X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

সব জঙ্গি কি একটি ভবনেই থাকে?

হারুন উর রশীদ
২৬ মার্চ ২০১৭, ১৯:৫৪আপডেট : ২৭ মার্চ ২০১৭, ১৮:১৫

 

হারুন উর রশীদ সিলেটের শিববাড়ির ‘জঙ্গি আস্তানা’য় অভিযানে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে পরিচালিত হলি আর্টিজানসহ আরও বড় অভিযানের তুলনায় অনেক বেশি সময় নেওয়া হলো। আর অভিযানের মধ্যেই আস্তানার কাছে দুই দফা বোমা বিস্ফোরণে পুলিশ সদস্যসহ এখন পর্যন্ত ছয়জন নিহত হওয়ার খবর জানা গেছে। জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চলমান অবস্থায়ই এই ধরনের বোমা হামলায় নিহতের ঘটনা বাংলাদেশে এই প্রথম। হলি আর্টিজানের সঙ্গে এটা মেলালে হবে না। হলি আর্টিজানে পুলিশ সদস্যরা আক্রান্ত হয়েছিলেন শুরুতেই।


সিলেটের শিববাড়ির আতিয়া মহল একটি পাঁচতলা ভবন। এই ভবনের নিচতলায় জঙ্গিরা অবস্থান নেয় বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানায়। আর এই বাড়িটি  শনাক্ত হয় বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পরই। সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা অভিযান শুরু করেন শনিবার সকাল আটটার দিকে ৩২ ঘণ্টা পর। সেটা ছিল ওই ভবনে আটকে-পড়াদের উদ্ধারে প্রাথমিক অভিযান। জঙ্গিদের আটকে অভিযান শুরু হয় রবিবার সকাল ১০টায় ৫৮ ঘণ্টা পর।
তবে এর মধ্যে যা ঘটে গেল, তা হলো অভিযান চলাকালেই জঙ্গি আস্তানার কাছেই দুই দফা বোমা হামলা। প্যারা ট্রুপারকে প্রাথমিকভাবে পাঁচতলা ভবনের ৩০টি ফ্ল্যাট থেকে ২৭ নারী ও ২১ শিশুসহ যে ৭৮ জনকে উদ্ধার করেন, সে ব্যাপারেই বিফ্রিং করছিলেন শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে। আর ওই ব্রিফিং শেষ হওয়ার পরপরই মাত্র ৬০ গজ দূরে প্রথম বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। এর কিছুক্ষণ পরই বোমা বিস্ফোরণ হয়  কাছেই পূর্ব পাঠানতলা মসজিদ এলাকায়। সাধারণভাবে এটা ঘটনার ধারবাহিক বর্ণনা হলেও এরইমধ্যে বেশকিছু প্রশ্ন আছে।
তবে সেই প্রশ্নগুলো তোলার আগে সংক্ষেপে আরও কিছু তথ্য তুলে ধরা প্রয়োজন বলে মনে করছি—
১. শুক্রবার দুপুরে সিলেট পুলিশ জঙ্গিদের আত্মমর্পণের আহ্বান জানালে তারা জবাবে বলে, ‘দ্রুত সোয়াতকে আসতে বলুন আপনারা পারবেন না।’
২.সোয়াত টিম সড়ক পথে ঢাকা থেকে সিলেট পৌঁছায় শুক্রবার সন্ধ্যায়।

৩. সেনাবাহিনীর প্যারা ট্রুপার ঘটনাস্থলে যায় শুক্রবার রাত ৯টার দিকে।

তাহলে জঙ্গি আস্তানা শনাক্তের পর অভিযানের জন্য সব পক্ষকে এক হতে সময় লেগে যায় কমপক্ষে ২১ ঘণ্টা। আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি সিলেট কিন্তু বাংলাদেশেরই একটি বিভাগীয় শহর। বাংলাদেশের বাইরের কোনও দূরতম দেশ নয়।

এবার কিছু প্রশ্ন তুলে ধরছি যা আমার মনে জেগেছে। এটা কাউকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়ার জন্য নয়।

১.অভিযান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বাহিনীর টিমগুলোকে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে এত সময় লাগল কেন?

২. অভিযানের আগে আস্তানা সংলগ্ন এলাকাসহ সিলেট শহরের রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট করা হয়েছিল? যদি করা হয়ে থাকে, তাহলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল?

৩. জঙ্গি আস্তানায় এ ধরনের অভিযানের পরিকল্পনা কি শুধু আস্তানাকে কেন্দ্র করেই হয়? না সম্ভাব্য আরও ঝুঁকি মাথায় রেখে অ্যাকশন প্ল্যান করা হয়?

৪. অভিযানের আগে পর্যাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য কি হাতে ছিল? তাদের কি ধারণা এমন ছিল যে, সিলেট এলাকায় জঙ্গিরা শুধু ‘আতিয়া মহলে’ই আছে, আর কোথাও নেই!

৫. অভিযানে অংশ নেওয়া বাহিনীর মধ্যে কি সমন্বয় আছে? এর কমান্ড কার হাতে? কারণ শনিবার সকালে প্রাথমিক অভিযানের পরপরই আমরা দেখেছি, অভিযানের নাম নিয়ে বিভ্রান্তি। অপারেশন ‘স্প্রিং রেইন’ দিয়ে শুরু হলেও পরে তা হয়ে যায় অপারেশন ‘টোয়াইলাইট’।

সিলেটের এই জঙ্গি আস্তানার ঘটনার আগে ঢাকা মহানগরীতে একসপ্তাহের ব্যবধানে তিনটি আত্মঘাতী বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ১৭ মার্চ আশকোনায় র‌্যাবের নির্মাণাধীন সদর দফতরে। ১৮ মার্চ খিলগাঁও-এ র‌্যাবের চেকপোস্টে এবং ২৪ মার্চ এয়াপোর্টের সামনে পুলিশ বক্সের কাছে। শেষের ঘটনাটি আসলে সিলেটের ঘটনা শুরুর ১২ ঘণ্টা পরে। সিলেটের ঘটনা চলমান অবস্থায় ঢাকার বিমানবন্দরের ঘটনা ঘটে।

ঢাকার আত্মঘাতী বিস্ফোরণের ঘটনায় জঙ্গি তৎপরতার নতুন স্টাইল নিয়ে কথা বলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা জানান, জঙ্গিরা ভ্রাম্যমাণ হয়ে পড়েছে এবং তারা আত্মঘাতী হামলার দিকে ঝুঁকে পড়েছে।

সিলেটে শনিবার যে দু’টি হামলা হলো, সেখানে উচ্চমাত্রার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। বিস্ফোরণের জায়গা  থেকে শত শত স্প্লিন্টার সরানো হয়েছে। আর এই হামলা হয়েছে র‌্যাব পুলিশের উপস্থিতিতে । দুই জন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। র‌্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তাদের একজন ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রধান গুরুতর আহত হয়েছেন। আর এই সিস্ফোরণ দু’টি ঘটেছে অভিযানস্থলের আধা কিলোমিটার এলাকার মধ্যে। যেখানে র‌্যাব-পুলিশ ছাড়াও উৎসুক সাধারণ মানুষ ছিলেন।

এই হামলা যে ‘আতিয়া মহল’ থাকা জঙ্গিরা সেখান থেকে বের হয়ে চালায়নি, তা ধারণা করা যায়। আর এই ধারণা সত্যি হলে এই হামলা চালিয়েছে বাইরে থাকা জঙ্গিরা। যারা অভিযান-পূর্ববর্তী গোয়েন্দা অ্যাসেসমেন্টে ধরা পড়েনি। ওই বাড়িতে থাকা জঙ্গিদের বাইরেও যে সিলেটে জঙ্গি থাকতে পারে, তা তাদের ধারণায় হয়তো ছিল না। এমনও হতে পারে, হয়তো শুরুতে ছিল না । কিন্তু সময় পাওয়া পুলিশের ভাষায় ‘ভ্রাম্যমাণ’ জঙ্গিরা হয়তো সিলেটে চলে এসেছে।

অভিযানটি হয়তো শুরুই হয়েছে ওই ভবনের জঙ্গিদের মাথায় রেখে। বাইরের রিস্ক বিচেনায় রাখা হয়নি। তাই হয়তো অভিযান এলাকার আশপাশসহ শহরের নিরাপত্তা ছিল খুবই দুর্বল। তারা ভবনের বাইরে আর কোনও জঙ্গিদের কথা মাথায় রাখলে এত কাছে উৎসুক জনতা থাকতো না। কোনও চেকপেস্টেই হয়তো জঙ্গিরা বাধার মুখে পড়তো। তা হয়নি।

আর পুলিশ এখনও জানায়নি ওই হামলা কারা চালিয়েছে। তাদের কেউ ধরা পড়েছে কিনা, কেউ নিহত হয়েছে কিনা বা এটা আত্মঘাতী হামলা কিনা।

তবে অভিযান শুরুর সময় দীর্ঘায়িত হওয়াকে জঙ্গিরা সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছে বলে আমার মনে হয়। আর এ ধরনের অভিযানে সময় যত বাড়ে ঝুঁকি তত বাড়ে। জঙ্গিরা চিন্তার সুযোগ পায়। নতুন পরিকল্পনার সুযোগ পায়, স্থান পরিবর্তনের সুযোগ পায়। আক্রমণের সুযোগ পায়। সময় বেশি পেলে জঙ্গিরা তাদের নেটওয়ার্কে তথ্য বিনিময়ের সুযোগ বেশি পায়। আর এটা যে ‘আতিয়া মহল’-এর জঙ্গিদেরই করতে হবে তা নয়। তাদের সদস্যরাতো জানতে পারছে যে কী হচ্ছে। সেখান থেকেই তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর সোয়াতকে ডাকতে বলার কথা বলে জঙ্গিরা ভয় দেখিয়ে হয়তো সময়ক্ষেপণ করতে চেয়েছে। তারা সেটা পেরেছেও।

একইসঙ্গে সেখানে উপস্থিত বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে কারা ঠিক অভিযানটি চালবেন, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতেও সময়ক্ষেপণ হয়েছে বলে আমরা ধারণা। মূল অভিযানে যারাই থাকুন না কেন পুরো অভিযানটির একটি কেন্দ্রীয় কমান্ড থাকে। আর সেই কমান্ডও স্পষ্ট হতে সময় লাগে এই অভিযানে। যা অভিযানের একটি বড় দুর্বলতা বলে আমার কাছে মনে হয়েছে।

হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর অভিযান শুরুর দেরি নিয়ে সমালোচনা আছে। সেই আলোচনা সমালোচনা এখনও শেষ হয়নি। আর এরপর কল্যাণপুর থেকে আশকোনা ৬টি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালানো হয়েছে। ১২ ঘণ্টারও কম সময়ে এসব অভিযান শেষ করা হয়েছে। আর এই অভিযানগুলো সফল। কারণ কম সময়ে অভিযান শেষ করায় তাদের সহযোগীরা সংগঠিত হয়ে কাউন্টার কোনও হামলা চালাতে পারেনি।

সিলেট কোনও সহজ জায়গা নয়। এই সিলেটেই জঙ্গিরা হজরত শাহজালাল মাজারে ২০০৪ সালের ২১ মে ঢাকায় তখনকার ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া। ২০১৫ সালের ১২ মে সিলেটের সুবিদবাজারে হত্যা করা হয় ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস।

সিলেটের একটি এলাকা নাম শাপলাবাগ। আর সেই এলাকার একটি বাড়ির নাম সূর্যদীঘল বাড়ি। এই বাড়ি থেকে ২০০৬ সালের ২ মার্চ আটক করা হয়েছিল জেএমবি প্রধান শায়খ আব্দুর রহমানকে। শায়খ আব্দুর রহমানের নির্দেশেই ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৪ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালানো হয়েছিল।

এবার জানা গেল আরেকটি এলাকার নাম শিববাড়ি। সেখানকার একটি ভবন ‘আতিয়া মহল’। এখানে পাওয়া গেল জঙ্গি আস্তানা। আর সেই আস্তানায় অভিযান চলার মধ্যেই বাইরে বোমা হামলায় নিহত হলো ৬ জন।

আমি শায়খ আব্দুর রহমানকে আটকের সেই অভিযান সাংবাদিক হিসেবে সিলেটে বসে একদম কাছ থেকে দেখেছি। মাত্র ২৪ ঘণ্টার অভিযানে তাকে তার কয়েক সহযোগীসহ আটক করা হয়। আর অভিযানের সময় প্রায় ৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছিল।

কিন্তু এবার ‘আতিয়া মহল’-এ অভিযানের দীর্ঘ ৬৫ ঘণ্টা পর  দুই জঙ্গি নিহত হওয়ার খবর জানান হয়েছে প্রেস ব্রিফিং-এ। অভিযান চলছে। তবে আরও কত ঘণ্টায় শেষ করা যাবে বলা যাচ্ছে না। 

এই অভিযানটি সময় দৈর্ঘ্য বিবেচনায় ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে বলে আমার ধারণা। আর বাইরের হিসাব না রাখায় জঙ্গিরা অভিযানের চলাকালেই হামলা করতে পেরেছে। অভিযানটি বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে সর্বাত্মক মনে হয়নি। তাই এখান থেকে ভবিষ্যৎ জঙ্গিবিরোধী অভিযানে অনেক কিছু শিক্ষা নেওয়ার আছে।

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কলেজ চত্বর থেকে অসুস্থ ভুবন চিল উদ্ধার
কলেজ চত্বর থেকে অসুস্থ ভুবন চিল উদ্ধার
নাহিদ সুলতানা যুথীসহ ৩ জনের জামিন আবেদন শুনতে হাইকোর্টের নতুন বেঞ্চ
নাহিদ সুলতানা যুথীসহ ৩ জনের জামিন আবেদন শুনতে হাইকোর্টের নতুন বেঞ্চ
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা সাকিবকে আমার বাসায় নিয়ে আসেন: হাফিজ উদ্দীন
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা সাকিবকে আমার বাসায় নিয়ে আসেন: হাফিজ উদ্দীন
রাজধানীতে মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার ২৩
রাজধানীতে মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার ২৩
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ