X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

জনরায়ের প্রতি মন্ত্রণালয়ের 'বুড়ো আঙুল'

প্রভাষ আমিন
০৪ এপ্রিল ২০১৭, ১২:৫৬আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০১৭, ১২:৫৯

প্রভাষ আমিন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে এখন দেশজুড়ে তোলপাড়। পক্ষে-বিপক্ষে জয়-পরাজয়ের কারণ খুঁজতে চলছে নানান পর্যালোচনা। দারুণ কৌশলে আওয়ামী লীগের কাঁধে বন্দুক রেখে নিখুঁত নিশানায় গুলি করে শিকারের আনন্দে এখন বুদ বিএনপি শিবির। আর আওয়ামী শিবিরে চলছে, পরাজয়ের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা এবং তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ নিয়ে আলোচনা। ঠিক তখন আলোচনার মোড় ঘুরে গেলো। আলোচনায় সিটি করপোরেশনই আছে, তবে কুমিল্লার জায়গায় এসেছে রাজশাহী ও সিলেট। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হবিগঞ্জ পৌরসভা। প্রায় দুই বছর বরখাস্ত থাকার পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে মেয়রের দায়িত্ব নিতে গিয়েছিলেন সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী এবং রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। আরিফুল মেয়রের চেয়ারে থাকতে পেরেছেন দুই ঘণ্টা। আর বুলবুল মাত্র আট মিনিট। বুলবুল দায়িত্ব নিতে গিয়ে দেখেন তার রুমে তালা মারা। তালা ভাঙতে সময় পেরিয়ে গেছে বলে, দ্বিতীয় দফায় মেয়রশিপের মেয়াদ হয়েছে মাত্র আট মিনিট। হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জি কে গউসও দায়িত্ব নেওয়ার ১১ দিনের মাথায় দায়িত্ব হারান। এই তিনজনকেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে বরখাস্ত করা হয়েছে। তিনজনই উচ্চ আদালতের নির্দেশে দায়িত্ব নিতে এসেছিলেন এবং তিনজনই দ্বিতীয় দফায় বরখাস্ত হলেন। দায়িত্ব নিতে গিয়ে পাওয়া ফুল শুকানোর আগেই তাদের বরখাস্ত করা হলো। আশা করি আপনাদের বলে দিতে হবে না, এই তিনজনই বিএনপি সমর্থিত মেয়র।
বর্তমানে দেশে মোট ১২টি সিটি করপোরেশন আছে। তারমধ্যে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে এখনও নির্বাচন হয়নি। বাকি ১১টির মধ্যে ৬টি সিটি করপোরেশনেই বিএনপি সমর্থিতরা মেয়র পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, গাজীপুর ও সিলেট- এই ৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা জিতে যান। আমার ধারণা ৫ সিটি করপোরেশনে অভাবিত ফলাফলে চমকে গিয়েই আওয়ামী লীগ আপ্রাণ চেষ্টা করেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যাতে বিএনপি অংশ না নেয়। সরকারি দলের সেই ফাঁদে পা দিয়েই বিএনপি এখন কোথাও নেই- না সংসদে, না রাজপথে। আর কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রথম দুই নির্বাচনেই জিতেছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী। ৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর থেকেই বিরোধী দলীয় মেয়রদের সঙ্গে সরকারের টানাপড়েন শুরু। একের পর এক মামলায় রাজশাহী, সিলেট, গাজীপুর আর খুলনার মেয়ররা রীতিমত পর্যুদস্ত। তাদের কেউ পালিয়ে বেড়ান, কেউ কারাগারে থাকেন; আর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কলমের এক খোঁচায় উল্টে দেয় জনগণের রায়। এভাবেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত মেয়ররা এখন ‘দৌড়ের ওপর’। তারা নিশ্চয়ই এখন ভাবছেন, কোন কুক্ষণে যে নির্বাচন করতে গিয়েছিলেন। এলাকার লোকজনও নিশ্চয়ই একদিনে বিরক্ত। ভোট দিয়ে যাদের সেবা করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তাদেরকে তো তারা পাচ্ছেনই না। বিরোধী মেয়রদের নিয়ে আদালতের সাথে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের চোর-পুলিশ খেলা চলছে। আতালত যাদের বরখাস্ত আদেশ বাতিল করেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাদের বরখাস্তের নতুন আদেশ দেন। সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে দ্বিতীয় দফায় বরখাস্তরে একদিনের মধ্যেই উচ্চ আদালত তার বরখাস্ত আদেশ স্থগিত করে দিয়েছেন। তবে বরিশাল আর কুমিল্লার মেয়র ভাগ্যবান। বিরোধী দলের হলেও তারা সরকারি দলের আনুকূল্যে বহাল তবিয়তেই আছেন।

জনগণ ভোট দিয়েছে বলেই অপরাধী কাউকে দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে, এমন দাবি আমি করছি না। কিন্তু বেছে বেছে বিরোধী দলীয় মেয়রদের বিরুদ্ধেই একের পর এক মামলা দিয়ে আইনের ফাঁক ফোকর বের করে তাদের বারবার বরখাস্ত করা যে হয়রানিমূলক, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।

যে ৫টি সিটি করপোরেশনে সরকারি দলের সমর্থিত মেয়র রয়েছেন, তার মধ্যে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণের মেয়র মন্ত্রীর পদমর্যাদা পেয়েছেন। রংপুরের মেয়র পেয়েছেন প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা আর নারায়ণগঞ্জের মেয়র পেয়েছেন উপমন্ত্রীর মর্যাদা। তবে সরকারি দলের সমর্থন পেলেও কোনও মর্যাদা পাননি চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাসির।

নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মর্যাদা বাড়লে জনগণেরই মর্যাদা বাড়ে। কিন্তু প্রশ্নটা হলো, এই মর্যাদা নির্ধারণের মাপকাঠি কী? নির্বাচিত মেয়রদের মর্যাদা বাড়ানো খুব ভালো উদ্যোগ।এর মাধ্যমে ক্ষমতা বাড়বে স্থানীয় সরকারেরও।তবে সেটার একটা সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি ও যোগ্যতা থাকা উচিত। দল দেখে, ব্যক্তি দেখে মর্যাদা নির্ধারণ কোনও কাজের কথা হতে পারে না। সিটি করপোরেশনগুলোকে তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যেতে পারে। ‘এ’ক্যাটাগরির সিটি করপোরেশনের মেয়র পেতে পারেন মন্ত্রীর পদমর্যাদা, ‘বি’ক্যাটাগরির সিটি করপোরেশনের মেয়ররা পাবেন প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা এবং ‘সি’ক্যাটাগরির সিটি করপোরেশনের মেয়র পেতে পারেন উপমন্ত্রীর মর্যাদা।এটা নির্ধারিত থাকলে যিনি, যে দল থেকেই নির্বাচিত হোন, প্রাপ্য মর্যাদা তিনি পাবেন, এটাই হওয়া উচিত। কিন্তু এক যাত্রায় দুই ফল হওয়া কোনও কাজের কথা নয়। সবাই তো জনগণের ভোটে নির্বাচিত। কিন্তু কেউ পাবেন মন্ত্রীর মর্যাদা, কেউ যাবেন কারাগারে, কেউ হবেন বরখাস্ত; এটা মোটেই কাম্য নয়।

ঢাকায় এখন চলছে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন-আইপিইউ’র ১৩৬তম সম্মেলন। বিশাল এই সম্মেলনে দুইশরও বেশি দেশের সংসদীয় প্রতিনিধিরা অংশ নিচ্ছেন। ৫০টি দেশের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকাররাও অংশ নিচ্ছেন এই সম্মেলনে। বলা যায়, বাংলাদেশ এখন সংসদীয় গণতন্ত্রের মিলনমেলা। ঠিক এই সময়ে জনগণের ভোটে নির্বাচিত দুই মেয়র, যারা উচ্চ আদালতের নির্দেশে দায়িত্ব ফিরে পেয়েছিলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কলমের এক খোঁচায় তাদের বরখাস্ত করে দেওয়াটা গণতন্ত্রের প্রতিই এক ধরনের ঠাট্টা। কেউ যেন আইপিইউ সম্মেলনকেই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিল। সিলেট ও রাজশাহীর মেয়রকে বরখাস্ত করা বৈধ ও ন্যায্য হলেও টাইমিংটা খুব খারাপ হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, দুই মেয়রকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী জানতেন না। এটা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত। যার সিদ্ধান্তই হোক, সিদ্ধান্তটি ভালো হয়নি। আইপইউ সম্মেলনের খবর ছাপিয়ে গণমাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছে দুই মেয়রকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত।

দলীয় পরিচিতি, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দই যদি মেয়রদের মর্যাদা এবং কখনো কখনো দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ার একমাত্র মাপকাঠি হয়, তাহলে আর এত আয়োজন করে নির্বাচন করার দরকার কী। সরকারি দলের মনোনীতদের নির্বাচিত ঘোষণা করে, তাদের ইচ্ছামত মর্যাদা দিয়ে দিলেই হত।

লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ