X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

আইএস ও আত্মঘাতী বিতর্ক

আমীন আল রশীদ
২৭ মার্চ ২০১৭, ১৫:৫৭আপডেট : ২৭ মার্চ ২০১৭, ১৬:০৯

আমীন আল রশীদ ২৪ মার্চ শুক্রবার সন্ধ্যার পর রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উল্টোদিকে পুলিশ বক্সের সামনে বোমা বিস্ফোরণে এক যুবক নিহত হওয়ার পর পুলিশ এটিকে ‘আত্মঘাতী হামলা’ বলে অভিহিত করে এবং তাদের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমেও ‘আত্মঘাতী বিস্ফোরণে একজন নিহত’ বলে খবর প্রচারিত হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ঘটনাস্থলে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এটি আত্মঘাতী হামলা নয়, বরং পুলিশের তল্লাশি এড়াতে বহনকারীর অতিরিক্ত সতর্কতায় বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে বলে তাদের ধারণা। অবশ্য পরদিন শনিবার দুপুরে ওই যুবকরে ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিক্যালের চিকিৎসক সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছেন, নিহতের শরীরে তার বাঁধা ছিল। এ থেকে ধারণা করা যায়, তিনি আত্মঘাতী ছিলেন।
ঘটনার ঘণ্টা দুয়েক পরে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলো পর্যবেক্ষণকারী বলে পরিচিত (এবং বিতর্কিত) যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েবসাইট সাইট ইন্টেলিজেন্সের বরাতে খবর আসে, ঢাকায় বিমানবন্দরের উল্টোদিকে পুলিশ বক্সের সামনে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের দাবি করেছে আইএস। এ সময় সাইট ইন্টেলিজেন্সের প্রধান নির্বাহী রিটা কার্টজ যিনি একসময় ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হয়ে কাজ করতেন এবং এখনও মোসাদের পার্পাস সার্ভ করেন বলে শোনা যায়, তিনি টুইটবার্তায় লেখেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ আইএস সমর্থকদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে এ জাতীয় হামলা আরও হতে পারে।’
পুলিশ বক্সের সামনে এই ঘটনার ঠিক এক সপ্তাহ আগে ১৭ মার্চ ওই এলাকাতেই র‌্যাবের অস্থায়ী ক্যাম্পে ‘আত্মঘাতী হামলায়’ এক যুবক নিহত হয়; যার পরিচয় নিয়ে পরে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়। সাইট ইন্টেলিজেন্সের খবর অনুযায়ী, ওই ঘটনারও দায় স্বীকার করে আইএস। সবশেষ সিলেটে সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ চলার সময় যে  ভয়াবহ বোমা হামলা হয়েছে, আইএস তারও দায় স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে সাইট।

মনে রাখা দরকার, আইএস-এর সরাসরি দায় স্বীকারের খবর আমরা পাই না। আইএস-এর মুখপত্র ‘আমাক’ নিউজের বরাতে সাইট যে খবর দেয়, গণমাধ্যম সেটিই প্রচার করে। ফলে আইএস-এর এই দায় স্বীকার বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ এবং এ নিয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

সন্দেহ করার প্রধান কারণ, পরপর দুটি ঘটনায় আইএস দায় স্বীকার করলেও তারা নিহতদের নাম পরিচয় উল্লেখ করেনি। নিহতরা বাংলাদেশে আইএস -এর কোন স্তরের নেতা বা তারা আদৌ আইএস-এর কর্মী কিনা-এসব নিয়ে কোনও তথ্য নেই। আবার আইএস অন্য যেসব জায়গায় আত্মঘাতী হামলা চালায়, সেখানে হামলাকারীসহ আরও অনেকে নিহত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে পরপর যে দুটি হামলার দায় আইএস স্বীকার করলো সেখানে কেবল হামলাকারীরাই নিহত হয়েছে। আত্মঘাতী হামলায় কী করে কেবল হামলাকারীই নিহত হয়? 

এক সপ্তাহের ব্যবধানে এই যে দুটি কথিত আত্মঘাতি হামলা হলো, এর একটির টার্গেট ছিল র‌্যাব এবং অন্যটির টার্গেট পুলিশ। যদি তাই হয় তাহলে প্রশ্ন, নিহত ওই দুই যুবক কি আসলেই র‌্যাব-পুলিশের ওপর আক্রমণ করতে গিয়েছিলো? যদি তারা আত্মঘাতীই হবে তাহলে কী করে কেবল তারাই নিহত হলো? কেননা বোমা বিস্ফোরণের আগ মুহূর্তে তারা চাইলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের খুব কাছে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারত। ফলে এগুলো আসলেই আত্মঘাতী হামলা কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আবার ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক যখন বলেন যে, নিহতের শরীরে তার জড়ানোর ছিল, তখন এট আত্মঘাতী বলেই মনে হয়। আবার পুলিশ বক্সের সামনে নিহত ব্যক্তির সঙ্গে একটি ট্রাভেল ব্যাগ পাওয়া গেছে, যেখানে বেশকিছু বোমা ছিল যা পরে নিষ্ক্রিয় করা হয়। এতে করে বোঝা যাচ্ছে তার গন্তব্য হয়তো ছিল অন্য কোথাও এবং পুলিশের কাছে ধরা পড়ে গেলে তিনি আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটাবেন, সেই প্রস্তুতিও তার ছিল। 

তবে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের বিষয় হলো, জঙ্গিরা যখন সত্যি সত্যিই আত্মঘাতী হামলা শুরু করবে, তখন অনেক বেশি প্রাণহানি হবে এবং আত্মঘাতী হামলা প্রতিরোধ করা খুবই কঠিন। কারণ যে হামলা করতে আসে সে নিজের মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিয়েই আসে। সুতরাং সে কাউকে পরোয়া করে না। এরইমধ্যে কতগুলো জঙ্গি গোষ্ঠীর কতজন বা কতশত এরকম আত্মঘাতী তৈরি হয়ে আছে এবং তাদের টার্গেটগুলো কী, তা ভাবতেও শিউরে উঠতে হয়। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধন্যবাদ যে তার চট্টগ্রামের সিতাকুণ্ড এবং সিলেটে বড় ধরনের নাশকতার প্রস্তুতি নস্যাৎ করে দিয়েছে। যদিও এর বিনিময়ে প্রাণ দিতে হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং সাধারণ মানুষকে। এরকম কোথায় কোথায় কত সংখ্যক জঙ্গি তাদের আস্তানা গেঁড়ে বসে আছে এবং কী ধরনের পরিকল্পনা করছে, তা আন্দাজ করা কঠিন।  

২.

মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের পর আইএস এখন বস্তুত কোণঠাসা। বিভিন্ন এলাকা তাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তাদের শক্তি যথেষ্ট কমে আসছে। এমনও শোনা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে মার খেতে খেতে দুর্বল আইএস এখন এশিয়া ও আফ্রিকার যেসব দেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, যেসব দেশ থেকে লোক বাগানোর চেষ্টা করছে। এজন্য তারা মোটা বিনিয়োগও করছে। ফলে যখনই এখানে বোমা হামলা বা কথিত আত্মঘাতী হামলা হচ্ছে, সেখানে দায় স্বীকার করে নিজেরা কৃতিত্ব নিতে চাচ্ছে কি না, তাও অনুসন্ধানের বিষয়।

আইএসের সামরিক ফ্রন্টের বাইরে দ্বিতীয় বৃহত্তম যুদ্ধক্ষেত্র হচ্ছে তাদের প্রচার বা প্রোপাগান্ডা ফ্রন্ট। নিজেদের সৈনিকদের মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য তারা সব সময়ই এমন সব কথাবার্তা লেখে যাতে সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা এটা মনে করে যে, তারা অনেক শক্তিশালী একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে রয়েছে এবং তাদের লক্ষ্যে তারা পৌঁছাতে সক্ষম। তারা যাদের শত্রু মনে করে, তারাও যাতে এসব প্রোপাগান্ডায় বিভ্রান্ত হয় এবং ভীত হয়-সেটিও তাদের লক্ষ্য। যে কারণে তাদের সব দাবিই যে সঠিক, এটি ভাববার কোনও অবকাশ নেই। আবার বিষয়টা এমনও হতে পারে যে, এখানে আইএস-এর কর্মকাণ্ড বা সাংগঠনিক ভিত্তি না থাকলেও স্থানীয় বা হোমগ্রোন জঙ্গিরা হামলা চালিয়ে সেটা আইএস-এর নামে চালিয়ে দিচ্ছে, যাতে আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসা যায়।

একসময় সরকারের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর সংবাদ সম্মেলনে দাবি করত, তাদের সাথে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর যোগাযোগ আছে। এর মধ্যে কেউ কেউ বাংলাদেশে আইএস-এর রিক্রুটার, স্থানীয় সংগঠক ইত্যাদি বলেও পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার পর সরকার স্পষ্টতই এখানে আইএস -এর অস্তিত্ব নাকচ করছে।

যদিও হোয়াইট হাউস থেকে পাওয়া এক বিশেষ মানচিত্রের বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজ দাবি করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায় বাংলাদেশ আইএস-এর উঠতি ঘাঁটিতে রূপান্তরিত হয়েছে। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে বিভিন্ন জঙ্গি হামলা জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা অন্য যে সংগঠনই করুক না কেন, তাদের সঙ্গে আইএস বা আল কায়েদার মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনের যে যোগাযোগ আছে, সেটি অস্বীকার করার এখন আর কোনও সুযোগ নেই। বাংলাদেশ যে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের নেটওয়ার্কে চলে এসেছে তা নিয়েও সন্দেহ না করাই ভালো।

তবে আইএস থাকুক বা না থাকুক, দেশে জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড চলতে থাকলে কিছু মানুষের সুবিধা। কিছু লোকের আর্থিক সুবিধা, কিছু লোকে রাজনৈতিক সুবিধা। জঙ্গিবাদ না থাকলে পশ্চিমাদের তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হালাল হয় না। সুতরাং তারা চাইবে জঙ্গিবাদ জিইয়ে রাখতে। সেটা আইএস-এর নামে হোক কিংবা অন্য নামে।

যেসব দেশ তাদের অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য বাংলাদেশকে সামরিক বলয়ে নিতে চায়, সেসব দেশ কখনোই চাইবে না বাংলাদেশ একটি শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে এগিয়ে যাক। সুতরাং এইসব জঙ্গি কর্মকাণ্ডের পেছনে তাদের বিনিয়োগ ও ইন্ধন কতটা আছে, তা জানা সহজ নয়। কিন্তু সজাগ থাকতে হবে। সেইসঙ্গে সাইট ইন্টেলিজেন্স কাদের পয়সায় চলে, কাদের জন্য তথ্য সরবরাহ করে এবং তাদের মিশন-ভিশন কী, সেগুলো জানা গেলেও এসব জঙ্গি তৎপরতার উদ্দেশ্য পরিষ্কার হবে। শুধু তথাকথিত খিলাফত প্রতিষ্ঠা কিংবা পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে কথিত জিহাদই যে এসব জঙ্গি কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য নয়, বরং এর পেছনে যে হাজার কোটি ডলারের তেল আর অস্ত্রের বাণিজ্য এবং বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি রয়েছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

বিমানবন্দরের সামনে পুলিশ বক্সে যেদিন বিস্ফোরণ হলো সেদিনই নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সংসদ সদস্য শামীম ওসমান এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘সামনে খারাপ সময় আসছে। যেটা কল্পনা করার মতো না, সে ধরনের খারাপ সময়ই আসছে। দেশে ও বিদেশে বসে সে পরিকল্পনা হচ্ছে। এর বেশি আমি কিছু বলবো না। ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে দেশকে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’ শামীম ওসমানের মতো একজন মানুষ যখন এরকম আশঙ্কা প্রকাশ করেন, সেখানে আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকদের ভীত না হয়ে উপায় কী?

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মুখোমুখি ইরান-ইসরায়েল, পরীক্ষার মুখে মার্কিন সামরিক কৌশল
মুখোমুখি ইরান-ইসরায়েল, পরীক্ষার মুখে মার্কিন সামরিক কৌশল
শহীদ মিনারে বীরমুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাসের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা
শহীদ মিনারে বীরমুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাসের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা
বিমানবন্দরে বাউন্ডারি ভেঙে ঢুকে যাওয়া বাসের চালক গ্রেফতার 
বিমানবন্দরে বাউন্ডারি ভেঙে ঢুকে যাওয়া বাসের চালক গ্রেফতার 
মোংলার তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সহসা নামবে না বৃষ্টি
মোংলার তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সহসা নামবে না বৃষ্টি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ