ফেসবুকে আমার এক বন্ধুর মন্তব্য- ‘বাজার থেকে ব্যাংক-সবখানেই আগুন। এই আগুন শোষকদের ঘরে কবে লাগবে?’ আরেক বন্ধুর বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকে আগুন জমা রাখে কে? গ্রহণ করেই বা কারা?’ দেশে আপাতত প্রধান তিনটি ইস্যু নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হচ্ছে- ক্রিকেট, জঙ্গি, আর আগুন। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার রাতে আকস্মিক বাংলাদেশ ব্যাংকে আগুন লাগার ঘটনাটি নিয়ে রসিকজনেরা নানা রকম মত-মন্তব্য করছেন। যদিও আগুন নিয়ে রসিকতা, আলোচনা, মত-মন্তব্য সব কিছুই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ আগুন বড়ই মারাত্মক। আগুন জ্বলে। জ্বালায়। আগুন লাগে। আবার লাগানোও হয়। কোনটা যে লাগে আর কোনটা যে লাগানো হয়- এই রহস্যঘেরা দেশে এটা বেশিরভাগ সময়ই জানা যায় না।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানা রকম আগুনের দেখা পাই। চুলার আগুন। চিতার আগুন। বনের আগুন, মনের আগুন, ক্ষোভের আগুন, লোভের আগুন, দেহের আগুন, চোখের আগুন। জ্ঞাত আগুন, অজ্ঞাত আগুন। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের আগুন। এই প্রক্রিয়ার ফল যে আগুন তা খুবই অভিনব ও রহস্যময়। আগুন লাগার পর যদি তার উৎস সম্পর্কে কোনও রকম কূল-কিনারা করা না যায়- তখনই বলা হয়, এটা বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের আগুন! আমাদের দেশে অনেক সময় শ্বশুরবাড়িতে মেয়েদের মেরে-পিটিয়ে হত্যা করে যেমন ‘আত্মহত্যা’বলে চালানো হয়, আগুন লাগানোর বেশিরভাগ ঘটনার ক্ষেত্রে ‘শর্টসার্কিট’ হিসেবে চালানো হয়! বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের আগুন সত্যিই অনেক ধন্বন্তরী। বহু ষড়যন্ত্রকারীর পিঠের চামড়া বাঁচাতে তা যুগে যুগে ভূমিকা পালন করেছে।
আদি মানবেরা আগুন আবিষ্কার করেছিলো লক্ষ লক্ষ বছর আগে। ক্রমান্বয়ে মানুষ আগুন নিয়ন্ত্রণ করে খাবার ঝলসে খেতে, তাপ ও আলো পেতে এবং শিকারীদের দূরে রাখতে শিখলো। আগুন মানব জীবনে এত বড় আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো যে কিছু মানুষ আগুনের পূজা পর্যন্ত করতো। বৈদিক যুগের তিন প্রধান দেবতার একজন হলেন অগ্নি; তিনি মর্ত্যের দেবতা, অন্য দু’জন হলেন স্বর্গের ইন্দ্র এবং অন্তরীক্ষের বরুণ। অগ্নিকে বলা হয় দেবতাদের মুখ বা দূত। কারণ, যজ্ঞে যে আহুতি দেওয়া হয় তা অগ্নির মাধ্যমেই অন্য দেবতারা পেয়ে থাকেন। বৈদিক ঋষিরা অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, আগুন অর্থাৎ তাপ হচ্ছে জীবনের উৎস এবং জীবের বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান উপাদান এবং সে কারণেই অগ্নিকে দেবতা হিসেবে পূজার প্রচলন শুরু হয়। অগ্নি একাধারে যজ্ঞ, গৃহ ও অন্নের অধিপতি। উপনিষদের ব্রহ্মা-এর মতো অগ্নি সর্বভূতে বিরাজমান।
আধুনিক যুগেও খাবার তৈরি, তাপ ও আলো দেওয়ার পাশাপাশি আগুন কখনও মোমবাতি বা, মশালে প্রতিবাদের প্রতীক, আবার কখনও ফানুস বা, আতশবাজিতে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা, বিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের আজকের মানুষে পরিণত হওয়ায় আগুনের ভূমিকা অপরিসীম।
এক সময় আমাদের এই উপমহাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সতীদাহ বা সহমরণ প্রথা চালু ছিল। স্বামী মরে গেলে স্ত্রীকেও চিতায় উঠতে হত। রামমোহন-বিদ্যাসাগর প্রমুখ মহামহিম ব্যক্তির কল্যাণে সমাজ থেকে সতীদাহ বা সহমরণ প্রথা উঠে গেছে। তবে যুগের পরিবর্তনে ‘পতি হারা সতী নারী’ নয়, এখন আগুন দেওয়া হয় গরিবের আবাস বস্তিতে। সতীদাহ হতো প্রকাশ্যে। আর এখন বস্তি-দাহ করা হয় গোপনে। তবে শুধু বস্তিতেই আগুন দেওয়া হয় না, বিভিন্ন জনের বাড়িঘরে, এমনকি অফিসেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আগুন এখন স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার। ক্ষোভ প্রকাশ, ষড়যন্ত্র নথিপত্র গায়েব করার জন্য আগুন ধরিয়ে দেওয়া এখন একটি লাগসই প্রযুক্তি হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে আকস্মিক আগুন লাগার ঘটনায় সচেতন মহলে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, আগুন কি সত্যি লেগেছে, নাকি লাগানো হয়েছে! গেলো বছর রিজার্ভ চুরির ঘটনা নিয়ে এমনিতেই সমালোচিত বাংলাদেশ ব্যাংক, এর ওপর বৃহস্পতিবারের আগুন লাগার ঘটনা বিষয়টিকে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ দুটি ঘটনার মধ্যে সম্পর্ক আছে কিনা তা নিয়েও চলছে জোর আলোচনা। উভয় ঘটনার মধ্যে একটি সাদৃশ্য এ প্রশ্নটিকে আরও জোরালো করেছে, আর তা হচ্ছে গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়েছিল ৩ দিনের ছুটির ফাঁকে, এবারও আগুন লাগার ঘটনার পরে রয়েছে তিন দিনের ছুটি।
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট সিস্টেম হ্যাকড করে রিজার্ভ চুরি করা হয়। সে সময়ও তিন দিনের ছুটি ছিল। এই ছুটির ফাঁকে মার্কিন ফেডারেল ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করে স্থানান্তর করা হয় ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকে।
এবার বাংলাদেশ ব্যাংকে আগুন লাগার পর সবার মনে প্রশ্ন উঠেছে, এত বড় বিল্ডিলিংয়ের অন্য কোনও ফ্লোরে না লেগে কেন ফরেন এক্সচেঞ্জের ফ্লোরেই আগুন লাগল? অনেকের উর্বর মস্তিষ্ক অবশ্য দুই-দুই চার মেলাচ্ছেন। গত ১৪ মার্চ এই ফরেন এক্সচেঞ্জের একটি ইমেইল হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটে। সেখান থেকে দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকে নির্দেশনা দিয়ে ইমেইল বার্তা পাঠানো হয়েছিল।
গব বছরের রিজার্ভ চুরির পর ইমেইল হ্যাকিং এবং এরপর ‘নিয়ন্ত্রিত’ আগুন লাগার ঘটনা ব্যাংক সংশ্লিষ্ট অনেকের মনে এই প্রশ্ন জাগাচ্ছে যে, এসবের পেছনে একটি চক্রই জড়িত আছে কিনা। কারণ এর আগে তদন্তে ওঠে এসেছিল যে, রিজার্ভ চুরিতে ব্যাংকের ভেতরের লোকজন জড়িত ছিল। অনেকে মনে করছেন, রিজার্ভ চুরি এবং কথিত ইমেইল হ্যাকিংয়ের ঘটনার যাবতীয় ডকুমেন্ট নষ্ট করতেই নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে এই আগুন ধরানো হয়।
এই আগুনবাজির প্রকৃত কারণ উদঘাটিত হবে, না সব কারণ পোড়া ছাই হয়ে থাকবে-তা এই মুহূর্তে বলা কঠিন। বাংলাদেশ ব্যাংকে শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগুক কিংবা লাগানো হোক, বিষয়টি আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগের। এভাবে ‘বস্তি’র সীমা ছেড়ে যদি আগুন ব্যাংক-বীমাসহ বাণিজ্যিক কেন্দ্রে বিস্তৃত হয়, তাহলে আমরা বাঁচব কিভাবে?
আগুনের ব্যাপারে আমাদের আসলে আরও সাবধানী হওয়া উচিত। আগুন, যার একটাই গুণ-কেবল জ্বালাতেই জানে। এই অগ্নিক্ষুধা এতোটাই একপাক্ষিক ঘটনা যে, জান-মাল সহ কিছুই আর অবশিষ্ট রাখে না। আগুন আর লোভ বাড়তে দিলে সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে দুটোই। কাজেই আগুন যেন লাগে, তা নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য সব কিছুই করতে হবে। আগুন নিয়ে খেলা বন্ধ করতে এখনই। তা না হলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই একদিন পুড়ে-ছাড়খার হয়ে যাবে!
লেখক: কলামিস্ট