেতৃবর্গের বৈধ পন্থায় ক্ষমতার একেবারে কেন্দ্রে প্রবেশের এই অভূতপূর্ব সুযোগ লাভ ছিল জাত্যাভিমানী অবাঙালি শাসকগোষ্ঠীর জন্য নিদারুণ ধাক্কা। তাই জাগ্রত মুক্তিকামী জনতাকে রুখতে এক ধাপ এগিয়ে এই বর্বর শাসকদল বাঙালি জনগোষ্ঠীকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যা অপারেশন সার্চলাইট নামে পরিচিত। এই অপারেশনের আওতায় তারা বাঙালির ওপর প্রথম আঘাত হানে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জিরো আওয়ারে, যা মূলত: ২৫ মার্চের দিবাগত রাত। প্রকৃতপক্ষে, এ অপারেশন ছিল বাঙালির আন্দোলন চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য যেন বাঙালি আর কখনও ক্ষমতা গ্রহণের এবং ক্ষমতায়িত হওয়ার ‘খোয়াব’ না দেখে। তাই মুক্তিকামী আগুয়ান বাঙালি জনগোষ্ঠীকে খোঁয়াড়-বন্দী করতে পশ্চিম পাকিস্তানিরা অনেক গভীরে যেয়ে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছক কেটেছিল। ঢাকা শহর ও ঢাকা শহরের বাইরের কিছু তালিকাভূক্ত জেলাতে একইসাথে আক্রমণ করার পরিকল্পনা নেয় তারা। উত্তাল মার্চে বাঙালিরা যা কিছু করছিলো – তা সবই করছিলো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। এক্ষেত্রে ঢাকাতে শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেফতার করা ছিল তাদের এ অপারেশনের একটি মূখ্য কাজ। অপারেশন সার্চলাইট চলাকালে দায়িত্বে থাকা পাকিস্তানি অফিসারদের মধ্যে হওয়া ওয়্যারলেস বার্তা থেকে জানা যায় যে তারা শেখ মুজিবকে তাদের সাংকেতিক ভাষায় ‘বুড়ো পাখী’ হিসেবে সম্বোধন করছিল, যাকে খাঁচায় বন্দী করার জন্য তারা সর্বব্যাপী ফাঁদ পেতেছিল। মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত দলিল-দস্তাবেজ ঘেটে সেই বিভীষিকাময় কালরাত্রি তৈরিতে পাকিস্তানি বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং তাদের পলিটিক্যাল গুরুদের দারুণ ভীতিকর ও বর্বর পরিকল্পনা কিছুটা হলেও আঁচ করা যায়।

যেমন এই গণহত্যা করার জন্য যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল তাতে দুটো বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছিল:  

১। আওয়ামী লীগের যে কোনও কর্মকাণ্ড এবং প্রতিক্রিয়াকে দেখা হবে দেশ বিরোধী কাজ হিসেবে এবং যারা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করবে অথবা সামরিক শাসনের বিরোধিতা করবে তাদেরকেও দেশের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

২। যেহেতু, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের মধ্যে অনেকেই ছিল আওয়ামী লীগের সমর্থক, তাই এই সামরিক অভিযান করা হবে অতর্কিতভাবে, চালাকী ও দ্রুততার সাথে, মরীচিকার মতো কিছু বুঝে ওঠার আগেই।।          

এই অপারেশন সার্চ লাইট সফল করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়:

একই সময়ে এবং এক সাথে পুরো পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে আঘাত হানার পরিকল্পনা হয়। এই অপারেশনের সময় যত বেশি সম্ভব রাজনীতিবিদ ও ছাত্রদের গ্রেফতার করার কথা ভাবা হয়। একই সঙ্গে বিদ্রোহী শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদেরও গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত নেয়। সামনের সারির রাজনীতিবিদ ও ছাত্রনেতাদের অবশ্যই যেন আটক করা হয় তার কড়া নির্দেশ ছিল।     

ঢাকাতে এই অপারেশন যেন পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে সে বিষয়ে নির্দেশে জোরারোপ করা হয়েছিল। ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ করার দুঃসাহস কেউ দেখালে তাকে সরাসরি গুলি করা হবে। এই অপারেশনের সময় টেলিযোগাযোগ, বেতার, টেলিভিশন, টেলিপ্রিন্টার সার্ভিস,  ট্রান্সমিটারে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ার স্পষ্ট নির্দেশ পালন করে আক্রমনকারী বাহিনী যাতে কেউ দেশের ভেতরে অথবা বাইরে কী হচ্ছে তার তথ্য আদান-প্রদান করতে না পারে।

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর সদস্যদের নিষ্ক্রিয় করে কড়া নজরে রাখার পাশাপাশি সকল সমরাস্ত্র পশ্চিম পাকিস্তানি ট্রুপের আওতায় রাখা হয়। পাকিস্তান বিমান বাহিনী ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর ক্ষেত্রেও একই নীতি অবলম্বন করা হয়। শহরের মধ্যে অপারেশন চালাবার দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যাস্ত করা হয়েছিল তাদেরকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে নিচের কাজগুলো সম্পন্ন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়:

১। মুজিবের বাড়ির দখল নিয়ে সেখানে যারাই উপস্থিত থাকবে তাদের গ্রেফতার করতে হবে। বাড়ির ওপর যাতে দুর্বৃত্তরা আঘাত হানতে না পারে সেজন্য কড়া পাহারার বন্দোবস্ত করতে হবে।

২। বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ হলগুলো – যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমানে সারজেন্ট জহুরুল হক হল, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিয়াকত হলসহ অন্যান্য হলগুলো ঘিরে ফেলতে হবে।

৩। টেলিফোনের লাইন বন্ধ করে দিতে হবে।

৪। বাঙালিদের যে সকল চিহ্নিত বাড়িতে অস্ত্রশস্ত্র মজুদ রয়েছে বলে খবর রয়েছে – সে বাড়িগুলো শহরের অন্য বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে।  

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা যেমন, রাষ্ট্রপতি ভবন, গভর্নরের বাসভবন, জাতীয় সংসদ সদস্যদের হোস্টেল, বেতার, টেলিভিশন ও টেলিফোন অফিসে বিশেষ পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। রাত দশটার পর কেউ যেন ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাইরে যেতে না পারে সেদিকে কড়া নজর রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। মুজিবের বাড়িতে সফল অপারেশন চালাবার স্বার্থে সামরিক যানবাহন ব্যবহার না করে সাধারণ (সিভিল) গাড়ি ব্যবহার করার নির্দেশ ছিল দায়িত্বপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের প্রতি।   

রাতের আঁধারে সময় ধরে কিভাবে আক্রমণ করা হবে তার একটি পরিষ্কার নির্দেশনা ছিল। এই অপারেশনের সূচনাক্ষণ ধরা হয়েছিল ঠিক রাত ১টা যখন সর্বপ্রথম শেখ মুজিবর রহমানের বাড়িতে এক প্লাটুন সৈন্য কমান্ডো অভিযান চালাবে। এর ৫ মিনিট আগেই (১২:৫৫ মি.) সকল টেলিযোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ ছিল। অপারেশন শুরু হওয়ার ৫ মিনিট পর (১:০৫ মি.) বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টারসহ নিকটবর্তী সব পুলিশ স্টেশনের দখল নেওয়ার জন্য অন্য সৈন্যদলকে নির্দেশ দেওয়া ছিল।   

এর পরপরই লাউড স্পিকারে জোরালোভাবে সাইরেন বাজিয়ে ‘৩০ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে’ ঘোষণা দেওয়ার নির্দেশ ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে কাউকেই কারফিউ-এর ভেতর চলাফেরার পাশ না দেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। শুধু বাচ্চা প্রসবকারী নারী বা হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে বিবেচনা করা যেতে পারে। একই সাথে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হবে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কোনও পত্রিকা প্রকাশিত হবে না।     

সৈন্যদের প্রতি নির্দেশ ছিল ছাত্রদের হল ঘেরাও করে তল্লাসী করার, সড়কপথ ও নদীপথ অবরোধ করার। প্রতিরোধ যাতে না গড়ে উঠতে পারে সেজন্যে অপারেশনের পরে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সৈন্য-পাহারা নিশ্চিত করা হয়েছিল।

পূর্ব পাকিস্তানের (বাঙালি) সৈন্যদের (সিগন্যাল ও প্রশাসনসহ) নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা ছিল তাদের আরেকটি প্রধান কাজ।  শুধু পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছেই যেন অস্ত্র থাকে সে বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারদের। এই অপারেশনে বাঙালি সৈন্যদের কেন যুক্ত করা হয়নি তা ডিফেন্ড করতে তারা একটি ব্যাখ্যাও দাঁড় করালো এরকম- ‘আমরা পূর্ব পাকিস্তানী সৈন্যদের অস্বস্থির মধ্যে ফেলতে চাইনি। কারণ তাঁদের আমরা এমন কোন কাজে যুক্ত হতে দিতে চাইনি যা তাঁদের জন্য অস্বস্থিকর হতে পারে’।

এই অপারেশন চলাকালে গ্রেফতার করার জন্য তারা একটি তালিকা তৈরি করে যা ছিল এরকম (যাদের ঠিকানা তারা আগে থেকেই জোগাড় করে রেখেছিল) ১) মুজিব ২)নজরুল ইসলাম ৩) তাজুদ্দীন ৪)ওসমানী ৫)সিরাজুল আলম ৬) মান্নান ৭) আতাউর রহমান ৮) অধ্যাপক মুজাফফর ৯) অলি আহাদ ১০) মিসেস মতিয়া চৌধুরী ১১)ব্যারিস্টার মওদুদ ১২)ফাইজুল হক ১৩) তোফায়েল ১৪) এন এ সিদ্দীকি ১৫) রউফ ১৬) মাখন এবং অন্যান্য ছাত্র নেতৃবৃন্দ।

ঢাকার অপারেশন কমান্ড করার দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে আর ঢাকার বাইরের সব এলাকায় অপারেশন চালাবার দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর জেনারেল কে এইচ রাজাকে।

রাও ফরমান আলীর প্রতি নির্দেশ ছিল নিচের কাজগুলো সফলভাবে করার। সেগুলো হচ্ছে-

১) ২নং ও ১০ নং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সব সদস্য, প্রায় ২৫০০ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর সদস্য এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনের প্রায় ২০০০ পুলিশ সদস্যকে নিরস্ত্রীকরণ করা।   

২) সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া; কেন্দ্রীয় ব্যাংক বন্ধ করে রাখা।

৩) তালিকা মিলিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতার করা।

৪) বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো দখলে নেওয়া।

৫) সড়ক, রেল ও নদীপথ বন্ধ করে দেওয়া এবং নদীতে পাহারা বসানো।

তখন আমাদের ছিল ১৯টি জেলা। অপারেশন সার্চ লাইটের রাতে ঢাকাসহ আটটি জেলায় একযোগে আক্রমণ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ঢাকার বাইরের জেলাগুলো হলো - যশোর, খুলনা, রংপুর, সৈয়দপুর, রাজশাহী, কুমিল্লা, ও সিলেট। সব জেলায় আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতার এবং স্থানীয় বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা/সৈন্য, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও পুলিশ সদস্যদের নিরস্ত্রীকরণ ছিল আক্রমণকারীদের ‘কমন টাস্ক’। তবে জেলা-ওয়ারি কিছু বিশেষ টাস্কও ছিল। যেমন- যশোরে বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণে রাখা, খুলনায় কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেফতার করা, রংপুর ও সৈয়দপুরে অপারেশনের সময় গোলা-বারুদ-অস্ত্র বগুড়াতে ডাম্প করা, রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশেষ করে মেডিক্যাল কলেজ নিয়ন্ত্রণে রাখা, কুমিল্লা শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, এবং সিলেটে ব্রিজ দখলে নেওয়া।

এই অপারেশন সুচারুভাবে করতে আরও কিছু কাজ তারা প্রস্তুতিমূলক পর্যায়ে করে রাখার জন্য তালিকাবদ্ধ করেছিল। সেগুলো হলো:  

১) সকল পুলিশ ও রাইফেলসের স্টেশনের অবস্থান জানা

২) শহরের ভেতরে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে এমন এলাকা ও বাসা চিহ্নিত করা

৩) প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও তার সংলগ্ন এলাকা চিহ্নিত করা

৪) সাংস্কৃতিক কেন্দ্র চিহ্নিত করা যেগুলো অনেক সময় মিলিটারি প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়

৫) অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করা যারা এই আন্দোলনকে সাহায্য করছে

ওয়্যারলেসে কথা বলার সময় ৫৭ ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর জাফর বঙ্গবন্ধুকে ‘বুড়ো পাখী’ সম্বোধন করে তার আটক হওয়ার বিষয়টি প্রতীকীভাবে জানায় যে, বুড়ো পাখীটাকে খাঁচায় বন্দী করা হয়েছে – আর অন্যরা তাদের নীড়ে নেই (‘big bird in the cage... others not in their nests... over.')। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা শেখ মুজিবর রহমানকে এত ঘৃণা করতো যে টিক্কা খানের কাছে যখন জানতে চাওয়া হয় যে তার কাছে ‘বুড়ো পাখী’টাকে আনা হবে কিনা – উত্তরে সে জানায়, ‘আমি ওর মুখ পর্যন্ত দর্শন করতে চাই না’।

অতর্কিতভাবে এই মানব হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী খুব ঠাণ্ডা মাথায় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। তা মাঠে বাস্তবায়নের সময় তারা আরও নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছিল। সেই আক্রমণ এদেশের দালাল গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে সারা দেশের গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত ব্যপ্তি লাভ করেছিল যার কারণে এদেশের নিযুত মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। শুধু গণহত্যা নয়, সুপরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে এই দেশে। রাজাকার, আল বদর, আলশামস বাহিনী এই হত্যাযজ্ঞের অংশভাক হয়ে বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে কলংকময় অধ্যায় রচনা করতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে পুরো সহযোগিতা করেছে। ছোট্ট একটি দেশ বাংলাদেশের স্বাধীণতা অর্জন করতে যে মূল্য দিতে হয়েছে বাঙালি জাতির তা তুলনাহীন। নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করে পরাজিত করেছে হত্যাকারী বাহিনীকে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, এই ৪৬ বছরেও বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। আমাদের সকলের প্রচেষ্টায় নিশ্চয় সে স্বীকৃতি মিলবে অদূর ভবিষ্যতে।    

লেখক: শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছোট ছেলে

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ