X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ও ‘দেশ বিক্রি’ তত্ত্ব

আনিস আলমগীর
০৯ এপ্রিল ২০১৭, ২২:০৫আপডেট : ০৯ এপ্রিল ২০১৭, ২৩:৪০

আনিস আলমগীর ভারত সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের সময় সর্বোচ্চ সম্মান দেখিয়েছে। এ সফরের সময় উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে দুইটি বিষয়ে উদ্বেগ ও আগ্রহ ছিল— সামরিক চুক্তি ও তিস্তা চুক্তি। এ দুই বিষয়ে কোনও চুক্তি হয়নি। তবে সামরিক বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি খুব শিগগিরই তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের বিষয়েও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, শুকনো মৌসুমে তিস্তার পানি প্রবাহ কখনও কখনও মাত্র ১০০ কিউসিকে এসে যায়। এ কারণে পশ্চিম বাংলার সেচ ব্যবস্থায় পানি সরবরাহ সম্ভব হয় না।
ভারত ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন বাঁধ দিয়ে যে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি তৈরি করেছিল, তাও এখন পানির অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ শুধু তিস্তার অস্তিত্ব ঠিক রাখার জন্য ৫শ কিউসেক পানির প্রয়োজন। এমন পরিস্থিতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি বিকল্প প্রস্তাব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়ে বলেছেন, উত্তরবঙ্গে তোর্সা ও জলঢাকাসহ চারটি নদী রয়েছে, যে নদীগুলোতে শুকনো মৌসুমে পানি থাকে। ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ নদীগুলো থেকে পানি তিস্তায় নেওয়া যায়। এ নদীগুলোতে কোনও বাঁধ নেই।
তিব্বতের চুম্বি ভ্যালি থেকে উৎপন্ন হয়ে ভূটানের মধ্য দিয়ে ৩৫৮ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পশ্চিম বঙ্গের কুচবিহার জেলা হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে তোর্সা এবং বাংলাদেশে নদীটি জলঢাকার সঙ্গে মিশেছে ও যমুনায় মিলিত হয়েছে। তোর্সা নদীটি তিস্তার কিছুটা উত্তর পূর্বদিকে অবস্থিত। ধানসিঁড়ি নদীটি আসামের মূল নদী। ৩৫২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে নদীটি ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে।
আমরা বিশেষজ্ঞ নই। তবে সাধারণ জ্ঞান যা বলে, এসব নদীর পানি প্রবাহ অন্য খাতে প্রবাহিত করার ব্যবস্থা নিলে হয়তো যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের প্রবাহের গতি শ্লথ হয়ে যেতে পারে। কারণ, তোর্সা, জলঢাকা, ধানসিঁড়ি নদীগুলো যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর কন্ট্রিবিউটর। কিছু দিনের মধ্যে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ এমনিতে কমে যাবে। কারণ, তিব্বতে চীন ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প তৈরি করেছে। অবশ্য জল সংরক্ষণের জন্য পাশে জলাধারও তৈরি করেছে চীন। এ জলাধার থেকে চীন মূল ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ ঠিক রাখার জল ছাড়বে কিনা, তা নিয়ে এখনও কিছু বলেনি।
তোর্সা, জলঢাকা, ধানসিঁড়ি নদীর পানি তিস্তায় নিয়ে যাওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সুতরাং এ দীর্ঘসূত্রিতা পরিহার করে বিকল্প কী ব্যবস্থা করা যায়, তা বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞরা বৈঠক করে নিশ্চয়ই উদ্ভাবন করবেন। স্থায়ী সমাধানের জন্য এখানেও জলাধার নির্মাণ করা যায় কিনা, সেটাও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। শুকনো মৌসুমে যদি ভারতের অংশে সেচ ব্যবস্থা, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প— সবই পানির অভাবে বন্ধ হয়ে যায়, তবে বাংলাদেশকে পানি দেওয়া তো সম্ভব হবে না।
অবশ্য আমার মনে হয়, তিস্তার বিষয়টি সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের একটি দল পাঠানো দরকার। পানি ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশের দরকার একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। এত বড় একটি জাতীয় সমস্যার জন্য স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। বিদ্যুতের মতো পানি সমস্যার প্রতিও জরুরি ভিত্তিতে সমাধানের উপায় উদ্ভাবন, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ানে সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।
প্রতিরক্ষা খাতে ৫০ কোটি ডলারের একটি ঋণ চুক্তি ও তিনটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। মোট চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের সংখ্যা ২২। এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের ওয়েবসাইটে অবমুক্ত করা হয়েছে। ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকই উভয় দেশের মানুষের কাছে দৃশ্যমান। চুক্তিও স্মারকগুলো দৃশ্যমান করার সিদ্ধান্তটা খুবই উত্তম হয়েছে। কারণ যেকোনও বিষয়ে চুপিচুপি করলে মানুষের সন্দেহ সংশয় বেড়ে যায়।
ভারতের সঙ্গে কিছু হলে তিলকে তাল করে দেখানোর লোকের অভাব নেই বাংলাদেশে, বিশেষ করে রাজনীতির বলয়ে। এর মধ্যেই তারা ভারতের সঙ্গে আলোচনা ফ্লপ করবে বলে মুখিয়ে ছিলেন। ২০০১ সালের মতো সুযোগ গ্রহণের প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় তারা হতাশ হয়ে আওয়াজ তুলেছেন, শেখ হাসিনা দেশ বিক্রি করে দিয়েছেন। শেখ হাসিনা অনেক দূরদর্শী। ভারত যাওয়ার আগে ২০০১ সালের নির্বাচনে ‘র’-এর কথিত ভূমিকা ভারতকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যেন তেমন খেলা সামনে না হয়।
খেলার বিনিময়ে ভারত কী পেয়েছে ভারতের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে। আওয়ামী লীগ ভারতের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে বিএনপি তা পূরণ করবে না— এই আস্থা বিএনপির ওপর দেশের মানুষের নেই। মোদি সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের যেটুকু টানাপোড়েন মনে হচ্ছিল, তা ক্যাশ করতে না পেরেই বিএনপি দেশ বিক্রির জিকির তুলেছে মনে হচ্ছে। পত্রিকার খবর ছিল, শেখ হাসিনার সফরের পর পর বেগম জিয়া ভারত সফর করবেন। সে সফরের আর প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা, বিএনপি ও ভারত এখন হয়তো সেই হিসাব করবে।

থাক, দেশ রক্ষা চুক্তিটি ও স্মারকগুলো আলোচনা করা প্রয়োজন। সামরিক চুক্তিটি হলো— ভারত বাংলাদেশকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ প্রদান করেছে অস্ত্র কেনার জন্য। বাংলাদেশ এ অস্ত্রগুলো কিনবে ভারত থেকে। বাংলাদেশ এতদিন অস্ত্র কিনেছে চীন থেকে, রাশিয়া থেকে। এবার সর্বপ্রথম অস্ত্র কিনতে যাচ্ছে ভারত থেকে। কেনার টাকা ঋণ হিসেবে দিয়েছে ভারত। ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের পর গত ৩৩ বছরে ভারতের দু’টি সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করেছে। প্রথমটি দেব গৌড়া সরকার, দ্বিতীয়টি নরেন্দ্র মোদির সরকার। আমরা আশা করব, অস্ত্র সরবরাহের বিষয়েও নরেন্দ্র মোদির সরকার আন্তরিক হবে। কারণ, ভারত পুরনো অস্ত্র সরবরাহ করছে— এমন কথা বলার লোকের অভাব নেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে।
প্রতিরক্ষা বিষয়ে বাকি যেসব স্মারক সম্পাদিত হয়েছে, সেগুলো চুক্তি নয়, স্মারক। তার বাধ্যবাধকতা চুক্তির মতো নয়। যারা দুই দেশের মধ্যে সামরিক জোট হওয়ার সম্ভাবনার কথা চিন্তা করেছিলেন, তেমন কোনও সামরিক জোটও হয়নি। ২০০২ সালে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশেরও সামরিক বিষয়ে চুক্তি সই হয়েছিল। ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত স্মারকগুলো চীনের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির চেয়ে বেশি কিছু নয়।
বাংলাদেশের অবস্থান এমন যে তিন দিকেই ভারতের অবস্থান। সুতরাং, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ব্যাপক সমঝোতার কোনও বিকল্প নেই। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমানার বিষয়টি মীমাংসিত হওয়ার পর বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অংশের মোট আয়তন হচ্ছে এক লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কোটি কোটি ডলারের সম্পদ রয়েছে এই এলাকায়। এসব সম্পদ আহরণের জন্যও প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্রের সহযোগিতা প্রয়োজন। ভৌগলিক বিষয় কোনোভাবেই বদলানো সম্ভব নয়। তাই, পাশাপাশি বসবাসও করতে হবে, সমঝোতাও রক্ষা করে চলতে হবে। প্রতিবেশী মিয়ানমারকেও সে আস্থায় আনা দরকার। যুদ্ধ আর অবিশ্বাস কোনও সমাধান নয়।
এবার শেখ হাসিনার সফরের আগে বাংলাদেশের মানুষ উদ্বিগ্ন হয়েছিল, তা কিন্তু সত্য। কারণ, বাংলাদেশে সাবমেরিন পৌঁছানোর পর যেভাবে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এসে চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং একের পর এক ভারতীয় কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর শুরু করেছিলেন, তাতে উদ্বিগ্ন হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। ভারতের এমন তৎপরতা বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল। ভারতের জন্য এমনটি না করাই ভালো হতো। ভারতের সঙ্গে তার প্রতিবেশীদের কারও সম্পর্কই খুব ভালো নয়। বাংলাদেশের মতো অকৃত্রিম বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হলে নরেন্দ্র মোদির সরকারের পররাষ্ট্র নীতির চরম ব্যর্থতাই প্রকাশ পেত।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক
[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পঞ্চগড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ২ জনের
পঞ্চগড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ২ জনের
শচীনের ৫১, জন্মদিনের শুভেচ্ছায় সিক্ত ‘ক্রিকেট ঈশ্বর’
শচীনের ৫১, জন্মদিনের শুভেচ্ছায় সিক্ত ‘ক্রিকেট ঈশ্বর’
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
প্রস্তুত বলী খেলার মঞ্চ, বসেছে মেলা
প্রস্তুত বলী খেলার মঞ্চ, বসেছে মেলা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ