X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

গোধুলির আঁধার কেটে উঠুক নতুন সূর্য

প্রভাষ আমিন
২৭ মার্চ ২০১৭, ১২:৩৩আপডেট : ২৭ মার্চ ২০১৭, ১২:৩৮

প্রভাষ আমিন ২৫ মার্চ, ভয়াল রাত। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির ওপর আধুনিক অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, তখনকার ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) এবং পিলখানা ও রাজারবাগে হামলা চালায়। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে যে নির্বিচার গণহত্যার সূত্রপাত, ৯ মাসে তা চলে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে। ৯ মাসে প্রাণ হারায় ৩০ লাখ মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বড় ও নৃশংস গণহত্যার উদাহরণ নেই। পাকিস্তান বরাবরই এ গণহত্যার দায় অস্বীকার করে আসছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এই গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ ধরে দাবি উঠেছে একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৫ মার্চ পালিত হচ্ছে গণহত্যা দিবস। এবার তাই আয়োজন ছিল অনেক বেশি। শোকে আর শ্রদ্ধায় জাতি স্মরণ করছে একাত্তরের শহীদদের।
কিন্তু হঠাৎ করে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। দুপুর থেকে কানে ফোন, যাতে সিলেট থেকে সংযুক্ত এটিএন নিউজের রিপোর্টার ইমরান সুমন। এক চোখ ডেস্কটপের ক্রিকইনফোর পাতায়, আরেক চোখ টেলিভিশনের পর্দায়। শ্রীলঙ্কার ডাম্বুলায় সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে দারুণ খেলছিল বাংলাদেশ। এমনিতে বাংলাদেশের যে কোনও সাফল্য আমাকে উল্লসিত করে। কিন্তু ২৫ মার্চে শ্রীলঙ্কার সাফল্য ঢেকে যায় সিলেটের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে।
আমরা যখন টেলিভিশনের পর্দায় ক্রিকেটারদের সাফল্যে হাততালি দিয়ে দেশ প্রেমের প্রমাণ রাখছি, সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোরা তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আতিয়া মহলে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারে ব্যস্ত।তারও আগে থেকে পুলিশ, র‌্যাব আর সোয়াতের সদস্যরা নাওয়া খাওয়া ভুলে ঘিরে রেখেছে জঙ্গি আস্তানা। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় সেনাবাহিনীর ব্রিফিঙের পরপরই কাছাকাছি এলাকায় দুই দফা বোমা হামলায় প্রাণ দিয়েছেন দুই পুলিশ সদস্যসহ ৬ জন,গুরুতর আহত হয়েছেন র‌্যাবের গোয়েন্দা প্রধান। আমরা যারা ক্রিকেটের সাফল্যে উল্লসিত, তাদের দেশপ্রেম নিয়ে আমি প্রশ্ন তুলছি না। কিন্তু আসল বীর আমাদের সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব আর সোয়াতের সদস্যরা। যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গি আস্তানা ঘিরে রেখেছেন, অভিযান চালাচ্ছেন। একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধারাও জীবনের মায়া তুচ্ছ করে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে লড়াই করে ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়।

বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কাকে ৯০ রানে হারানো অনেক বড় সাফল্য। কিন্তু সিলেটের ঘটনায় তেতো হয়ে যায় বিজয়ের আনন্দ।লঙ্কাবধ হতে পারতো স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গিফট।কিন্তু সিলেটে জঙ্গি আস্তানায় সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোদের চলমান অভিযান উৎকণ্ঠায় রেখেছে গোটা জাতিকে। একাত্তরের ২৫ মার্চের পর ২০১৭ সালে আরেক ২৫ মার্চ আসে আরেক কালরাত হয়ে। গোটা জাতি সময় পার করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর শোকে। হলি আর্টিজানের পর এমন উৎকণ্ঠার রাত আর আসেনি।

বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটা থেকে পুলিশ ঘিরে রেখেছে আতিয়া মহল। পরে সোয়াত গেছে, গেছে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোরা। এই লেখা যখন লিখছি, তখন পেরিয়ে গেছে ৬৩ ঘণ্টা। ‘অপারেশন টোয়ালাইট’ এখনও চলছে। রোববার বিকেলে দ্বিতীয় দফা ব্রিফিঙে জানানো হয়, ২ জঙ্গি মারা গেছে। ভেতরে আরও এক বা একাধিক জঙ্গি রয়েছে। জঙ্গিরা নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অপারেশন টোয়ালাইট চলবে।

অনেকে বলছেন, এত সময় লাগছে কেন? প্রথম কথা হলো, আতিয়া মহলে ৩০টি ফ্ল্যাটের একটিতে জঙ্গি আস্তানা। বাকি ২৯ ফ্ল্যাটে আটকা পড়েছিলেন ২৯টি পরিবার। আর জঙ্গি আস্তানায় ছিল বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক। মাঝে মাঝে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তারা তা জানানও দিচ্ছিল। তাই অভিযানের প্রথম লক্ষ্য ছিল আটকে পড়া মানুষদের নিরাপদে উদ্ধার করা। সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোরা সাফল্যের সাথে পাশের বাসার ছাদ দিয়ে গিয়ে প্রায় ৪০ ঘণ্টা পর নারী-শিশুসহ ৭৮ জনকে উদ্ধার করেছেন। উদ্ধার হওয়া সবাই বলেছেন, তারা নতুন জীবন পেয়েছেন। অভিযানটি কেন অতি সতর্কতা ও সময় নিয়ে করতে হচ্ছে, বোমা হামলা চালিয়ে জঙ্গিরা তার যৌক্তিকতা প্রমাণ করেছে। আতিয়া মহলের ভেতরেই শুধু নয়, বাইরেও রয়েছে জঙ্গিদের ঝুঁকি। তাই সময় লাগলেও ক্ষতি ন্যূনতম রেখে অভিযান শেষ করাই যৌক্তিক।

এমন একটি রুদ্ধশ্বাস সিনেমাটিক অভিযান টেলিভিশনগুলোর জন্য দারুণ ইভেন্ট। চাইলেই টেলিভিশনগুলো টানা লাইভ করে নিজেদের টিআরপি বাড়িয়ে নিতে পারতো। কিন্তু সবগুলো টেলিভিশন দারুণ পেশাদারিত্ব এবং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে অভিযানটি কাভার করছে। অস্বীকার করবো না, ঊর্ধ্বতনদের পরামর্শ ছিল। তবে সরকারের সব পরামর্শই যে গণমাধ্যম মেনে চলে, তা নয়। বরং অন্যায্য নির্দেশনা অমান্য করার ইতিহাসই বেশি। কিন্তু প্রশ্নটা যখন জাতীয় নিরাপত্তার, তখন নির্দেশনা বা পরামর্শ লাগে না। সামাজিক মাধ্যমে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, দেশে কোনও বেসরকারি টেলিভিশন নেই, সব সরকারি। তাই সিলেটের অভিযান সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য তারা পাচ্ছেন না। সামাজিক মাধ্যমের কোনও দায়িত্ব নেই। কিন্তু গণমাধ্যম সামাজিক মাধ্যমের মতো আচরণ করতে পারে না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মানে কিন্তু যা ঘটছে, তা হুবহু প্রচার করা নয়। গণমাধ্যম দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তার এডিটরিয়াল জাজমেন্ট প্রয়োগ করেই সংবাদ সম্প্রচার করবে। যা ঘটবে হুবহু তা সম্প্রচার করা ভালো সাংবাদিকতা নয়। একবার ভাবুন তো দেশের ২৬টি টেলিভিশন যদি একযোগে ‘অপারেশন টোয়ালাইট’ সরাসরি সম্প্রচার করতো, তাহলে সারা দেশে কেমন আতঙ্ক ছড়াতে পারতো। আর ২৬টি টেলিভিশন ক্যামেরা একযোগে লাইভ করলে সেনাবাহিনী ঠিকমত অপারেশনই চালাতে পারতো না। তাছাড়া জঙ্গিরা এখন কারিগরি দিক দিয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। টেলিভিশনের লাইভ দেখে জঙ্গিরা তাদের কৌশল ঠিক করতে পারতো। তাতে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি আরও বাড়তে পারতো। সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, সোয়াতের মতো গণমাধ্যম কর্মীরাও নাওয়া-খাওয়া ভুলে ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। বোমা হামলায় সাংবাদিকরাও আহত হয়েছেন। তাই আতিয়া মহলের জঙ্গি আস্তানার অভিযান দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সম্প্রচার করায় নিন্দা নয়, অভিনন্দন পাবেন গণমাধ্যম কর্মীরা।

একাত্তর সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ইসলামের নামে এ দেশে নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছিল। এখনও তাদের প্রেতাত্মারা ইসলামের নামে ভিন্ন ফরম্যাটে রুদ্ধ করতে চাইছে অগ্রগতির চাকা। কিন্তু শান্তির ধর্ম ইসলাম কখনও হত্যা-সন্ত্রা্স অনুমোদন করে না। আত্মঘাতী হামলা তো ইসলামে মহাপাপ। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, তবে ধর্মান্ধ নয়। ৭৫’এর পর থেকে বিভিন্ন সংগঠন ইসলামের নামে রাজনীতি করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের ভোট সবসময় সিঙ্গেল ডিজিটেই থেকেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ইসলামের নামে রাজনীতি, সন্ত্রাসে দেশের মানুষ কখনোই মেনে নেয়নি, নেবেও না। একাত্তরে আমরা জিতেছি। ২০১৭ সালে আমরাই জিতবো। অল্প কয়েকজন জঙ্গি আমাদের অগ্রগতিকে রুখতে পারবে না। ২৫ মার্চ কালরাতের গণহত্যার পথ ধরে যে মুক্তিযুদ্ধ, তার পথ ধরেই উদিত হয়েছিল স্বাধীনতার লাল সূর্য। জঙ্গিবাদের নামে যে আঁধার ঢেকে দিতে চাইছে আমাদের উদার আকাশ, তা ভেদ করে অপারেশন টোয়ালাইট বা অপারেশন গোধুলির পথ ধরে আবারও উঠবেই সম্ভাবনার নতুন সূর্য। আমরা তো জানিই রাত যত গভীর, ভোর তত নিকটবর্তী।

লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩৮
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩৮
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ