X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

আজ স্বাধীনতা দিবস

তসলিমা নাসরিন
২৬ মার্চ ২০১৭, ১৫:৫৯আপডেট : ২৭ মার্চ ২০১৭, ১৮:১৫

তসলিমা নাসরিন আজ তো ঘটা করে স্বাধীনতা দিবস পালন করার কথা। আজ তো হাসি আনন্দে মাতোয়ারা হওয়ার কথা। কিন্তু রক্ত যে ঝরছে মানুষের! সিলেটে জঙ্গি হামলায় প্রচুর মানুষ নিহত এবং আহত। সেনারা জঙ্গি অভিযানে ব্যস্ত। স্বাধীন করেছেন বটে দেশ, তবে স্বাধীনতা-বিরোধীদের দিনে দিনে আস্কারা দিয়ে মাথায় তুলেছেন আমাদের নেতারা। স্বাধীনতার সেই শত্রুরাই দেশকে আবার হানাহানি আর বিভেদের রাজনীতি দিয়ে পরাধীন বানিয়ে ফেলেছে। স্বাধীনতার শত্রুরাই আজ জঙ্গি। জঙ্গিতে ভরে গেছে দেশ। একসময় পাকিস্তানীরা ধর্মীয় সন্ত্রাস চালিয়েছে বাঙালির ওপর, আজ বাঙালিরাই বাঙালির ওপর চালাচ্ছে সন্ত্রাস। অনেকে বলছে বাংলাদেশ যা বপন করেছে, তার ফল পেয়েছে। কী বপন করেছিলো বাংলাদেশ? মনে আছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার বলেছিলেন, ‘মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্পে সর্বোচ্চ এক হাজার পাঁচশ’ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ৭৮ লাখ ৪৪ হাজার চারশ’ জন কোরান ও নৈতিকতা শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে এবং এ প্রকল্পে ৭৬ হাজার ৫৯৫ জন আলেম-ওলামার কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে।‘ এই খবর পড়ে জগন্নাথ বিশ্বাবিদ্যালয়ের ছাত্র নাজুমুদ্দিন সামাদ শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, ‘ যতোগুলোর কথা বলছেন ততোগুলো জঙ্গি আর উগ্রবাদি বের হয়ে আসবে। দুধ-কলা দিয়ে সাপ পুষছেন! এই সাপগুলো একসময় আপনাকেই দংশন করবে এবং দংশন ও রক্তাক্ত করবে আমার বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ। এরকম আপাত জনপ্রিয়তা পাওয়া ও ভোটের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসুন। আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত পরিহার করুন।‘ শেখ হাসিনাকে কুপিয়ে মারা সম্ভব নয়, তিনি নিরাপত্তা রক্ষী দ্বারা বেষ্টিত। নাজুমুদ্দিন সামাদের কোনও নিরাপত্তা রক্ষী ছিল না। ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে মেরেছে সামাদকে।

জঙ্গিদের চাপাতির কোপে মৃত্যু হয়েছে নাজিমুদ্দিন সামাদের মতো স্বাধীনতার পক্ষের আরও অনেক মুক্ত চিন্তকের। খুনীদের ধরা ছোঁয়ার নাগাল এখনও পুলিশ পায়নি। কী আশ্চর্য! জঙ্গিরা তবে পুলিশের চেয়েও বুদ্ধি রাখে বেশি! পুলিশের চেয়েও সংগঠিত তারা! অনেকে অভিযোগ করে, বাংলাদেশে জঙ্গি জন্ম নেয় মসজিদ মাদ্রাসা থেকে, আলেম-ওলামা আর মোল্লা মৌলভির ওয়াজ শুনে, মগজধোলাই হয়ে। সত্যি মিথ্যে জানিনা, তবে ইউটিউবে বেশ কিছু বাংলা ওয়াজ শুনে দেখেছি, সেসব ওয়াজ মানুষকে নিশ্চিতই জেহাদে নামার জন্য ইন্ধন জোগায়, বিধর্মী আর নাস্তিক হত্যা করার উপদেশ দেয়।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরও পার হয়নি, দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি প্রকল্পে ধর্ম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধর্মকে জঙ্গিবাদে নিতে দুষ্ট লোকের অভাব হয় না। নির্বোধ লোকদের বেহেস্তের লোভ দেখিয়ে, হুরপরীর লোভ দেখিয়ে, দোযখের ভয় দেখিয়ে জঙ্গি বানানোও খুব কঠিন কাজ নয়। সরকারের যদি সত্যি ইচ্ছে থাকতো জঙ্গি এবং জঙ্গিবাদের পক্ষের লোক দিয়ে দেশ ছেয়ে না ফেলার, তবে মসজদের খুতবা, মাদ্রাসার শিক্ষা, মোল্লা মৌলভীদের ওয়াজে কড়া নজর রাখতেন, কী জিনিস ঢোকানো হচ্ছে মানুষের মস্তিস্কে, দেখতেন। সাবধান হওয়ার সময় অনেক ছিল। এখন, ভয় হয়, আদৌ জঙ্গিবাদ রোধ করা সম্ভব হবে কি না। এখন সরকার জঙ্গি নিধন চাইছেন। কিন্তু আগেও বলেছি, আবারও বলছি, জঙ্গি নিধন করে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা যায় না। জঙ্গি কেন উৎপন্ন হচ্ছে, সেটা খুঁজে বের করে সেই উৎসটা নির্মূল করতে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই। এক মুজিব থেকে লক্ষ মুজিব হয়ত আক্ষরিক অর্থে জন্মায় না, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এক জঙ্গি থেকে লক্ষ জঙ্গি জন্মায়, বা জন্মানোর ঢের আশঙ্কা দেখছি আজকাল।

বাংলাদেশে শিশুদের ধর্মশিক্ষাটা আগে দেওয়া হয়, পরে বিজ্ঞান পড়তে বলা হয়। ছেলেমেয়েরা বিজ্ঞান পড়ে পরীক্ষা পাশের জন্য, ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য। পরিবার, আত্মীয় স্বজন, ইস্কুল কলেজ, অফিস আদালত, ট্রেন বাস, রেডিও টেলিভিশন, বন্ধু বান্ধব তাকে নিরন্তর ধর্ম শেখাচ্ছে। তাই বিজ্ঞান পড়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়েও, বিজ্ঞানী হয়েও মানুষ অবলীলায় প্রথমে ধর্মপ্রাণ, পরে ধর্মভীরু, এরপর ধর্মান্ধ হয়ে যেতে পারে। ধর্মান্ধ’র পরের পদক্ষেপই ধর্মীয় সন্ত্রাসী। প্রমাণ পাওয়া গেছে দারিদ্র জঙ্গিবাদের কারণ নয়। পশ্চিমা দেশের অত্যাচারও জঙ্গিবাদের কোনও কারণ নয়, ইহুদিরা সবচেয়ে বড় ঘৃণা আর বৈষম্যের শিকার, তারা আজ জঙ্গি হয়ে পশ্চিমা দেশে কিন্তু হামলা করছে না। যে জাতি বা ধর্মগোষ্ঠী অত্যাচারিত হয়েছে দীর্ঘকাল, তারা তাদের অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে তো সন্ত্রাস করছে না। ইসলামি জঙ্গিবাদে বা জেহাদে দীক্ষা নিতে কেন মানুষ আসে তবে? কেন জেহাদিরা বির্ধর্মীদের আর কাফেরদের মেরে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায় বিশ্বে, কেন তারা বিশ্বাস করে এদের হত্যা করলে তারা বিনা বাধায় পৌঁছে যেতে পারবে বেহেস্তে! কোথায় লেখা আছে এসব? কোরান-হাদিসে যদি লেখা থাকে এসব, তবে দীর্ঘকাল তো মুসলমানেরা জেহাদ না করেও, শুধু নামাজ রোজা করেও, ধর্মে বিশ্বাস করেও দিব্যি কাটয়েছে। অষ্টম শতাব্দির মুতাজিলা-কালে তো দিব্যি যুক্তিবাদের চর্চা হতো মুসলিম বিশ্বে! সব ধর্মেই বৈষম্য আর বর্বরতা আছে। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে শুধু মুসলমানেরা কেন তাদের ধর্ম গ্রন্থের সব বাক্য গ্রহণ করছে? কেন রূপকথাগুলোকে সত্য বলে মানছে? ধর্মগ্রন্থগুলোকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে রেখে, ভালো মন্দ শিক্ষা নিতে তো পারি আমাদের শিক্ষা,সভ্যতা, দর্শন,আমাদের বিবেক, আমাদের সুস্থ চেতনা থেকে!
মাঝে মাঝে শেখ হাসিনার জন্য ভয় হয় আমার, তাঁকে যে কবে জঙ্গিরা মেরে ফেলে! শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করি, তিনি যেন তাঁর আততায়ীদের আর দুধ কলা খাইয়ে হৃষ্ট পুষ্ট না করেন, এতে হাসিনা বাঁচবেন, অনেক প্রগতিশীল মুক্ত- চিন্তার মানুষও বেঁচে যাবেন। বিরোধী দল এমন শক্তিশালী নয় যে হাসিনাকে ধর্মকে নির্লজ্জের মতো ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করতে হবে। তার চেয়ে তিনি তাই করুন, যা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়িত এখনও হয়নি।
ধর্মটাকে রাষ্ট্র থেকে, আইন থেকে, শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বের করে নিলেই এত দুর্ঘটনা ঘটে না, এত নিরপরাধের রক্ত আমাদের দেখতে হয় না। ধর্ম থাকুক ব্যক্তিগত হয়ে। ধর্মের রাজনীতি শেষ হোক। কোনও সভ্য দেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি চলতে পারে না। যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে, তারা বদ উদ্দেশে রাজনীতি করে। তাদের ইচ্ছে গণতন্ত্রকে বিদেয় করে ধর্মতন্ত্র জারি করা। ধর্মের নামে অনাচার, অবিচার, অন্যায়, অসন্তোষকে উস্কে দেওয়া।

জঙ্গিবাদের উদাহরণ দিতে গিয়ে আজকাল পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের সঙ্গে উচ্চারিত হয় বাংলাদেশের নাম। যে বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ধর্মান্ধতা আর অসহিষ্ণুতা হঠিয়ে দেবে কথা ছিল, সেই বাংলাদেশই এখন কাতরাচ্ছে ধর্মান্ধতা আর অসহিষ্ণুতার আধিক্যে। কী করুণ পরিণতি!

প্রথম যেদিন জঙ্গিরা বোমা হামলা করেছিল বাংলাদেশে, মানুষ কেঁপে উঠেছিল। আজ বোমা হামলা এত গা সওয়া হয়ে গেছে যে জঙ্গিরা একদিকে বোমা হামলা চালাচ্ছে, অন্যদিকে মানুষ খেলা দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। কেউ মানুক না না মানুক, বাংলাদেশে আজ কারো জীবনের নিরাপত্তা নেই। আজ জঙ্গিরা কারো প্রতিবেশি, কারো অফিসের কলিগ, কারো বন্ধু, কারো ভাই। জঙ্গিরা বাইরের দেশের কেউ নয়। তারা নিজের দেশের, নিজের লোক। আজ নিজের লোকদের বিরুদ্ধেই স্বাধীনতার জন্য, নিরাপত্তার জন্য, শান্তির জন্য যুদ্ধ করতে হচ্ছে আমাদের। নিজের লোকদের যদি গড়ে ওঠার সময় সুস্থ সভ্য পরিবেশ না দেওয়া হয়, নিজের লোকেরাই হয়ে ওঠে পরের লোক, নিজের লোকেরাই হয়ে ওঠে অদ্ভুত অচেনা লোক, নিজের লোকেরাই মাথায় কোপ দিতে দ্বিধা করে না। জঙ্গিবাদ বিলুপ্ত না হলে স্বাধীনতা দিবস আমরা সুখে স্বস্তিতে কোনদিনই উদযাপন করতে পারবো না।

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুক্তরাষ্ট্রের টি-টোয়েন্টি দলে নিউজিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার
যুক্তরাষ্ট্রের টি-টোয়েন্টি দলে নিউজিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার
‘আ.লীগকে বর্জন করলেই অন্য পণ্য বর্জনের প্রয়োজন হয় না’
‘আ.লীগকে বর্জন করলেই অন্য পণ্য বর্জনের প্রয়োজন হয় না’
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ