X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রস্তাবিত নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা আইন: কিছু ভাবনা

নাজমুল হক
৩০ মার্চ ২০১৭, ১৭:১৯আপডেট : ৩০ মার্চ ২০১৭, ১৭:২১

নাজমুল হক সম্প্রতি সরকার ভূমি রক্ষা সংক্রান্ত একটি আইন প্রায় চূড়ান্ত করে এনেছে। দেশের বর্তমান ভূমি ব্যবহার, অপব্যবহার ও বিশৃঙ্খল চালচিত্র বিবেচনায় নিলে এটি সময়োচিত এবং প্রশংসীয় উদ্যোগ। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী প্রস্তাবিত ‘নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা আইন ২০১৭’-এর বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিকগুলো নিম্নরূপ:
১। ইচ্ছামতো ভূমির ব্যবহার পরিবর্তন করা যাবে না। ভূমির ব্যবহার পরিবর্তন করতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে।
২। শুধু গ্রামেই নয় বা ব্যবহার পরিবর্তন নয়, উন্নয়নকাজে দেশের যেকোনও জায়গায় ভূমি ব্যবহার করতে হলে সরকারি কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র লাগবে।
৩। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলতে রাজউকসহ অন্যান্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ অন্যান্য ভূমি উন্নয়ন দফতরকে বোঝানো হয়েছে।
৪। উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এলাকার মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী ভূমি ব্যবহার এবং পরিবর্তনে ছাড়পত্র দেবেন। ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে জমির ধরন অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক মহাপরিকল্পনা করে উপজেলায় পাঠিয়ে দেবেন। পরে স্থানীয় কর্তৃপক্ষই এর ছাড়পত্র দেবে।
৫। এটি লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হবে।

কাগজে কলমে আশাবাদী, উচ্চাভিলাষী ও দরকারি আইন। কিন্তু সুভাবনার সঙ্গে দুর্ভাবনাও জড়িয়ে থাকে, অন্তত দেশের প্রেক্ষাপটে। যদিও আইনটির বিস্তারিত এখনও খসড়া পর্যায়ে রয়েছে।

এরপরও আমাদের অভিজ্ঞতা বলে এটির বাস্তবায়নে পাহাড়সম বাধা মোকাবিলা করতে হবে। নিচের পয়েন্টগুলোতে প্রাসঙ্গিক বাধাগুলোসহ এ থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব:

১। পরিকল্পনার দর্শন ও দৃষ্টি: যদিও ভূমি ব্যবহারে শৃঙ্খলা আনতেই আইনটি করা হচ্ছে, তবু প্রশ্ন থেকে যায়—আমাদের আসলে ভূমিনীতি ও দর্শন কী? ২০০১ সালের ভূমিনীতি এই প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয় না। আমাদের আগে নিশ্চিত হতে হবে, মোটা দাগে ভবিষ্যতে আমাদের ভূমির ব্যবহার কী রকম হবে। যেমন: ২০৫০, ২১০০, ২২০০ সাল নাগাদ দেশের কতটুকু ভূমি কোন কাজে ব্যবহার হবে। এই মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে এলাকা বা অঞ্চলভিত্তিক মহাপরিকল্পনা করতে হবে। এ রকম কোনও রেফারেন্স ও সুদূর পরিকল্পনা ছাড়া কিভাবে কোনও কর্তৃপক্ষ উন্নয়ন পরিকল্পনা অনুমোদন করবে?

২। ভিত্তি মানচিত্র: ভূমি ব্যবহারের মহাপরিকল্পনার জন্য বর্তমান ব্যবস্থার মানচিত্রকরণ খুব জরুরি। আমাদের লক্ষ রাখতে হবে, ২০১৭ সালের পরে বাংলাদেশের কোনও এলাকার কৃষিজমি, জল ও জলাভূমি যেন আর অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় না হয়। স্যাটেলাইট ইমেজ দিয়ে খুব ভালো করেই এটি করা যেতে পারে।

৩। স্থানীয় পরিকল্পনা: সচিব সাহেবের ভাষ্যমতে, বিশেষজ্ঞ কমিটি ঢাকা থেকে উপজিলা পর্যায়ের পরিকল্পনা করে পাঠিয়ে দেবে এবং সেই মোতাবেক ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র দেওয়া হবে। এটি একটি প্রমাণিত ভ্রান্ত পদ্ধতি। ঢাকা থেকে পরিকল্পনা করা হলে তা হবে বাস্তবতা-বিবর্জিত এবং এলাকার ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বরং স্থানীয় লোকজনের অংশগ্রহণে দেশীয় ও আঞ্চলিক মহাপরিকল্পনার আলোকে উপজেলা, ইউনিয়ন ভিত্তিক পরিকল্পনা করাই যুক্তিযুক্ত। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় কৃষি, জল ও পরিবেশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

৪। প্রয়োজনীয় লোকবল ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা: যতদিন পর্যন্ত স্থানীয় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় উপকরণ, লোকবল, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা অর্জন না করবে, ততদিন এই আইন বাস্তবায়নের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, জেলা ও সিটি করপোরেশনে ভূমি ব্যবহার অফিস স্থাপন তাই আরেকটি প্রয়োজনীয় বিষয়। এরও আগে সব জায়গায় ন্যূনতম একজন পেশাদার পরিকল্পনাবিদ নিয়োগ দিয়ে সেখানকার আগামী ৫০, ১০০ বছরের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ভূমি ব্যবস্থাপনার ডিজিটাইজেশন এই আইন বাস্তবায়নে  সহায়ক হতে পারে।

৪। গ্রামীণ গৃহ নির্মাণ ঋণ ও ‘কম্প্যাক্ট’ আবাসন: বর্তমানে গ্রাম পর্যায়ে কোনও গৃহ নির্মাণে ঋণের ব্যবস্থা নেই। ঋণের সুব্যবস্থা না করা গেলে এই আইন বাস্তবায়ন কঠিন হবে। জমিতে যেন আর বসতবাড়ি না হয় এবং একই পরিবারের লোকজন তাদের পুরনো বাড়িটি নতুনভাবে তৈরি করে কয়েকটি ফ্লাটে ভাগ করে নিতে পারে সেজন্য ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। বহুতল ফ্লাটের হাউজিং করে সেখানেও গ্রামের সবাইকে সরানো যায়, বিশেষ করে গুচ্ছগ্রাম, চরাঞ্চল ও নতুন বসতিতে।

৫। আইনের প্রয়োগ: আইন করে কিছুই হবে না যদি না আইনের প্রয়োগ যথাযথ না হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। আমরা দেখেছি, আইনের উপস্থিতি থাকার পরও নগর দু’টির উন্নয়ন পরিকল্পনা কিভাবে বেহাত হয়ে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে গিয়েছে। এখান থেকে আমাদের শিক্ষা নিয়ে নতুন আইন বাস্তবায়ন করতে হবে।

আগের লেখাতেই বলেছিলাম ‘যত পরিকল্পনাই করা হোক না কেন, পরিকল্পনা ও নীতিমালাকে আইনগত সুরক্ষা দিতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা বর্তমানে ব্যবসায়ী ও আমলা নির্ভর এবং খুব সহজেই জনভিত্তিক রাজনৈতিক ব্যাবস্থা ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। ততদিন পর্যন্ত আইনগত সুরক্ষা কিছুটা হলেও মহামারি দখলদারি এবং অপরিকল্পনার হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে।’ সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে প্রস্তাবিত আইনটি একটি বড় পদক্ষেপ। সেই সঙ্গে আইনের বাস্তবায়নে পারিপার্শ্বিক বাধা-বিপত্তির নিরসন করাও সমান জরুরি।

লেখক: পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশ গবেষক

[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তিন লাল কার্ডের ম্যাচে মোহামেডানের খেলতে অস্বীকৃতি, আবাহনীকে জয়ী ঘোষণা
তিন লাল কার্ডের ম্যাচে মোহামেডানের খেলতে অস্বীকৃতি, আবাহনীকে জয়ী ঘোষণা
প্যারিসে ইরানি কনস্যুলেটে নিজেকে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি, গ্রেফতার ১
প্যারিসে ইরানি কনস্যুলেটে নিজেকে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি, গ্রেফতার ১
ইরান হামলা বন্ধ করলেও ছায়াশক্তিরা সক্রিয়
ইরান হামলা বন্ধ করলেও ছায়াশক্তিরা সক্রিয়
খিলগাঁওয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
খিলগাঁওয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ