X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তি আসেনি আজও

জোবাইদা নাসরীন
২৬ মার্চ ২০১৭, ১৬:৫২আপডেট : ২৬ মার্চ ২০১৭, ১৬:৫৬

জোবাইদা নাসরীন বহুদিন আগে একটি সেমিনারে আমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল জ্যোৎস্নার।  জ্যোৎস্না পেশায় একজন সুইপার।  থাকেন সৈয়দপুরে, সুইপার কলোনিতে।  সেই সেমিনারে তিনি বলেছিলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তার বাবা শহীদ হয়েছেন, তার বোন দংশিত (ধর্ষণ অর্থে) হয়েছেন, কিন্তু এই স্বাধীন দেশে আজও তার ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারেনি, তার ছেলেমেয়রা এই স্বাধীন দেশেও হোটেল-রেস্টুরেন্টে বসে খাবার খেতে পায় না।  স্বাধীনতা তার জীবনে কোনও মুক্তি আনেনি।  তাই তার কাছে মুক্তি, স্বাধীনতা এইগুলোর কোনও অর্থই নেই।  শুধু জ্যোৎস্নাই নয়, হয়তো মুক্তি মেলেনি এদেশের বেশিরভাগ মানুষেরই।  যেমন মেলেনি আমার গবেষণায় লেপ্টে থাকা পেশায় সুইপার রঞ্জনার ছোট্ট মেয়ে কলমীর।  আট বছরের মেয়েটি আমার গা ঘেঁষে কিছুটা আস্তে, অথচ আমার বুকে দড়াম দড়াম করে ড্রামের শব্দ তুলে বলছিল- ‘দিদি আমি ড্রেনে দশ টাকা পেয়ে দৌড়ে হোটেলে গিয়েছিলাম সিংগারা খাবো বলে, ওরা আমার ড্রেনে পাওয়া টাকাটা নিল, কিন্তু আমায় ভেতরে বসে খেতে দিলো না’।
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দ দুটি আজ ব্যবসায়, জামা, জুতায়, গয়নায়, পোস্টার, প্ল্যাকার্ডে কিংবা বক্তৃতা বিবৃতিতে শক্ত আসন গেড়েছে।  কিন্তু আমরা বেশিরভাগই হয়তো অনুভব করতে পারি না বা আমাদের করতে দেওয়া হয় না এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী? কী ধরনের মুক্তি মানুষ আসলে চেয়েছিলো? এই চেতনা কী শুধুই ছিল অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক মুক্তি? এই মুক্তির নিশ্চিত অর্থ ছিল মানবিক মুক্তি।  মূল জায়গা মানুষের মানবিক অধিকার নিশ্চিত করার, মুক্তি ছিল বাংলাদেশের জমিনটা সবার জন্য সমান হওয়ার, মুক্তি ছিল ভূখণ্ডের আকাশটার ভাগ সবাই সমভাবে পাওয়ার, নারীসহ সকলেরই নিরাপত্তার, এই মুক্তি ছিল বিদ্যুৎ, বন্দর, গ্যাস, খনি, মাটি, ইতিহাস, ঐতিহ্য সুরক্ষার।  এই মুক্তি ছিল চিন্তার মুক্তি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্ম চর্চার স্বাধীনতা এবং নিজের মতো জীবন যাপনের স্বাধীনতা।

সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং মানবমুক্তির লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো সেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখনীও ইতিহাসে সকলের সমাধিকার প্রতিষ্ঠা করেনি।  হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ১৫ খণ্ডে প্রকাশিত 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র' ও একই ঘটনায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিহতদের ক্ষেত্রে পুরুষের জন্য 'শহীদ' এবং নারীর জন্য 'নিহত' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।  কোথাও উল্লেখ করা হয়নি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ যশোরের চারুলতার কথা যিনি ১ মার্চ ১৯৭১ সালে শহীদ হন।  চারুলতার মৃত্যু যশোরের নারীদের ঝাড়ু হাতে রাস্তায় নিয়ে এসেছিলো এবং অসহযোগ আন্দোলনে স্ফুলিঙ্গ তৈরি করেছিলো।

১৯৭১ সালের ভয়াল সেই ২৫ মার্চ অপরেশন সার্চলাইটে প্রথম আক্রমণ করা হয় ঢাকার পিলখানায়।  সেখানে আক্রান্ত হয়েছিলো পিলখানার অভ্যন্তরে থাকা সুইপার কলোনি।  শহীদ হয়েছিলেন কয়েকজন।  রাষ্ট্রীয়ভাবে তৈরি করা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস' বাংলাদেশের স্বাধীনতা যদ্ধের দলিলপত্রে আছে সেই সুইপারদের কয়েকজনের সাক্ষাৎকার যাঁরা সেই ভয়াল রাতের সাক্ষী দিয়েছেন। কিন্তু সেই রাতে শহীদ সুপারদের কেউই শহীদের তালিকায় স্থান পাননি।  শুধু ঢাকা পিলখানা নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সুইপার কলোনিগুলোতে পাক বাহিনী হামলা চালিয়েছিলো।  সেই পরিবারগুলো শুধু হয়তো তাদের পিতামাতা হারোনার কথা মুখেই বলে কিন্তু ইতিহাস লেখনী তাদের স্থান দেয়ননি, কারণ তারা সমাজে ক্ষমতা কাঠামোর কেউ নয়।

সমঅধিকার এবং বৈষম্যহীনতা বাংলাদেশে রাষ্ট্রটির চেতনাগত অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা সিলেট অঞ্চলের চা বাগানগুলো।  যেখানে নিম্নবর্গের চা শ্রমিকরা জীবন দিয়েছেন, অনেক চা শ্রমিক নারী শহীদ হয়েছেন এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তাদের জায়গাও হয়নি ইতিহাসে।  দফায় দফায় তরা শহীদ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়ও তাদের নাম নেই। পাননি কোনও সন্মান কিংবা বিশেষ ভাতা।  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বড় ধরনের অবদান রাখার পরও শিক্ষার সুযোগেই তারা দীর্ঘদিন পাননি, চাকরির কোটাতো অনেক দূরে।  এখনও দৈনিক ৫০ টাকা আয় করা অনেকের কাছে স্বপ্নের বিষয়।  মেলেনি তার শ্রমের মুক্তি, আটকে থাকা শ্রমিক জীবনের মুক্তি।

কোনও কোনও ঘটনা ইতিহাসের অংশ হয়, আর কোনোটি হয়না, সেটিই ইতিহাসের রাজনীতি।  আর ওই রাজনীতি চর্চার মধ্য দিয়ে ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন এবং ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসনে থাকা এদেশের মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও একটি ঐতিহাসিক আকাঙ্ক্ষা । মুক্তি নামক এক স্বপ্নের ওপর ভর দিয়ে এই অঞ্চলের মানুষ একের পর এক আন্দোলনে ঝাঁপ দিয়েছে।  কিন্তু মুক্তি মিলেনি।

জাতি, ভাষা, ধর্ম বর্ণ, লিঙ্গ, অঞ্চলভিত্তিক নিরপেক্ষতাই আসলে আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।  আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানেই বৈষম্যহীন সমাজের জন্য কাজ করা, সমাধিকার এবং ভূমি এবং ইতিহাসের মালিকানায় উত্তরাধিকারী হওয়া।  তাই এই ভূখণ্ডের জঙ্গল, জমি জল, বন্দর, বিদ্যুত, জ্বালানি, খনিজ সম্পদ সকল রক্ষা করার দায়িত্ব আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয়।  মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে জমি দখল, জঙ্গল চুক্তি, সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ, লিঙ্গীয় সংখ্যালঘুর ওপর আঘাত, মুক্ত চিন্তার ওপর নজরদারী, আদিবাসী স্বীকৃতির দাবির বিপরীতে অনড়তা, নারী ও সংখ্যালঘুর ওপর মানসিক টেনশন তৈরি-কোনোভাবেই গ্রহণীয় নয়।  বরং এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত এবং সংঘর্ষমূলক।

তাইতা মুক্তি মেলেনি আমাদের চিন্তাতেও।  তাইতো আও কলমীরা পড়তে যেতে পারে না কারণ সমাজ তাকে গ্রহণ করে না, আমার বন্ধু আরিফা ইঞ্জিনিয়ার হয়েও চাকরি পায় না তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বলে, ভাগীরথী সাহাকে জীপের সঙ্গে বেঁধে পিচঢালা রাস্তায় টানতে টানতে মেরেছিলো পাকিস্তানি সেনা বাহিনী।  ভাগিরথীরও জায়গা হয়নি ইতিহাসে।  তাইতো 'এখনও আসে না মমতার দিন, সমতা আসে না আজও'.....

 লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল:[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ